আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ৩

একটা মেয়ের একটু কথা। (১) সে গল্পকার। কয়েকদিন ধরে একটি গল্প মাথায় ঘুরছে, কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারছে না। খুবই অস্থির লাগছে। গল্প লেখা তার নেশা।

চায়ের নেশার মতো না বরং আফিমের নেশার মতো। সে গল্প লেখে নিজের জন্যই। নিজের লেখা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়। কিন্তু কয়েকদিন ধরে মাথায় থাকা গল্পটি আঙ্গুল পর্যন্ত আসছে না। পাতার পর পাতা লিখে ছিড়ে ফেলে সে।

ভীষন অস্থির লাগছে। নাহ্ আমার প্রেমীর কাছে গেলে হয়তো লিখতে পারবো। সে মনে মনে ভাবে। তার প্রেমী হল ছোট্ট এক চিলতে বাগানটি। হরেক রকম ফুল, ফল আর পাতাবাহারের একটি ছোট্ট বাগান।

এটাই তার প্রেমী এবং বন্ধু। সে বাইরে আসে। কিন্তু তার অস্থিরতা না কমে বরং বেড়ে যায়। সে অস্থির মনে পায়চারি করে। সদ্য ফোটা হলুদ এবং সাদা গোলাপ তার মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না।

কি যেন বারবার তারচোখ এড়িয়ে যায়। সে গল্পটাকে জোর করে মাথা থেকে সরায়। বাগানের ফুলগুলো দেখতে থাকে। সে খানিকটা অবাক হয়। এই জিনিস আগে তো কখণও খেয়াল করেনি সে! তার বাগানে লাল রঙের কোন ফুল নেই।

তার মানে কি লাল রঙের প্রতি তার কোন কন্ট্রডিকশন আছে? আশ্চর্য তো! ফুলের কথা মনে হলেই তো লাল রঙ প্রথমে চোখে ভাসে। কিন্তু তার চোখে কখনও লাল রঙ ভাসে না কেন? সে ঘরে যায়। সেখানে ফুলদানিতে রাথা প্লাস্টিকের ফুল গুলোও হলুদ। সে তার আলমিরা খোলে। নাহ্ লাল রঙের কোন কিছু তো কখনও কেনা হয়নি! এমনকি তার প্রিয় কফি মগটিও কলাপাতা কালারের।

সে তা ঘরে তন্ন তন্ন করে লাল রং খোঁজে। কিন্তু লাল রঙ্গের কিছু নেই। আগে কেন বিষয়টা খেয়াল করে নি? সে তার রুম থেকে বের হয়। মা টিভিতে প্রোগ্রাম দেথছেন। সে যায় মার কাছে।

মা আমার কোন লাল জামা নেই কেন? তুই তো সব জামা নিজের পছন্দে কিনিস। আমি কিছু বললে তো শুনিস না। কিন্তু আমার রুমে কোন লাল রঙের জিনিস নেই কেন? কি যে পাগলের মতো কথা বলিস! এখন লাল রঙ নিয়ে মেতেছিস কেন? আয় মাথায় তেল দিয়ে দিই মাথা ঠান্ডা হবে। না মা আমার কোন লাল রঙ্গের জিনিস নেই এই জিনিসটা খুব আশ্চর্যের মনে হচ্ছে না তোমার কাছে? কেন হবে? এদিকে আয় তো! তোর জ্বর হলো নাকি? উফ্ মা তোমার কখনও কিছু শেয়ার করে শান্তি পাওয়া যায় না! সে ড্রয়িং রুমে যায়। নতুন কেনা কুশন গুলোর সাইডে চিকন করে খয়েরি রং এর নকশা আছে।

কিন্তু এটা তো লাল নয়! তার অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ে। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? লাল রং কেন মাথায় ঢুকে গেল? লাল রং দেখার জন্যে তার চোখ যেন তৃষিত হয়ে আছে। সে দৌড়ে ফ্রিজের কাছে যায়। টমাটো সস তো লাল রঙ্গ হবার কথা। কিন্তু ফ্রিজে সস নেই।

ওখানে রাথা টমোটো গুলিও কাঁচা। সে শব্দ করে ফ্রিজ বন্ধ করে। অস্থির লাগছে খুব অস্থির লাগছে। মনে হয় সে পাগলই হয়ে গেছে। সে নিজের রুমে যায়।

আলমিরা হতে পুরোনো একটা ব্যাগ বের করে। ওখানে পেইন্টিং করার রং আছে কিনা দেখে। আছে কিন্তু টিউবটা খালি একদম পরিষ্কার। তার ভ্যনিটি ব্যাগ হাতড়ায় কিন্তু সে কখনও মেকআপ করে না তাই লাল রঙ পাওয়া গেল না। এমন সময মা আসেন ঘরে।

একি হাল করেছিস ঘরের? সব কিছু আগোছালো কেন? মা তুমি বড় জ্বালাতন করো! আচ্ছা ঠিক আছে এই নে, তোর জন্যে লাল রঙের একটা নাইট গাউন কিনেছিলাম। কিন্তু তুই পছন্দ করিসনি তখন। রেখে দিয়েছিলাম। কই দেখি? নে এটা। শিট মা তুমি লাল রঙ চেন না? এটা লাল রঙ? কেন এটা লাল না? এটা তো লাল খয়েরি, লাল না! এক কথাই তো! উফ, মা তুমি যাও তো! তুমি আমার অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছো! মা খানিকটা ভীত হয় এবার।

মেয়েটার কি হলো হঠাৎ? মেয়েটা একটু আলাদা কিন্তু কখনও তো এমন করেনি! মা দ্রুত পায়ে মেয়ের বাবাকে ফোন করতে যায়। মেয়েটির অস্থিরতার পাশাপাশি এখন যোগ হয়েছে রাগ। অক্ষম রাগ। মাথায় ঘুরতে থাকা গল্প আর লাল রঙ মিলে তার অস্থিরতাকে জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দেয়। মাথায় লাল রং এবং গল্প ঘুরছে।

সে দুহাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো তার মাথায় এক আইডিয়া খেলে যায়! সে দেরি না করে দৌড়ে রান্না ঘরে যায়। ড্রয়ার থেকে ছোট্ট কিন্তু ধারাল একটা ছুড়ি বের করে নেয়। তার রুমে আসে। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে।

সে কাঁপা হতেই বাম হাতে সাবধানে একটা পোঁচ দেয়। যেন আর্টারি না কাটে। ধারাল ছুড়ি বলে ছিটকে পড়ে না রক্ত। ধীরে ধীরে রক্ত বের হতে থাকে। চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করে সে।

সে আরেকটা পোঁচ দেয়। এবার আরো রক্ত বের হতে থাকে। আহ লাল রং টকটকে লাল রঙ! সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে! এইবার মাথায় থাকা গল্পটিকে লিখতে পারবে বলে মনে হলো তার। সে দ্রুত টেবিলে গিয়ে বসে। মাথার গল্প এবার হাতে আসে।

ঝর্ণা ধারার মতো শব্দ হয়ে গল্প বের হতে থাকে। সব অস্থিরতার অবসান ঘটে। আহা কি শান্তি, কি শান্তি! সে একনাগারে ডানহাতে গল্প লিখে যায়। আর বাম হাতটি হতে বের হওয়া রক্ত দেখে কিছুক্ষণ পরপর। (২) মৃদুলা ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ঢোকে।

অবিরাম ছুটে চলা তো প্রতিদিনের ব্যাপার। কিন্তু আজ এত ক্লান্ত লাগছে যে বলার মতো না। সকাল নয়টা হতে একটানা সন্ধা পর্যন্ত অফিসে কাটাতে হয়। বাসায় এসেও অফিসের কাজ নিয়ে বসতে হয় মাঝে মাঝে। তার দশ বছর বয়েসী বাচ্চাটা বাবার সাথে থাকে।

সে ডিভোর্সি। শুধু বাচ্চাটার দুঃখ ভুলে থাকতেই সে কাজ নিয়ে ডুবে থাকে। কখনও বাচ্চাটার জন্য বেশী মন খারাপ থাকলে ওকে ফোন করে। কিন্তু তারপর মন আরো খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটা তাকে মা ডাকে না।

সৎমাকে মা ডাকে। সেই মেয়েটাও বাবুকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসে। অল্পদিনেই বাবুকে আপন করে নিয়েছে। মৃদুলা এটা ভেবেই নিজেকে সান্তনা দেয়। তারপর আবার কাজে ডুবে যায়।

সে শাওয়ার নিতে ঢোকে। শুধ এই সময়টাতেই সে নিজের সাথে কথা বলার সময় পায়। সব কিছু যেন শুণ্য এবং অর্থহীন লাগছে তার কাছে। কিন্তু শুণ্য কি অর্থহীন আসলেই? সে হাসে। আজ এসব কি চিন্তা করছে সে? বেশী কাজ করতে করতে তার মাথা গরম হয়েছে আর কিছু না।

সে বেশীক্ষণ শাওয়ার নেয় না। বের হয়ে খাঁচায় রাখা টিয়া পাখিটিকে দেখে। কেমন গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে! সে পাখিটাকে খাবার দেয়। পাখিটা সেই গম্ভীর ভঙ্গিতে খায়। দেখে মৃদুলা হসে।

পাখিটা শান্ত দিয়েছে। শান্ত একসময় তার ক্লাসমেট ছিল আর এখন কলিগ। পাখিটা যেদিন এনেছিল সেদিন বলেছিল: আমার কথা যেন তোমার মনে থাকে সেই জন্যে পাখিটা এনেছি। পাখিটা দেখলে আমার কথাও মনে হবে। মৃদুলা পাখিটা রাখেনি সেদিন।

কিন্তু আরেকদিন এসে পাখিটা চুপি চুপি তার ফ্ল্যাটের সামনে রেখে যায়। মৃদুলা শেষ পর্যন্ত পাখিটা রেখে দেয়। শান্তর স্বভাবই এরকম। হি ইজ আ ভেরি ফানি ম্যান। মনে মনে একথা বলে মৃদুলা খানিকটা অবাক হয়।

শান্ত আবার কখন এল মাথোয়? সে কফি বানায়। সাথে হালকা নাশতা। এমন সময় শান্তর ফোন আসে। সে রিসিভ করে। মৃদুলা তুমি নাকি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছো? কে বললো? এরিক।

না আমি শুধু বলেছি যে আমার আর ভাল লাগছে না। আমি টায়ার্ড। টায়ার্ড তুমি? সেও সম্ভব? কেন আমি কি মানুষ না? অবশ্যই মানুষ। শোন তুমি চাকরি ছাড়লে আমিও ছাড়বো। কেন? তুমি আর আমি মিলে নতুন কোম্পানি খুলবো।

এই শাদা চাড়ার জব আর করবো না। আমার নামটা পর্যন্ত বলতে পারে না। বলে শ্যানটো। কোথায় শান্ত আর কোথায় শ্যানটো। কোথায় আগরতলা আর কোথায় খাটের তলা।

হা হা হা। হাসবে না। আমি বলিনি চাকরি ছাড়ার কথা। আর এই সব ওয়ার্থলেস কথা বলার জন্য ফোন করেছো? হুম। তুমি কি ভেবেছিলে? প্রেমের কথা বলার জন্য ফোন করেছি? তুমি আমার প্রেমে পড়নি তো আবার? শান্ত ফোন রাখ বলছি।

ফোনতো আমি টেবিলে রেখেই ব্লুটুথ লাগিয়ে কথা বলছি। হা হা হা হা। হাসবে না। ফোনতো তুমি কেটে দিলেই পারো। মৃদুলা ফোন কেটে দেয়।

শান্তর উপর রাগ লাগে তার। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। সে ফেলে দেয় কফি। তার ক্ষুধাও মরে গেছে। সে দেখে খাচার ভিতর পাখিটা যেন অস্থির হয়ে আছে।

একটা বড় খাচা কিনতে পারলে হতো। সে মনে মনে ভাবে। পাখিটাকে নিয়ে সে ব্যালকনিতে যায়। কফিটা না ফেললেই হতো। সে ভাবে।

খুব ঠান্ডা পড়েছে। সে চাদর দিয়ে ঢাকে নিজেকে। একসময় শীত এলে তার গরীব মানুষদের জন্য খুব কষ্ট হতো। কিন্তু এখন আর এসব ভাবে না সে। অফিসের কাজ নিয়ে বসতে হবে।

কিন্তু কি রকম আলস্যতা তাকে বন্দী করে রাখে। এরিক ফোন করে। হেই মিস মৃদুলা? ইয়েস টকিং। আর ইউ রিয়েলি টায়ার্ড? ইয়া। আই এম টায়ার্ড।

আই নিড রেস্ট ইউ নো। ওয়েল, ইউ ক্যান হ্যাভ রেস্ট। ইউ ক্যান স্কিপ অফিস নেকস্ট সাম ডেজ। ওকে আই উয়িল। এন্ড থ্যাংক ইউ ফর দ্যা ফেভার।

মাই প্লেজার। বাই। মৃদুলার আরো ক্লান্ত লাগে। বাবুর কথাও মনে হয়। কি করছে বাবু? সে দেখে খাঁচায় পাখিটা ছটফট করছে।

ঠিক যেমন মৃদুলার বুকের ভেতর ও একটা পাখি ছটফট করছে। মৃদুলার অস্থিরতা বাড়ে। এই শীতেও সে ঘামছে। সে পাখিটার খাঁচাটা খোলে। সাবধানে পাখিটা বের করে আনে।

পাখিটাকে একবার গালে লাগায়। তারপর ছেড়ে দেয়। পাখিটা একবারও পিছনে না তাকিয়ে উড়ে চলে যায়। কোথায় সে জানে না। মৃদুলার ভিতরে ছটফট করতে থাকা পাখিটাকেও যদি কেউ ছেড়ে দিতো! শান্তর ফোন আসে।

হ্যাঁ বল শান্ত। তুমি কি রাগ করে আছো? নাহ্। ইউ নো আমি তোমাকে একটা কথা বল চাই। বলো। আমি তোমাকে আগেও বলেছিলাম।

তোমার বিয়ের আগে কিন্তু তুমি ভেবেছিলে ফান করছি। আমি এখনও অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলার চেষ্টা করেছি। কি কথা সরাসরি বলো। এত প্যাচাবার কি দরকার? ওকে শোন তুমি যখন রেগে আমার ফোন কেটে দাও তারপরও কিন্তু আমি অনেকক্ষণ ফোনটা কানে লাগিয়ে রাখি। জানো কেন? হুম জানি।

তাহলে..ইয়ে.... মানে তাহলে.....আমি বলছিলাম যে আমি তোমার জন্য একটা রিং কিনেছিলাম। ওকে নিয়ে এসো এটা পড়বো। শুধু রিং অন্য কিছু কেনো নি? না না কিনেছি তো। লাল একটা শাড়ি কিনেছি। সাথে মায়ের দেয়া একজোড়া বালাও আছে।

তুমি পড়বে মৃদুলা? হুম পড়বো। মৃদুলা ক্লান্ত কণ্ঠে বলে। দশ বছর ধরে জমানো সব ক্লান্তি সে এক নিশ্বাসে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।