আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারিকেল মামা ----- হুমায়ূন আহমেদ

তাঁর আসল নাম আমার মনে নেই। আমরা ডাকতাম ‘নারকেল-মামা’। কারণ নারিকেল গাছে উঠে নারকেল পেড়ে আনার ব্যাপারে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। পায়ে দড়ি-টরি কিচ্ছু বাঁধতে হতো না। নিমিষের মধ্যে তিনি উঠে যেতেন।

নারকেল ছিঁড়তেন শুধু হাতে। তাঁর গাছে ওঠা, গাছ থেকে নামা, পুরো ব্যাপারটা ছিল দেখার মতো। তাঁর নৈপুণ্য যে কোনো পর্যায়ে তা দেখাবার জন্যই একদিন আমাকে বললেন, এই পিঠে ওঠ। শক্ত কইরা গলা চাইপা ধর। আমি তাই করলাম।

তিনি আমাকে নিয়ে তরতর করে নারকেল গাছের মগডালে উঠে দুই হাত ছেড়ে নানা কায়দা দেখাতে লাগলেন। ভয়ে আমার রক্ত জমে গেল। খবর পেয়ে আমার নানাজান ছুটে এলেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হারামজাদা, নেমে আয়। এই হচ্ছেন আমাদের নারিকেল-মামা।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক নেই। নানার বাড়ির সব ছেলেরাই যেমন মামা, ইনিও মামা। আমার নানার বাড়িতে কামলা খাটেন। নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ। খুব গরম পড়লে মাথা খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়।

কিংবা কে জানে মাথা হয়ত তাঁর সব সময়ই এলোমেলো। শুধু গরমের সময় অন্যরা তা বুঝতে পারে। নারিকেল-মামার মাথা এলোমেলো হবার প্রধান লক্ষণ হলো_ হঠাৎ তাঁকে দেখা যাবে গোয়ালঘর থেকে দড়ি বের করে হনহন করে যাচ্ছেন। পথে কারো সঙ্গে দেখা হলো, সে জিজ্ঞেস করল, কই যাস? নারিকেল-মামা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলবেন, ফাঁস নিব। উঁচা লম্বা একটা গাছ দেইখ্যা ঝুইল্যা পড়ব।

প্রশ্নকর্তা তাতে বিশেষ বিচলিত হয় না। বিচলিত হবার তেমন কারণ নেই। এই দৃশ্য তার কাছে নতুন নয়। আগেও দেখেছে। একবার না, অনেকবার দেখেছে।

প্রশ্নকর্তা শুধু বলে, আচ্ছা যা। একবার জিজ্ঞেসও করে না, ফাঁস নেবার ইচ্ছেটা কেন হলো। তাঁর আত্মহননের ইচ্ছা তুচ্ছ সব কারণে হয়। তাঁকে খেতে দেয়া হয়েছে। ভাত-তরকারি সবই দেয়া হয়েছে।

কিন্তু লবণ দিতে ভুলে গেছে। তিনি লবণ চেয়েছেন। যে ভাত দিচ্ছে সে হয়ত শুনেনি। তিনি শান্তমুখে খাওয়া শেষ করলেন। পানি খেলেন।

পান মুখে দিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে গেলেন দড়ির খোঁজে। এই হলো ব্যাপার। সবই আমার শোনা কথা। আমরা বছরে একবার ছুটির সময় নানার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। থাকতাম দশ-পনেরো দিন।

এই সময়ের মধ্যে নারিকেল-মামার দড়ি নিয়ে ছোটাছুটির দৃশ্য দেখিনি। তাঁকে আমার মনে হয়েছে অতি ভালো একজন মানুষ। আমাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় তাঁর কোনো সীমা ছিল না। একটা গল্পই তিনি সম্ভবত জানতেন। সেই গল্পই আমাদের শোনাবার জন্য তাঁর ব্যস্ততার সীমা ছিল না।

কাঁইক্যা মাছের গল্প। এক দীঘিতে একই কাঁইক্যা মাছ বাস করত। সেই দীঘির পাড়ে ছিল একটা চাইলতা গাছ। একদিন কাঁইক্যা মাছ চাইলতা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ একটা চাইলতা তার গায়ে পড়ল।

সে দারুণ বিরক্ত হয়ে বলল, চাইলতার চাইলতা তুই যে আমার মাইলি? উত্তরে চাইলতা বলল, কাঁইক্যারে কাঁইক্যা, তুই যে আমার কাছে আইলি? এই হলো গল্প। কেনই-বা এটা একটা গল্প, এর মানে কি আমি কিছুই জানি না। কিন্তু এই গল্প বলতে গিয়ে হাসতে হাসতে নারিকেল-মামার চোখে পানি এসে যেত। আমি তাঁর কাছে এই গল্প বারবার শুনতে চাইতাম তাঁর কা-কারখানা দেখার জন্য। সেবার রোজার ছুটিতে নানার বাড়িতে গিয়েছি।

তখন রোজা হতো গরমের সময়। প্রচ- গরম। পুকুরে দাপাদাপি করে অনেকক্ষণ কাটাই। আমরা কেউই সাঁতার জানি না। নারিকেল-মামাকে পুকুর পাড়ে বসিয়ে রাখা হয় যাতে তিনি আমাদের দিকে লক্ষ্য রাখেন।

তিনি চোখ-কান খোলা রেখে মূর্তির মতো বসে থাকেন। একদিন এইভাবে বসে আছেন। আমরা মহানন্দে পানিতে ঝাঁপাচ্ছি, হঠাৎ শুনি বড়দের কোলাহল_ ফাঁস নিছে। ফাঁস নিছে। পানি ছেড়ে উঠে এলাম।

নারিকেল-মামা নাকি ফাঁস নিয়েছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। নানার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে জামগাছের ডালে দড়ি হাতে নারিকেল-মামা বসে আছেন। দড়ির একপ্রান্ত জামগাছের ডালের সঙ্গে বাঁধা। অন্য প্রান্ত তিনি তাঁর গলায় বেঁধেছেন।

তিনি ঘোড়ায় চড়ার মতো ডালের দু’দিকে পা দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসে আছেন। আমরা ছোটরা খুব মজা পাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লোক দড়িতে ঝুলে মরবে, সেই দৃশ্য দেখতে পাব_ এটা সে সময় আমাদের মধ্যে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। বড়রা অবশ্যি ব্যাপারটাকে মোটেও পাত্তা দিল না। আমার নানাজান বললেন, আজ গরমটা অতিরিক্ত পড়েছে।

মাথায় রক্ত উঠে গেছে। তিনি নারিকেল-মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাম হারামজাদা! নাকিকেল-মামা বিনীত গলায় বললেন, ‘জ্বে না মামুজী। ফাঁস নিমু। ’ ‘তোরে মাইরা আজ হাড্ডি গুঁড়া করব। খেলা পাইছস? দুইদিন পরে পরে ফাঁস নেওয়া।

ফাঁস অত সস্তা। রাখছস?” ‘রাখছি। ’ ‘রোজা রাইখ্যা যে ফাঁস নেওন যায় না এইটা জানস?’ ‘জ্বে না। ’ ‘নাইম্যা আয়। ফাঁস নিতে চাস ইফতারের পরে নিবি।

অসুবিধা কি? দড়িও তোর কাছে আছে। জাম গাছও আছে। নাম কইলাম। রোজা রাইখ্যা ফাঁস নিতে যায়! কত বড় সাহস! নাম। ’ নারিকেল-মামা সুড়সুড় করে নেমে এলেন।

মোটেও দেরি করলেন না। আমাদের মন কি যে খারাপ হলো। মজার একটা দৃশ্য নানাজানের কারণে দেখা হলো না। নানাজনের ওপর রাগে গা জ্বলতে লাগল। মনে ক্ষীণ আশা, ইফতারের পর যদি নারিকেল-মামা আবার ফাঁস নিতে যান।

ইফতারের পরও কিছু হলো না। খাওয়া-দাওয়ার পর নারিকেল-মামা হৃষ্টচিত্তে ঘুড়ে বেড়াতে লাগলেন। কোত্থেকে যেন একটা লাঠিম জোগাড় করলেন। শহর থেকে আসা বাচ্চাদের খুশি করার জন্যে উঠোনে লাঠিম খেলার ব্যবস্থা হলো। আমি এক ফাঁকে বলেই ফেললাম, মামা, ফাঁস নিবেন না? তিনি উদাস গলায় বললেন, যাউক, রমজান মাসটা যাউক।

এই মাসে ফাঁস নেয়া ঠিক না। ‘রমজানের পরে তো আমরা থাকব না। চলে যাব। আমরা দেখতে পারব না। ’ নারিকেল-মামা উদাস গলায় বললেন, এইসব দেখা ভালো না গো ভাইগ্ন্যা ব্যাটা।

জিহ্বা বাইর হইয়া যায়। চউখ বাইর হইয়া যায়। বড়ই ভয়ঙ্কর। ‘আপনি দেখছেন?’ ‘ভাইগ্ন্যা ব্যাটা কি কয়? আমি দেখব না! একটা ফাঁসের মরা নিজের হাতে দড়ি কাইট্যা নামাইছি। নামাইয়া শইল্যে হাত দিয়ে দেখি তখনও শইল গরম।

তখনও জান ভেতরে রইছে। পুরোপুরি কবজ হয় নাই। ’ ‘হয়নি কেন?’ ‘মেয়েছেলে ছিল। ঠিকমত ফাঁস নিতে পারে নাই। শাড়ি পেঁচাইয়া কি ফাঁস হয়? নিয়ম আছে না? সবকিছুর নিয়ম আছে।

লম্পা একটা দড়ি নিবা। যত লম্বা হয় তত ভালো। দড়ি এক মাথা বানবা গাছের ডালে, আরেক মাথা নিজের গলায়। ফাঁস গিট্টু বইল্যা একটা গিট্টু আছে। এটাই দিবা।

তারপরে আল্লাহর কাছে তওবা কইরা সব গোনার জন্যে মাফ নিবা। তারপর চউখ বন্ধ কইরা দিবা লাফ। ’ ‘দরি যদি বেশি লম্বা হয় তাহলে তো লাফ দিলে মাটিতে এসে পড়বেন। ’ ‘মাপমত দড়ি নিবা। তোমার পা যদি মাটি থাইক্যা এক ইঞ্চি উপরেও থাকে তাইলে হবে।

দড়ি লম্বা হইলে নানা দিক দিয়া লাভ। দশের উপকার। দড়ি লম্বা হলে দশের উপকার কেন তারও নারিকেল-মামা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন। ‘ফাঁসের দড়ি নানা কাজে লাগে বুঝলা ভাইগ্ন্যা ব্যাটা? এই দড়ি সোনারর দড়ি চেয়েও দামী। এক টুকরা কাইট্যা যদি কোমরে বাইন্ধ্যা থয় তা হইলে বাত-ব্যাধির আরাম হয়।

ঘরের দরজার সামনে এক টুকরা বাইন্ধ্যা থুইলে ঘরে চোর-ডাকাত ঢোকে না। এই দড়ি সন্তান প্রসবের সময় খুব কাজে লাগে। ধর, সন্তান প্রসব হইতেছে না_ দড়ি আইন্যা পেটে ছুঁইয়াইবা, সাথে সাথে সন্তান খালাস। ’ ‘সত্যি?’ ‘হ্যাঁ সত্যি। ফাঁসির দড়ি মহামূল্যবান।

অনেক ছোট ছোট পুলাপান আছে বিছানায় পেসাব কইরা দেয়। ফাঁসের দড়ি এক টুকরা ঘুনসির সাথে বাইন্ধ্যা দিলে আর বিছানায় পেসাব করব না। এই জন্যেই বলতেছি যত লম্বা হয় ফাঁসের দড়ি ততই ভালো। দশজনের উপকার। ফাঁস নিলে পাপ হয়।

আবার ফাঁসের দড়ি দশজনের কাজে লাগে বইল্যা পাপ কাটা যায়। দড়ি যত লম্বা হইব পাপ তত বেশি কাটা যাইব। এইটাই হইল ঘটনা। মৃত্যুর পরে পরেই বেহেশতে দাখিল। নারিকেল-মামার মৃত্যু হয় পরিণত বয়সে।

ফাঁস নিয়ে না_ বিছানায় শুয়ে। শেষ জীবনে পক্ষাঘাত হয়েছিল, নড়তে-চড়তে পারতেন না। চামচ দিয়ে খাইয়ে দিতে হতো। মৃত্যুর আগে গভীর বিষাদের সঙ্গে বলেছিলেন_ আল্লাহপাক আমার কোন আশা পূরণ করে নাই। ঘর দেয় নাই, সংসার দেয় নাই।

কিছুই দেয় নাই। ফাঁস নিয়া মরণের ইচ্ছা ছিল এটাও হইল না। বড়ই আফসোস! (সংকলিত) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.