আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেষের পাতা - ৬

আমি বড়ই ভীতু মানুষ । হঠাৎ একদিন খাওয়ার টেবিলে বসে আব্বা আচমকা ঘোষণা দিল, “ রোহু , রাজিবের সাথে তোর বিয়ের কথা পাকা করে এসেছি । তুই বিয়ের জন্য রেডি হ । ” আমার তো শুনে আত্মারাম খাচাছাড়া , কিন্তু আপু দেখলাম বেশ ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ সামনে ফাইনাল । এখন বিয়ের কথা ভাবছি না ।

” আব্বা ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত ফুঁসতে লাগলেন , “ তোর পড়ার আর দরকার নাই । বাদ দে পড়াশুনা । মেয়েদের এত লাই দিলে মাথায় উঠে । কালকে থেকে তোর মেডিকালে যাওয়া বন্ধ । ” আপু কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়া ছেড়ে উঠে, হাত ধুয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল ।

পিছন পিছন যাওয়ার ইচ্ছাটা খুব কষ্ট করে নিবৃত করলাম, আব্বার হুঙ্কার আর শুনতে ইচ্ছা করছিল না । আপু ফাইনালটা দিল । শেষের দিন পরিক্ষা দিয়ে এসেই ঘরে টেনে নিয়ে আমাকে বলল, “ সোহু শোন , আব্বা তো কিছুতেই মেনে নিবে না । তাই আমি আর সোয়েব কালকে রেজিস্ট্রি করে ফেলবো । এরপর যে কপালে কি আছি জানি না ।

” একটু থেমে আবার বলল, “ আব্বার জন্য চিন্তা হচ্ছে। বয়স হয়ে গেছে ধাক্কাটা সামলাতে পারে কিনা । কি যে হবে । ” বলে আপু খুব চিন্তিত মুখে, কটাস কটাস করে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলো । আমার মুখ আর গলার ভিতরটা শুকিয়ে গিয়ে জিহ্বাটা এত ভারী হয়ে এল যে কোনো কথাই সরছিল না ।

কোনমতে তাও ঢোক গিলে জিজ্ঞাসা করলাম, “ রেজিস্ট্রির পর কি করবে ?” “ আব্বার কাছে দুজনে দোয়া চাইতে আসবো । ” আপুর কণ্ঠটা হালকা কাপছিল , কথাগুলো বলতে বলতে চোখদুটো এক অজানা অনিশ্চয়তার মাঝে হারিয়ে গেল । “ আপু ?” “ কি?” “ আপু তুমি কি একটিবারও আমার কথাটা চিন্তা করলে না ?” আপু থতমত খেয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন । “ আমি…….. আমি আসলে……” কথা হারিয়ে ফেলল । মনের কষ্টটা চাপা দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, “ থাক আপু , চিন্তা কর না ।

আমি ঠিকই থাকব । আমার আর কি হবে ? যা ঝড় তো তোমার উপর দিয়েই যাবে । আব্বার গজগজানি শুনতে হবে একটু বেশি করে, এই আর কি, ওটা কোনো ব্যাপার না । ” সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দুবোন মিলে গল্প করলাম । পুরনো দিনের কথা মনে করে কত যে হাসলাম আর কাঁদলাম, আর মাঝে মাঝে চাপা আতঙ্কে চুপ করে থাকলাম ।

রাতের নিরবতাকে ছাপিয়ে আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলো যেন কালকের দিনের অশুভ ইঙ্গিত । আপু পরের দিন সোয়েব ভাইয়ের সাথে এসেছিল ঠিকই । আব্বাও যথারীতি উনার গলার আওয়াজটা সপ্তমে চড়িয়ে যা নয় তা বলে গেলেন । সিনেমার মত বুকের বাঁ দিকটা খামচে ধরে বসে পড়লেন না , বরং টানা এক ঘণ্টা একনাগাড়ে চালিয়ে গেলেন । সব শেষে বললেন, “ দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষেছি এতদিন ।

ছোটগুলোকে আর নষ্ট করতে দিব না । তুই বেরিয়ে যা । এ বাসায় আর কোনোদিন আসবি না । ” আপু প্রচণ্ড কাঁদতে কাঁদতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল । এরপর কয়েকদিন যে আমি কিসের মধ্যে দিয়ে গেলাম , সেটা আর বলে বুঝাতে পারব না ।

আপু চলে যাওয়ার পর আব্বা একদিনও ওর নাম মুখে নেয়নি । প্রায় দুমাস হয়ে গেছে আপুর কোনো খোঁজ খবর নাই । বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মাথায় শুধু একবার ফোন করেছিল । সেদিন কেন জানি বার বার মনে হচ্ছিল আপু ফোন করবে । ঠিকই তাই, ফোন বাজতেই দৌড় দিয়ে গিয়ে ধরে দেখি আপু ।

বেশিক্ষন কথা বলতে পারিনি । আমরা যে ভাল আছি আর ঐদিকে আপুও যে ভাল আছে শুধু এইটুকু খবরই আদান প্রদান করতে পারলাম । আমার দৌড় দেখেই বোধহয় আব্বা এসে আমার হাত থেকে রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে ঠাস করে রেখে দিলেন । সেদিন থেকে আমার ফোন ধরা বারণ । আব্বার সাথে আমার খুব সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হত, শুধুমাত্র প্রয়োজনে মুখোমুখি হওয়া ।

আমার সমস্ত মনোযোগ তখন পড়াশুনার দিকে । ভর্তি পরীক্ষাগুলোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম । তবে এত মানসিক চাপে পড়াশুনাটা তেমন যুতসই হত না । বল্টু কোচিং করতো । মাঝে মাঝে এসে নোট দিয়ে যেত ।

একদিন হঠাৎ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আব্বা আমার ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন । জীবনের এই প্রথম আব্বা আমার ঘরে এলেন । আমি চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছি । কি বিষয় ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না । এমন সময় আব্বা খোলা জানালাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ সোহানা, তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো ।

তুমি তো বোঝো যে, তোমার বোন আমার মুখে যে চুনকালি মাখিয়েছে, তাতে আমার লোকসমাজে মুখ দেখাবার উপায় নাই । বিশেষ করে রাজিব আর তার বাবা মায়ের কাছে । আমার বন্ধু মানুষ , শখ করে নিজের একমাত্র ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এত লজ্জায় ফেলে দিল তোমার বোন । তো যাইহোক, আমি ভাবছি উনার কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে রাজিবের সাথে তোর বিয়ের কথাটা বলবো ।

তাও যদি আমার মুখ রক্ষা হয় । চোখের এক পলকের মধ্যেই আমার পুরো পৃথিবীটা যেন সব ভেঙ্গে চুড়ে ছারখার হয়ে গেল । ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বলতে পারছিলাম না । বুকটা ফেটে যাচ্ছিল । খুব জোরে জোরে শ্বাস পড়তে লাগলো ।

আব্বার দিকে তাকিয়েই রইলাম । বিস্ফোরিত দুচোখে আমার সমস্ত রাগ ক্ষোভ ঘৃণা যেন ফেটে বের হতে লাগলো । “কি করে পারলেন আব্বা ? আমি তো কিছু করিনি । আমার জীবনটা আপনে শেষ করে দিতে চান ?” কান্নার দমকটা চাপতে গিয়ে কথাগুলো আটকে আটকে যাচ্ছিল । দু চোখে দু ফোটা জল এসে পড়তে গিয়েও থেমে গেল, দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে উঠলো ।

আব্বা আমার দিকে একবারও তাকালেন না । চোখটা কেবল জানালা থেকে দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে বললেন “ আমি চাই না তুমি তোমার বোনের মত ভুল কর । ” বলেই গট গট করে হেটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন । আমি বালিশে মুখ চাপা দিয়ে চিৎকার করলাম । যত জোরে পারি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম ।

সব দোষ আম্মার । আম্মা কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল । আম্মা থাকলে আজ আমার এরকম হত না । আপুও স্বার্থপর , শুধু নিজের কথাটাই চিন্তা করলো । ওর জন্যই তো আজকে আমার এই অবস্থা ।

হাতের সামনে সব নোটগুলো রাগের চোটে ছিড়ে কুটি কুটি করে জানালার ফাক দিয়ে ফেলে দিলাম । হঠাৎ দেখি আটিস ওর জানালা দিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে । আমি কিছুক্ষন ওর দিকে নিস্পলক তাকিয়ে দেখলাম । কি আশ্চর্য , বাইরের মানুষের আমার প্রতি যতটুকু অনুভুতি আছে বাসার মানুষগুলোর ততটুকুও নাই । পরেরদিন বিকাল পাঁচটায় সেই আগের মত বল্টুরা সবাই এসে হাজির ।

আটিস বিপদের আঁচ পেয়েই সবাইকে খবর দিয়েছিল । ঘটনা শুনে সবাই কিছুক্ষন মুখ শুকনো করে বসে থাকল । কল্পনাতেও কেউ ভাবতে পারেনি । কি বলবে বুঝতে পারছিলনা । কারন আমার আব্বা কারোরই অপরিচিত না ।

আমার যে কোনো উপায় নাই, নিস্তার নাই এই থেকে তা সবাই জানে । তাও শেষে বল্টু বলল, “ দেখি । দেখি কি করা যায় । ” আমি একটু কাষ্ঠ হাসি হাসলাম । কিছুক্ষন পর আটিস ছাড়া সবাই চলে গেল ।

ও’ জিজ্ঞাসা করল, “ রোহু আপুকে খবর দিব ?” “ আপুকে ? আপুর খোজ জানো তুমি ? পরিক্ষা তো শেষ , কলেজে আসে ?” “ সোয়েব ভাইয়ের বন্ধু লিটন ভাই হোস্টেল ছাড়েনি । ঐখানে গিয়ে খোজ নিয়ে বের করতে পারি । ” একটু ভেবে বললাম , “ না থাক ” “ কেন?” মনে মনে ভাবলাম আপুও তো অনেকভাবে আমার খোঁজ নিতে পারতো । বর্ণাপুদের বাসায় ফোন করে আমাকে ডাকায় নিয়ে কথা বলতে পারতো । কই করেনি তো ।

বুকের মধ্যে এক দলা অভিমান পাকিয়ে উঠলো । বললাম, “ এমনি, থাক । ” “এই বিয়েটা তুমি করবেই ?” “ করতে তো হবেই, কি করব ?” “ ‘কি করব’ মানে ? ‘না’ করবে । ” “ লাভ নাই ” “ তাহলে এই শেষ । তুমি গিভ আপ করছো ?” “ হু করছি ” আটিস কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।

পরের দিন দুপুরবেলা ঢ্যাঙা বাসায় এল । বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ওকে । “কালকে আমরা চলে যাওয়ার পর তোর সাথে আটিসের কি কথা হয়েছিল রে ?” “ কেন ? এই বিয়ে নিয়েই কথা । আমি গিভ আপ করছি , এই সব আরকি । কেন কি হয়েছে ?” “ আর কিছু বলেনি ?” “ না, আর কি বলবে ? কেন ? কি হয়েছে ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ।

নিজের জ্বালায় বাঁচিনা আবার নতুন করে কি হল । “ কাল রাতে ও’ বাসায় ফিরেনি । ” “ হোস্টেলে গেছে হয়তো । ” “ না, হোস্টেলে তো থাকে শুধু পরিক্ষার আগে । তাছাড়া দারগা কাকু খোঁজ নিয়েছেন ।

হোস্টেলে নাই , টিউশনিতেও যায়নি । ” এবার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো , “ তাহলে? ” “ তাহলে আর কি তোর জন্যই তো এ অবস্থা । ” “ আমার জন্য? মানে ?” আকাশ থেকে পড়লাম, “ আমি তো আটিসকে কিছুই বলিনি । ” ঢ্যাঙা এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বলল “ না, তুই তো কিছুই বলিসনা , কিছু বুঝিসও না । তুই জানিস আটিসের ঘর ভরা যে শুধু তোর ছবি ।

ও’ যে তোকে কিরকম….. ” কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল । একটু চুপ থেকে বলল, “ আমি যে কিছু বলেছি বলিস না । ” বলেই দৌড় । ...........চলবে ১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।