আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাপুরুষের জবানবন্দি(পর্ব-১)

আমি খুব সাধারণ একজন। আমার অবুঝ মন। কি যেন চায় সারাক্ষণ। কখনো পায়,কখনো পায় না। ।

"চল পালিয়ে যাই। " "না পালাতে পারব না। " "কেন?" আমি নিরুত্তর। ফারজানা বিচলিত। "তাহলে ভালবাসি বলেছিলে কেন?" "ফারজানা ভালবাসার অর্থ এই নয় যে চোরের মত পালাতে হবে।

" "তাহলে বীরের মত একটা কিছু কর। " আমি নিরুত্তর। ফারজানা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,"তেলাপোকা দেখে ভয় পাও চুরির কথা বললে আবার নিতীকথা বল। চুরি ছাড়া তো তোমার উপায়ও নেই, না,না..উপায় তো তোমার আছেই উপায় নেই কেবল আমার। তোমার তো কিচ্ছু হবেনা।

যহবার আমার হবে। আমি মরে যাব......." "কি হয়েছে তোমার অপেক্ষা করনা আর কিছুটা সময়। " "তুমি জাননা আমি একটা মেয়ে মানুষ। আর মেয়ে মানুষ ইচ্ছে করলেই সব কিছু পারেনা। এত ভিতু কেন তুমি? তোমার শরীরে কি রক্ত মাংস নেই?তোমার শরীরে কি গণ্ডারের চামড়া?এত অপমান সহ্য করে কেন তুমি এখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাক?দুরে গিয়ে মরতে পারনা?" "ফারজানা তুমি তো জান,আমার মা‌‌‌‌ টা এ জগতে বড় দূঃখি।

আমি এ জগতে তার আর কেউ নেই। মাকে হারাতে পারব না। তারচে বরং তুমি আমাকে ভুলে যাও। " "কাপুরুষ! বাড়ি গিয়ে শাড়ি ব্লাউজ পড়ে বসে থকগে। যাও আমার সামনে থেকে।

" ঝরঝর করে কেদে ফেলল ফারজানা। তারপর হনহন করে হেটে চলে গেল। আমার দিকে আর তাকালোও না। গন্ধে মাতাল করা অসংখ্য ফুল ফোটানো কদম গাছটির নিচে দাড়িয়ে রইলাম একাকী। এই কদম গাছ আমাদের ভালবাসার সাক্ষী।

এই কদম গাছের নিচে দাড়িয়ে আমাদের প্রথম ভালবাসা বিনিময় হয়েছিল। আমি উপর দিকে তাকালাম। পাতার ফাকে ফাকে কদম ফুল। মনে হল ফুলেরা যেন হাসছে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে। সাধারণ হাসি নয়।

উপহাসের হাসি। দূঃখে আমার অন্তরটা ফেটে যেতে চাইলো। পাসের বাশবাগান থেকে একটা বাদুর ডানা ঝাপটিয়ে এসে ঝুলল কদম ডালে। একটা কদম গোটা পড়ল আমার মুখের উপর। মনে হল কদম গাছটি বিদ্রুপ স্বরুপ একটি ঢিল মেরে বলল, কাপুষ।

ফারজানাদের বাড়ি আমার জন্য নিষিদ্ধ। শুধু আমি না আমার ছায়াও নিষিদ্ধ। সেদিন সকালে বসে বসে আমি,ফারজানার ভাই দিপু ও ফারজানা লুডু খেলছিলাম। এমন সময় উপস্থিত হলেন ফারজানার বাবা। ভদ্রলোক আইন ব্যবসায়ী।

নামকরা উকিল। কথা বার্তা এবং চলাফেরায় বিরাট বিনয়ী ভাব। কিন্তু মন কুটিল বুদ্ধিতে ভরা। কেউ তার সঙ্গে লাগতে এলে আইনের প্যাচে ফেলে অবস্থা কাহিল করে দেন। তিনি অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে আমাকে বললেন,"এই ছেলে, তুমি উঠে এস।

" আমি বাধ্য ছেলের মত উঠে এলাম। "আসসালামু আলাইকুম। " তিনি সালামের জবাব না দিয়েই বললেন,"তোমাকে এই বাড়িতে রাখা হয়েছিল আমার ছেলেকে পড়ানোর জন্য,লুডু খেলার জন্য নয়। তাও যদি তুমি শুধু লুডু খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে তাহলেও তোমাকে ক্ষমা করা যেত। কিন্তু ইদানিং তুমি আমার মানসম্মান নিয়েও খেলা শুরু করেছ।

কাজেই তোমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এই মুহুর্তে তুমি আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। তোমার জন্য আমার বাড়ি নিষিদ্ধ। তোমার ছায়াও নিষিদ্ধ। আর তোমার বাবাকে বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে।

" মাথা নিচু করে কথাগুলো গিলছিলাম। মাথা নিচু করেই বললাম,"জি। " "আউট। ক্লিয়ার আউট। " দিপুকে বললেন,"তুমি আমার জন্য এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো।

" দিপু চলে গেলে ফারজানাকে ঘরের মধ্যে বাইরে থেকে তালা দিলেন্। আমি ক্লিয়ার আউট হয়ে গেলাম। সেদিন বাবাকে ডেকে হয়তো তিনি ভয় দেখালেন অথবা ধমক -ধামক অথবা অপমান করলেন। ফারজানার বাবা প্রতাপশালী। সে তুলনায় আমার বাবা অতি নগন্য।

কাজেই সব অপমান মুখ বুজে সহ্য করে তিনি বাড়িতে ফিরে এলেন। অপমানের জ্বালা আর যত রাগ ঝাড়লেন আমার উপর। ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা করার সুযোগ পেলাম না। প্রচণ্ড মার খেলাম বাবার হাতে। মা আপত্তি করলে তিনিও মার খেলেন।

এটা কোন ব্যাপার নয়। বাবার হাতের মার খাওয়া আমার এবং মার কাছে পান্তা ভাত। সেই ছোটবেলা থেকেই খেয়ে আসছি। কিন্তু আমার বাবা এখানেই থামলেন না। ঘর থেকে আমার সব বই খাতা এনে ফেললেন উঠানের ওপর।

তারপর কেরোসিন আর দেয়াশলাই এনে আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউ দাউ করে জ্বললো আগুন। বইগুলো যেন নয়,আমার কলিজাটা পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। আমি শুধু বোকার মত জ্বলন্ত আগুনের দিকে চেয়ে রইলাম। ছোবেলা থেকেই আমি কোনও স্বপ্ন দেখিনা।

আমার কোনও স্বপ্ন নেই। তবুও মনে হলো,আমার বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। আর দুই মাস পরে আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। আশা ছেড়ে দিলাম। কি হবে আর পড়ে? এত্তসব স্বত্তেও আমি ফারজানার বাবার কথা রাখতে পারিনি।

তবে ওদের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার সাহস আমার হয়নি। আমার ঠিকানা ওই কদম গাছ। ওদের ঘরের পেছনে একটা লাউমাচা,সরিষা,মুলা,ডাটা প্রভৃতি সবজির একটা ছোট বাগান। তার দশ কি পনের হাত দুরে কদম গাছটা। আমি ওখানে এলে ফারজানাও কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়।

আমি কতদিন ওকে না বলে এসে দেখেছি,কিছুক্ষণ পরে ও ঠিকই টিপটিপ পায়ে এসে হাজির হয়। "আমি এখানে এলে তুমি বোঝ কিভাবে?" "তোমার গায়ের গন্ধ পাই। " "ধুর,ধুর, আমার গায়ের আবার গন্ধ কি?" "সেটা আমি জানি তুমি বুঝবে না। " "মিথ্যা কথা। " "তাহলে বল তো আমি কিভাবে টের পাই।

" "তুমি সব সময় নজর রাখ এই জায়গাটার দিকে। " ফারজানাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে যে বড় রাস্তাটা তার এক কিলোমিটার পূর্বে আমাদের বাড়ি। ফারজানার বাবা আমার জন্য তার বাড়ি নিষিদ্ধ করার পর সন্ধার পর লুকিয়ে এভাবে ওই কদম গাছের নিচে ফারজানার সঙ্গে দেখা করি। পরে বাড়িতে ফিরে যাই। আজ আর বাড়িতে যেতে ভাল ইচ্ছ করছে না।

আমি বরং উল্টাদিকে হাটা ধরলাম। পশ্চিম দিকে খানিক এগুলেই নদী। জোৎস্না রাতে নদীর পাড়ে বসে নদীর পানি দেখতে কেমন লাগে! কেমন এক ঘোরলাগা অবস্থায় নদীর দিকে হেটে যেতে লাগলাম। রাস্তা ছেড়ে বিস্তির্ণ মাঠের মধ্যে নেমে পড়লাম। শস্যের মাঠ পেরিয়ে ধীরে ধীরে নদীর পাড়ে এসে পড়লাম।

ঘন দূর্বা ঘাসে কি সুন্দর বিছানা হয়ে আছে! মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পড়লাম। চাদ উঠেছে। পূর্ণ চাদ। জোৎস্না এসে পড়েছে নদীর বুকে। মৃদু বাতাসে পানিতে কাপুনি হচ্ছে।

চকমক করছে পানি। আমার মনে এসে দোলা লাগছে। ইশ! মনটা কেমন করে ওঠে। মনের অজান্তেই বলে ফেললাম কি সুন্দর! কি সুন্দর! নদী পাড়ের মদীর হাওয়ায় মন উতলা হলো আমার। মনে হলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মর্ত্যলোক থেকে ফিরে এসে গাইছেন,আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে... আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

কোথায় বসে গাইছেন?কোথায় বসে? রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। তিনি কি গাইতেনও। এটা আমার জানা নাই। তবুও মনে হলো তিনিই গাইছেন। স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানা।

স্রোত যেদিকে যায় কচুরিপানাও সেদিকে যায়। এর কোন নিজস্ব গতি নেই। এই যে আমি এখন এই মধ্যরাত্রিতে নদী পাড়ে বসে আছি এটা কি আমার ইচ্ছায়? যদি উত্তর না হয় তাহলে আমিও কি স্রোতের তোড়েই ভেসে চলছিনা?আমার কি নিজস্ব কোন গতি আছে? আকাশের দিকে তাকালাম। চাদ একা। আলো ছড়াচ্ছে পৃথিবীতে আর মিটি মিটি হাসছে।

আমি ও যদি কখনো এমন একা হয়ে যাই তাহলে কি আমি ও হাসতে পারবো?আমার মা‌‌‌‌‌‌ ও তো ওই চাদের মত একা। তাহলে তিনি কখনো হাসেন না কেন? সারা রাত ওভাবে বসে থেকে মনের মধ্যে নানা কল্পনা করে মনটাকে নোংরা স্টেশনে পরিণত করে ভোরবেলা নদীর জলে গোসল করে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। বাড়িতে গিয়ে টের পেলাম গত রাতে আমি আমার এই পৃথিবীর সেরা রত্নটিকে হারিয়েছি। মা প্রতি ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কোরান শরিফ নিয়ে বসেন। আজ ঘরে গিয়ে দে;খলাম মা শুয়ে আছেন।

কি ব্যাপার?মা কি তাহলে অসুস্থ?কপালে হাত রাখলাম। একি শরীর এত ঠাণ্ডা কেন? "মা,ও মা। " কোন সাড়া নেই। "মা,ওমা। শরীর খারাপ নাকি তোমার?ফজরের নামাজ পড়বা না? ওয়াক্ত চলে গেল যে।

" কাপড় বদলে এসে মায়ের পাশে বসলাম। একি হাত ও তো ঠাণ্ডা! "কাল রাতে আমি আসিনি বলে কি তুমি আমার উপরে রাগ করেছ?আমি জানি তুমি আমার জন্য চিন্তা করেছ মা। " যতই ডাকা ডাকি করি কোন সাড়া -শব্দ নেই। আসলেই তো নেই। নিঃশ্বাস ও তো পড়ছে না।

আমাদের উপর অভিমান করে আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিছুই করতে পারলাম না তার জন্য বড় অপদার্থ আমি। এই পৃথিবীতে আমাকে বোঝার জন্য ছিল দুজন মাত্র মানুষ। এজন মা। তিনি চলে গেলেন।

আর একজন ফারজানা। তাকেও পাবার আশা নেই। আর বাবা থেকেও নেই। অবশ্য তাকে আমি বাবা বলে স্বীকার ও করি না। তিনি আমার জন্মদাতা বাবা নন।

জন্ম দিলেই জন্মদাতা হওয়া যায় কিন্তু বাবা হওয়া যায় না। তাকে আমি বাবা বলে ডেকেছি বলেও আমার মনে হয়না। বাবার আলাদা সংসার আছে। তিনি সেখানে অ্যাকটিভ। চাকরানির মত দিন-রাত খেটেও আমার মা শেষ পর্যন্ত এ সংসারে টিকে থাকতে পারলেন না।

বাবার কাছে আমি এবং মা চতুর্থ বিষয়ের মত। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.