আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কেমনে আসে-যায়

দেহ তত্ত্বই বাউল সম্প্রদায়ের মূল ভিত্তি । দেহই সকল রহস্যের মূল । দেহকে দেখার অর্থ দেহকে পাঠ করা বা আত্মদর্শন করা । আপনাকে জানার মাধ্যমে পরম সত্তার অস্তিত্ত্ব জানা যায় । লালন পরমাত্মাকে উপলব্ধি করেছেন আপন অস্তিত্ত্বের মধ্যে এবং বিশ্বাস করেছেন, অস্তিত্ত্বের রহস্য গভীরভাবে ও একনিষ্ঠভাবে দেখলে, পাঠ করলে ও আত্মদর্শন করলে অচেনার সাথে সংযোগ হতে পারে ।

লালন সর্বযুগের ও সর্বকালের মানুষের জন্য তত্ত্বের রূপরেখা । বাউল মতে শাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়, আচার অনুষ্ঠান ও বিধি-বিধানের চেয়ে মানুষ বড় । আত্মসত্ত্বার মাঝেই নিহিত রয়েছে পরমাত্মার ঠাই । লালন হচ্ছেন একজন মহান দার্শনিক । যার দর্শন একজন মানুষকে কেবল খাঁটি মানুষ হওয়ার শিক্ষাই দেয়নি জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ দেখিয়েছে ।

পৃথিবীতে অনেক আদর্শ অনেক পথ এবং মত তার জায়গা করে নিতে অন্য আদর্শকে আঘাত করেছে, হানাহানির সৃষ্টি করেছে কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে বাউল আদর্শ । লালন দর্শন কাউকে আঘাত না করে এগিয়েছে । লালনের দর্শনে এবং বাউলদের কাছে লালনের মৃত্যু নেই । তিনি তিরোধান করেছেন মাত্র । তাঁর ভাব ও আদর্শকে তাঁরা জীবন্ত জ্ঞান করে সাধনা করেন ।

জন্ম ও মৃত্যুর চেয়ে তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ হিসেবে সঠিক দিশায় পৌঁছানোর ঘটনা । মৃত্যু হয় দেহের, চিন্তা ও ভাব যদি সঠিক হয় তবে তা অজর-অমর । লালনের জন্ম আসলে কোথায় তা আজো স্থির করে বলা যায় না । অনেক গবেষক মনে করেন লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন । লালন শাহ বা লালন ফকির (১৭৭৪- অক্টোবর ১৭, ১৮৯০) ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম ।

তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও অভিহিত করা হয় । গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল । তিনি একজন বাঙালী যার জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে । তিনি হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু ছেলেবেলায় অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পরিবার তাঁকে ত্যাগ করে । তখন সিরাজ সাঁই নামের একজন মুসলমান বাউল তাঁকে আশ্রয় দেন এবং সুস্থ করে তোলেন ।

লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন । ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন । আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালন শাহের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে । লালনের বেশ কিছু রচনাবলী থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে আদৌ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না । ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেধ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ।

তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না । তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের কোনও মূল্য ছিল না । তিনি ছিলেন মানবতাবাদী । অন্তরে প্রেম না থাকলে আবেগ আসে না । আবেগ থেকে আসে ভাব এখানে আবেগ ছাড়া ভাব ছাড়া কোন কিছুই সার্থকভাবে কার্যকর সম্ভব নয়, মানুষের অন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব নয় ।

চাপিয়ে দেয়া কোন কিছু মানুষ মেনে নেয় কিন্ত মনে নেয় না । কিন্তু প্রকৃতি থেকে যেটা আসে সেটা মানুষ মনে নেয়, মানুষ মনে করে এটা তাদের নিজস্ব । ১৮০৫ সালে লালন নবদ্বীপ হতে কাশী, বৃন্দাবন, পুরী এসব জায়গায় তীর্থ ভ্রমন করেন । দশ বছর পর তিনি ১৮১৫ সালে নদীয়ায় ফিরেন । এসময় একবার উত্তর বঙ্গের খেঁতুরীর মেলা দেখতে গিয়ে ফেরার পথে তিনি গুটি বসন্তে আক্রান্ত হন ।

শোনা যায়, তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে কালীগঙ্গা নদীর পাশে ফেলে রেখে যায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন - আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ । লালন ফকিরের গান "লালন গীতি" বা কখনও "লালন সংগীত" হিসেবে প্রসিদ্ধ । বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা কালে-কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের গানে প্রভাবিত হয়েছিলেন ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর প্রায় সহস্রাধিক গান সংগৃহীত হয়েছে । মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন একাই তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন যা তাঁর হারামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে । লালন শাহ এক তীর্থভ্রমণে বের হয়ে বসন্ত রোগে আক্রন্ত হয় । এমতবন্থায় তার সহযাত্রীরা তাকে ত্যাগ করলে সিরাজ সাইঁ তাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেয় এবং তাকে সুস্থ করে তোলে। এরপর লালন তার কাছ থেকে বাউলধর্মে দীক্ষিত হন ।

১৬ বছরের যে কিশোর একদা মুমূর্ষু অবস্থায় কালীগঙ্গার তীরে আধেক পানিতে আর আধেক কাদায় এসে পৌঁছেছিল । স্থানীয় কৃষক মলম ও তাঁর বউ মতিজান যাকে সন্তান-স্নেহে বাঁচিয়ে তুলে ঠাঁই দিয়েছিলেন । একদিন মুসা নবীও এভাবে নদীতে ভেসে এসেছিলেন, ভগবান কৃষ্ণও এভাবে পরের ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন । এভাবে মহাপুরুষেরা জাত-জন্ম-পরিচয় মুছে ওঠে আসেন । লালনও তেমনি আধেক পানিতে আধেক ডাঙ্গা থেকে আবার নবজন্ম পান ।

প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা এলেই আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদনৃত্যে ভারী হয়ে ওঠে সাধুবাজার । গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের চোখে চোখ রেখে শুরু হয় ভাবের খেলা । ভাবজগতের মধ্যে বেজে ওঠে তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে । লালন একাডেমি এখনো প্রতিবছর দু’টি অনুষ্ঠান করে আসছে । নিজস্ব শিল্পী এবং বাইরে থেকে শিল্পী এনে আখড়ায় দোল উৎসব ও স্মরণ উৎসবে গান করানো হয় ।

লালনকে জানার প্রথম প্রামাণ্য কাজটি করেন বসন্তকুমার পাল । রচনা করেন প্রথম প্রামাণ্য লালন জীবনী । প্রসঙ্গত, তাঁর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেন । মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরী পত্রিকায় লালনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয় । তার গানের ভেতর আছে মানব মুক্তির দর্শন ।

বিদেশে এই গায়ক, দার্শনিকের গান নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও নিজ দেশে, নিজ ভাষাভাষীদের কাছে লালন গীতির কদর নেই । আমরা নিজেরাই নিজেদের শ্রদ্ধা না করলে অন্যদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পাওয়ার আশা বাতুলতা মাত্র । তিনি নিজ সাধনা বলে হিন্দু-মুসলিম ধর্মের উপরে গভীর জ্ঞান লাভ করেন । তার রচিত গান তাই উভয় ধর্মের নিকট সমান সমাদৃত। তার লেখা গানে উভয় ধর্মের এবং আধ্যাত্নিক ভাবধারার ।

তার গানে মানব ধর্ম, মানবতা, জীবনে আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা প্রকাশ পেয়েছ । তিনি প্রায় ২০০০ গান রচনা করেছেন । তিনি কোন জাতিভেদ মানতেন না । রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার শিলাইদহ অবস্থানকালে লালন শাহের কাছ থেকে ২৯৮টি গান সংগ্রহ করে ২০টি গান প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন । সেখান থেকেই শিক্ষিত সমাজে লালনে পরিচয় ।

"আট কুঠুরী নয় দরজা আটা/ মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা/ তার উপরে সদর কোঠা/ আয়না মহল তায় । " মধ্যবিত্ত সমাজের মন-মননে রবীন্দ্রনাথের যে বিপুল অবদান, বাংলার কৃষক-কারিগরের নিম্নবর্গীয় সমাজকে মননশীল ও মুক্তিকামী ভাবরসে সিক্ত করায় লালনের অবদানও তেমনি বিপুল । সাধু-ভক্তদের পাশাপাশি বাউল সম্রাটের মাজারটির টানেও আসে ঝাঁক ঝাঁক পর্যটক । আসে দেশি-বিদেশি গবেষকরাও । লালনের খ্যাতি এখন শুধু এই কুষ্টিয়ায় নয়, দেশের গ-ন্ডী পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময় ।

লালনের চিন্তা, আদর্শ, জীবনকর্ম এবং সংগীত এখন পৃথিবীজুড়ে গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে । বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম অলঙ্কার বাউল সাধক লালন । লালনের সৃষ্টিকর্ম আজ বিশ্ব নন্দিত । লালন-নজরুল গীতি আর রবীন্দ্রসংগীত বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে বিকশিত করেছে । বাউল-সাধকদের কাছে লালনের সৃষ্টিকর্ম ভক্তি-সাধনার স্থান দখল করে আছে ।

লালনের আখড়া তথা সাঁইজির মাজার শরিফ থেকে বাউলেরা বিতাড়িত, লালনের দর্শন বিতাড়িত, লালনের স্মৃতি বিতাড়িত । মাজারসহ পুরো এলাকার মালিকানা এখন জেলা প্রশাসনের । সেখানে এখন আছে কেবল ভবন, বাণিজ্য, স্পনসরশিপ আর আনন্দ-বিনোদনের তুমুল মজমা । লালনের জীবন্ত ঐতিহ্যকে মুমূর্ষু করে জাদুঘরে পোরা হচ্ছে আর সাধনতীর্থকে বানানো হচ্ছে বাণিজ্যিক পর্যটনের খোরাক । বাংলার প্রতিষ্ঠানবিরোধী দার্শনিক আন্দোলন লালনের মাধ্যমেই বিপ্লবী বিকাশ পায় ।

নিম্নবর্গের মানুষের এই দার্শনিক এই নেতার চিন্তা ও কাজ সে যুগেরও যেমন এ যুগেও তেমন প্রতিষ্ঠিত জীবনদর্শনের বিপক্ষে । আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান লালনের সমাধিক্ষেত্রের পাশে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেন । পদাধিকারবলে এর সভাপতি হন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক । ১৯৭৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হয় লালন একাডেমি । ১৯৮৪ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেখানে ধর্মসভা বসান এবং লালনভক্তদের বের করে দেন ।

তিনি তাদের তওবাও করাতে যান । জেলা প্রশাসক এভাবে হন ধর্মেরও শাসক । প্রায় পাঁচ হাজার ফকির-সাধক বিক্ষোভ করলে রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে তাঁদের পিটিয়ে তাড়ানো হয় । মাজারের সিন্দুকের চাবিও সে দিনই বেহাত হয় । সবচেয়ে বড় ক্ষতি করা হয় ১৯৯৭ সালে ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে লালন কমপ্লেক্স নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় । একটি অত্যাধুনিক মিলনায়তন, জাদুঘর ও অতিথিশালাসহ চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য মাজারের মূল চত্বরকেই বেছে নেওয়া হয় । লালনের স্মৃতিবিজড়িত কালীগঙ্গা নদী ভরাট করে বানানো হয় উন্মুক্ত মঞ্চ । অবরুদ্ধ কালীগঙ্গায় নৌবিহার, শৌখিন মাছ শিকার, লালনের শিষ্যদের হাতে রোপিত শতবর্ষী বৃক্ষ কেটে ফেলে বিদেশি গাছ লাগানো ইত্যাদিও ছিল তাদের লালনের স্মৃতিরক্ষা প্রকল্পের অংশ । কোটি টাকা ব্যয়ে লালনের স্মৃতি ধ্বংস করা হয় এবং তাঁর অনুসারীদের করা হয় অবাঞ্ছিত ।

কবি শামসুর রাহমান এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে লেখক-শিল্পী-শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মীরা নানা কর্মসূচি ও লেখালেখির মাধ্যমে তৎকালীন সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, যা হচ্ছে তাতে লালনের সৃষ্টি, স্মৃতি ও সমাধির অশেষ ক্ষতি হবে । সরকার শোনেনি এবং কুষ্টিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্বও লালন আখড়া রক্ষা কমিটির এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় । লালনগীতির প্রতি আসক্তি কবে সৃষ্টি হয়েছে জানিনা । বাউলতত্ত্ব নিয়ে খুব বেশি পড়াশোনা আমার নেই । “এইসব দেখি কানার হাট বাজার”।

শব্দগত দিক থেকে এই লাইনটি তেমন কিছু না। কিন্তু মর্মার্থও কম নয় । ধর্মান্ধরা তাদের কানা চোখ দিয়ে তাদের প্রয়োজনের বাইরে আর কিছুই দেখেন না । তারা বউকে প্রহারের মধ্যে অনৈতিকতার কিছুই দেখেননা । জিহাদ (ধর্মযুদ্ধ) করে জনপদ রঞ্জিত করার মধ্যে কোন অপরাধ দেখেননা, সতীদাহ প্রথার মত জগন্য রীতির মধ্যে তারা পূণ্যত্ব দেখেন, বিচারের নামে মানুষের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তারা কোন অমানবিকতা খুঁজে পান না ।

গলা পর্যন্ত মাটিতে পুতে পাথর নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার মধ্যে তারা দেখেনা কোন নির্মমতা । প্রায় ২৪০০ বছর আগে এই কানাদের কানা বলেছিলেন বলে সক্রেটিসকে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হলো । লালন গীতির কোন লিখিত রূপ লালন সাঁইয়ের স্বহস্তে না থাকার কারনে তাঁর ভাব শিষ্যদের কন্ঠে বা খাতায় মূল ভাবাদর্শের রূপখানি অনেকাংশে বিকৃত হয়ে গিয়েছে । এমনকি তাঁর দেহান্তরের পরে বহু সংগ্রাহক ও সংকলকগনও সংশোধনের নামে যথেচ্ছ বিকৃত ঘটিয়েছেন । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

যিনি মহারাজ ফকির লালন শাহের প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা আর গুরু ভাবজ্ঞানে লালন সঙ্গীতের সংগ্রাহক ও সংকলক রূপে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছেন । লালন সাঁই সব সময় বিলীন থাকেতেন পরমাত্মার মাঝে । আর সেই অসীম পরম আত্মার মাঝেই খুঁজে বেরায়েছেন মানবসত্ত্বার মানুষকে । মানবতাই তাঁর নিকট ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ । তাই তিনি সহজেই বলতে পারতেন প্রচলিত ধর্ম মানুষের মাঝে বিরোধের সৃষ্টি করে ।

পরমাত্মার সাথে মানুষের একাত্ম হওয়ার ধর্মই মানবতা ধর্ম । যা মানবাত্মার দিব্যজ্ঞানের পরিচায়ক । লালন বাংলাদেশের একটি ব্যান্ড যা ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । ২০০৭ সালে প্রথম অ্যালবাম বিপ্রতীপ । সুমীর ভিন্ন রকম গায়কী আর ব্যান্ডের সম্মিলিত প্রয়াসে শুরু থেকেই শ্রোতাদের মনে একটা আলাদা জায়গা করে নেয় লালন ।

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তাঁদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ক্ষ্যাপা । ব্যান্ডের নাম লালন কেন ?—সম্ভবত এ প্রশ্নটাই সবচেয়ে বেশিবার শুনতে হয়েছে ব্যান্ডের সদস্যদের । উত্তর দিলেন সুমী, ‘আমি শুরু থেকেই লালনের গান বেশি গাইতাম । জীবনের তাগিদে অন্য গান হয়তো গেয়েছি, কিন্তু কখনোই শান্তি পাইনি । লালনের প্রতি সেই ভালোবাসাটা প্রকাশ করার একটা মাধ্যম বলা যায় এই নামকরণকে ।

’ লিমন বললেন, ‘সাঁইজির গান তো শুধু গান নয় । তাঁর গান হলো দর্শন । তরুণ প্রজন্মের অনেকেই লালনকে চেনে না । আমাদের ব্যান্ডের নামের মাধ্যমে তারা যদি লালন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেটাও একটা সফলতা । ’ লালনের গান গেয়ে অল্প দিনে সুনাম কুড়িয়েছে ‘লালন’ ব্যান্ডটি।

খুব বেশি দিন হয় নি এই ব্যান্ডটি প্রতিষ্ঠার । অথচ এরই মধ্যে জনপ্রিয়তায় অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডকেও তারা ছাড়িয়ে গেছে । লালন ফকিরের সহধর্মিনী এবং সাধনসঙ্গী ছিলেন বিশখা ফকিরানী । বিশখা ফকিরানী সারাজীবন লালনের সাথে ছিলেন । লালন শাহ ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বাস করতেন কিন্তু তিনি নিঃসন্তান ছিলেন ।

লালন শাহের প্রয়াণের সময়কালে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ যৌবনকাল । তখন তাঁর বয়স ২৮/২৯ বছর । যে ‘গীতাঞ্জলি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এবং বাংলা ভাষাকে এনে দিয়েছে সুনাম, সম্মৃদ্ধি ও বিশ্বজনীনতা । সেই গীতাঞ্জলির প্রতিটি ‘গীত’ ধীর-স্থীরতার সাথে পাঠ করলে নিজের অজান্তে মনে হবে - এ কথাগুলোতো তাঁর পূর্ব-পুরুষ বাউল কবি ফকির লালন শাহ আগেই বলে গেছেন । লালনের জীবন সবার মতো নয় ।

তিনি বাস করেন চেনা অচেনার মাঝামাঝি বন্দরে । লালনকে একদিক থেকে দেখে শেষ করা যায় না । তাঁকে দেখতে হয় নানান দিক থেকে । সুফিবাদ, বৈষনব সহজিয়া, তান্ত্রিকতাসহ বেশ কিছু দর্শনের সমন্বয়ে প্রবাহিত নদীতে লালন মুলত একাকী বয়ে যান । নিজের ভেতরেই বাস করেন, নিজের ভেতরেই মজে যান লালন ।

১৩৪৮ সালের মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের একটি মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয় । লালন হিন্দু না মুসলমান এনিয়ে বিস্তর মতভেদ । কারো মতে লালন কায়স্ত পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী । পরে লালন ধর্ম পরিবর্তন করেন । গবেষকদের একাংশ মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায় পরিবারের সন্তান ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর মনের মানুষ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মান করা হয়েছে ছবিটি, এতে লালন ফকিরের জীবন ও কর্মের কিছু চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । ১৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমা ‘মনের মানুষ‘ মুক্তি পায় ২০১০ সালের ০৩ ডিসেম্বর । পরিচালক গৌতম ঘোষ । প্রযোজনা করেছেন গৌতম কুণ্ডু এবং হাবিবুর রহমান খান । বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার যৌথ প্রযোজনায় ।

উপন্যাস মনের মানুষ প্রকাশিত হয় ১৪১৫ বঙ্গাব্দে দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় । ছবির মূল বিষয়বস্তু লালনের দর্শন এবং তখনকার সমাজব্যবস্থা । স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে লালন ফকিরকে নিয়ে প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে । ছবির নাম 'লালন ফকির' । রচনা আসকার ইবনে শাইখ ।

লালনের জীবনদর্শন ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে লালনের অবস্থান নিয়ে নাটক 'বারামখানা' মঞ্চে এনেছে থিয়েটার, বেইলি রোড। যে ধর্মনিরপেক্ষতা লালনের ভিত্তি, সেই লালন দর্শন আজ ধর্ম, রাজনীতি আর বাণিজ্যের অশুভ চক্রে পড়ে লোপ পেতে যাচ্ছে । 'বারামখানা' মূলত এ বিষয়কে তুলে ধরার প্রয়াস । লালনবিরোধিতার ধারা সৃষ্টি হয় মূলত তাঁর জাতপাতধর্মবিরোধী বক্তব্যের কারণে । আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে এঁদের প্রতি অত্যাচার-নিগ্রহ বৃদ্ধি পায় ।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাউলসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হয়ে পড়ে । লালন যে কি দিয়ে গেছে আমাদের সেটা যদি আমরা সঠিকভাবে সাধনা করি তাহলে আমরা অনেক উন্নতি লাভ করতে পারবো । লালন কোনো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন নি। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার , কিন্তু কি যাদুবলে, নিজ সাধনায় তিনি হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্ঠান সকল ধর্মের উর্ধে এক গভীর জ্ঞান সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন । তাঁর গানে আধ্যাত্মিক ভাবধারার প্রভাব দেখা যায় ।

( তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।