আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শরিয়া আইন; মোহ ও বাস্তবতা। (পর্ব-১)

হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র

শরিয়া আইন হলো সেই আইন যেই আইন মধ্যযুগের বিগত সময়ের আরব দুনিয়ার এক আধিভৌতিক ছায়ার মত টিকে আছে অজ্ঞতা আর মোহের উপর ভর করে। বাঙালি মুসলমানের জীবনে এই আইনের তেমন কোন প্রভাব নাই, এই আইন সন্বন্ধে বাঙালি মুসলমানের খুব একটা ধারণাও নাই। কিন্তু অজ্ঞতাপ্রসূত মধ্যবিত্ত্ব বাঙালি মুসলমানের মনে এই আইনের প্রতি একধরণের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় বরাবরি কাজ করে চলে। আর এই অজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভয়এর উপর ভর করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের গণতন্ত্রিক সার্বভৌমত্ত্বের প্রতি, সংবিধানের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দেয় স্বার্থান্বেসী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। দুর্বল এবং সংখ্যালঘিষ্ঠের ওপর অত্যাচার আর শোষনের ধর্মনিষ্ঠ হাতিয়ার এই শরিয়া আইন, নির্বাচনী জনমত গড়ে তোলা অথবা পরিবর্তিত করার স্বস্তা হাতিয়ার এই শরিয়া আইন, বাংলাদেশের মানুষকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে বিভক্ত করার অন্যতম অস্ত্র এই শরিয়া আইন।

আগেই উল্লেখ করেছি যে শরিয়া আইন এখনো টিকে আছে অথবা এই নিয়া এখনো মুসলমানের সাথে মুসলমানের, কিংবা মুসলমানের সাথে নাস্তিকের যেই বিতর্ক হয়, তার পেছনে কারন শরিয়া আইন সম্পর্কে আধুনিক মুসলমানের অজ্ঞতা মাত্র। বেশীরভাগ বাঙালি মুসলমান বিশ্বাস করে যে শরিয়া আইন হলো আল্লাহর দেয়া সর্বকালের সর্বস্থানের জন্য প্রযোজ্য সর্বশ্রেষ্ঠ আইন। মজার ব্যাপার হলো এই আইনগসমূহ, আইনএর ইতিহাস এবং প্রয়োগপদ্ধতি নিয়া কোনরকম ধারণা ছাড়াই এইসব ধারণা পোষন করে বেশিরভাগ আধুনিক বাঙালি মুসলমান। আমার সর্বশেষ পোস্টে এবং রিপেনডিলএর করা এই পোস্টে শরিয়া আইন বিষয়ে সাধারণ মুসলমানের অজ্ঞতা বেশ পরিস্কার ভাবেই চোখে পরেছে। শারীরিক অসুস্থ্যতা এবং ব্যক্তিগত ব্যস্ততা হেতু রিপেনডিলএর পোস্টে আমি আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি নাই, আমার আলোচনা যেইখানে শেষ করেছিলাম, সেইখান থেকে আবার শুরু করতে গিয়ে দেখলাম যে অনেক মন্তব্য পরে গেছে, সেই সাথে আলোচনাও বেশ বিক্ষিপ্ত।

তাই নতুন পোস্ট দেয়াই মনসস্থির করলাম। রিপেনডিল, সার্জন এবং আরো কেউ কেউ ব্লগে, এবং এরা ছারাও ব্লগে অনেককেই বলতে শুনেছি যে যুগের প্রয়োজনে ইজমা কিয়াসের প্রয়োগের মাধ্যমে অনেক আইন হয়ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা নতুন আইনের সৃষ্ঠি করা যেতে পারে, তবে তা কখনোই কোরআন সুন্নাহর পরিপন্থী হতে পারবেনা। আদতে, এইটা একটা স্ববিরোধী কথা। কারণ, আগের আইন এখন কার্যকর মনে না করলেই সেইটা পরিবর্তনের প্রশঙ্গ আসে, এবং নতুন আইন সেইক্ষেত্রে আগের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি বিক্ষিপ্ত আলোচনা না করে বরং শরিয়া আইনএর নানাদিক এবং বর্তমান সময়ের এর অনুপযোগিতার কিছু উদাহরণ তুলে ধরবো মাত্র।

তবে আমার আলচনার মূল জায়গা হবে শরিয়া আইনএর ইতিহাস। কারণ সাম্প্রতিক বিতর্কে ইজমা কিয়াসএর প্রয়োগ এবং কোরআন সুন্নাহর সাথে তার সহাবস্থান নিয়া যেই প্রশ্ন আমি উত্থাপন করতে চেয়েছিলাম তা শরিয়া আইনএর ইতিহাস বিশ্লেষন ছাড়া উত্থাপন করা সম্ভব হবে না। শরিয়া আইনের ইতিহাস না বুঝলে শরিয়া আইন সম্বন্ধে প্রচলিত অজ্ঞতাও দুর হওয়া সম্ভব হবে না। শরিয়া আইন বিশ্লেষনের আলোচনায় হাদিস শাস্ত্রই আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু, কোরআন না। কোরআন মানে শরিয়া না।

কোরআন মুসলমানদের প্রধান ধর্মপুস্তক, এই পুস্তক মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী খোদ ইশ্বরের বাণী। কিন্তু ইসলামী শরিয়ত বলে যা পরিচিত তাতে কোরআনের চেয়ে হাদিসের প্রাধান্য অনেক বেশি। এর কারন, কোরআন আলাদাভাবে কোন আইন পুস্তক না, এতে আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ, ঘটনা প্রবাহ, আগের আমলের কাহিনী, সৃষ্ঠিতত্ত্ব ইত্যাদি বহুকিছুর সন্যিবেশ আছে, আইন বিষয়ে পরিস্কার নির্দেশ এই পুস্তকে কম। দ্বিতীয়ত, কোরআন আইনের মূখ্য উৎস হিসেবে কিভাবে ব্যাবহৃত হবে সেইটাও হাদিস শাস্ত্র অনুযায়ী নির্ধারিত। কোরআনের কোন আয়াতের কি অর্থ, এতে কি কি শরিয়তী সুস্পষ্ট আইন আছে, এর প্রয়োগ কিভাবে করা যায় এইসবই হাদিস শাস্ত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত।

শরিয়া আইনের বড় অংশই যেখানে হাদিসএর সংকলন থেকে প্রাপ্ত, সেইখানে এই হাদিসগুলো বিস্তারিত পাঠ না করলে এই আইন সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া সম্ভব না। আমাদের সময়ে আমরা এই হাদিসের পাঠ করি মূলত আধুনিকতার সাথে খাপ খাওয়ানোর মানসে লিখিত রচনা পাঠ করার মধ্য দিয়া। আধুনিক পূজিবাদী দুনিয়া একধরণের গণতান্ত্রিক মানবতাবাদের প্রচার করে। জাতীয়তাবাদ, বর্ণভেদ, অসাম্প্রদায়িকতা, দাসপ্রথা বিরোধীতা, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি আধুনিক নৈতিকতা আমাদের সময়ে প্রভাবশালী। আর ইসলামী শরিয়ার আধুনিকতাবাদী বিশ্লেষকরা এইসব মতের সাথে মিল খায় এমন হাদিস নির্বাচন করে যেইসব রচনা তৈরি করেন তার উপর নির্ভর করেই তৈরি হয় আমাদের শরিয়া বিষয়ক অজ্ঞতাপ্রসূত মোহ অথবা ভ্রম।

অন্যদিকে আধুনিকতার সাথে একেবারেই খাপ খায়না এইরকম হাদিসগুলা যখন কেউ খুড়ে বের করে আনে তখনই এইসব হাদিস নিয়া একধরণের এপোলেজস্টিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন মোহাক্রান্ত মুসলমানেরা। হাদিস শাস্ত্রের দুর্বলতাঃ হাদিস শাস্ত্রের পেছনে দিন কয়েক সময় দিলেই হাদিস শাস্ত্রের অন্তর্নিহীত নানান দুর্বলতা চোখে পরতে বাধ্য। নৈতিকতা ও আইন বিষয়ক বহু হাদিসই বর্তমান সময়ে অপ্রাসঙ্গিক অথবা বর্বর হিসাবে স্বিকৃত হবে, খুজে পাওয়া যাবে প্রচুর পরিমান পুরাপুরি বিপরীত বক্তব্য সমৃদ্ধ পরস্পর বিরোধী হাদিস, কিছু আবার কোরআনের সাথেই খাপ খায়না, আবার অযৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ হাদিসের সংখ্যাও নেহায়েত কম না। আমি নিচে এর ছোটখাটো একটা তালিকা দিলাম, হাদিস কপি পেস্ট করে পোস্টটা বেশি বড় করারও ইচ্ছা নাই। কারো প্রশ্ন থাকলে মন্তব্যের ঘরে লিংক অথবা হাদিস উল্লেখ করা যাবে।

১। স্ববিরোধীঃ পরস্পরবিরোধী দাবি সর্বস্ব হাদিসএর অভাব নাই। বুখারি শরীফে যা আছে মুসলিমে আছে তার পুরা উলটা, আবার এমনকি এক সংকলনেই পুরাপুরি বিপরীতমুখী হাদিসও কম না। মুসলমান মাত্রই বেহেশতে যাবে কি না, কবিরা গুনাহ মাফ হবে কি না, ইমান থাকলেই বেহেশত পাওয়া যাবে কি না, রোজার মাসে স্ত্রীকে চুম্বন করা যাবে কি না, পশ্চিম দিকে ফিরে মল মূত্র ত্যাগ করা, দাঁড়িয়ে পানি পান করা, টাকনুর উপর কাপর পরা, মৃত পশুর চামড়ার ব্যবহার ইত্যাদি বহু বিষয়ে সম্পুর্ন ভিন্ন ধরণের হাদিস আছে। এমন হাদিস আছে যাতে বলা হয়েছে বিন্দুমাত্র গুনাহ থাকলে বেহেশতে যাওয়া যাবেনা, আবার কোন হাদিস বলে যে কলেমা পড়া মুমিন মাত্রই বেহেশতে যাবে।

এক হাদিস বলে যে রোজার মাসে স্ত্রীকে চুম্বন করলে রোজ়া শেষ, আবার আরেক হাদিসে আছে যে মোহাম্মদ নিজেই রোজা রেখে স্ত্রীকে চুম্বন করেছেন। এক হাদিসে আছে দাঁড়িয়ে মুত্র ত্যাগ করা নিষেধ তো আরেক হাদিসে আছে যে মোহাম্মদ নিজেই দাঁড়িয়ে মুত্র ত্যাগ করেছেন। একি সংকলনের এক হাদিসে আছে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে মোহাম্মদ নিষেধ করেছেন আবার আরেক হাদিসে আছে মোহাম্মদ দাঁড়িয়ে পানি পান করছেন। এইরকম বহুবিধ স্ববিরোধীতার আখড়া হলো হাদিস শাস্ত্র। এহেন সবিরোধী গ্রন্থ এবং আইনশাস্ত্রের উপর ভরসা রাখা কঠিন বটে।

বিদায় হজ্জএর ভাষন বিষয়ক হাদিসে যেখানে বলা আছে যে কোরআনের সাথে সাথে মুসলমানদের নবির সুন্নাহও আকড়ে ধরে রাখতে হবে সেইখানে এক হাদিসে আছে যে মোহাম্মদ উপদেশ দিচ্ছেন, ধর্ম বিষয়ে তাকে অনুসরণ করলেও বস্তুগত বিষয়ে মুসলমানদের নিজ বিচার বুদ্ধি কাজে লাগাতে। ২। অবৈজ্ঞানিকঃ এমন হাদিস আছে যা পরলে মনে হয় যে দুনিয়া সমতল, আর চন্দ্র সূর্য এর চারদিকে ঘুড়ছে। কিছু হাদিস দাবি করে যে মধু নাকি সর্ব রোগের মহা ঔষধ। এক হাদিসে আছে যে যৌন মিলনের সময় পিতা বা মাতা যার অর্গাজম আগে হবে সন্তান দেখতে না কি তার মতো হবে।

কিছু হাদিস দাবি করে যে মেয়েরা জন্মগত ভাবেই পুরুষের চেয় কম জ্ঞানের অধিকারী। এক হাদিসে আছে যে যৌন মিলনের সময় নারীর যৌনাঙ্গ দেখলে নাকি অন্ধত্ব হয়। জ্বীন, দাজ্জাল এবং আগের আমলের নবি রাসুল বিষয়ক আজগুবি কেচ্ছা কাহিনীর অভাব নাই হাদিস শাস্ত্রে। অবৈজ্ঞানিক তথ্যসমৃদ্ধ হাদিসের অভাব নাই হাদিস সংকলনগুলোতে। এইসব হাদিস কিভাবে আধুনিক নৈতিক অথবা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উৎস হতে পারে তা সুস্থ্য মস্তিস্কে অনুধাবন করা সম্ভব না।

৩। সমসাময়ীক বাস্তবতায় অনুপযুক্তঃ হাদিস শাস্ত্রে নারীকে পুরুষের তুলনায় স্বভাবগতভাবে জ্ঞান ও ধর্মে অর্ধেক বলে গণ্য করা হয়েছে। নারী অন্যকোন ধর্মের মানুষের নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। হাদিসে যুদ্ধবন্দির সাথে যৌনতা জায়েজ করা হয়েছে। হাদিস বর্ণিত শাস্তির বিধান অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান যুগ বিচারে নিষ্ঠুর এবং বর্বর।

চুরির অপরাধে হাত কাটা, বিবাহ বহির্ভুত যৌন মিলনের অপরাধে দোররা মারা অথবা মাটিতে পুতে পাথর ছুড়ে হত্যা করা, বেশকিছু অপরাধের শাস্তি হিসাবে হাত পা কেটে ফেলে রাখা যেনো রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়, ইত্যাদি চিন্তা ভাবনা এবং আইন বর্তমান সময়ের নৈতিক বাস্তবতার সাথে যেমন খাপ খায়না, তেমনি অনুপযুক্তও বটে। এহেন বহু বিষয়ে হাদিসের নানাবিধ খুৎ খুজে বের করা যাবে। সাধারণত এইসব খুৎ আমাদের সামনে তখনি আসে যখন ফতোয়া আইন প্রয়োগ করে গ্রাম গঞ্জের কোন ক্ষমথাধর ফায়দা লোটে, যখন সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি দখল করা হয় ধর্মের নামে, যখন শরিয়াপন্থীরা বাউলদের চুল দাড়ি কেটে দেয়, যখন আমিনীর মতো ধর্ম ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের সাংবিধানীক আইন এবং এদেশীয় জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় এবং মূল্যবোধকে প্রশ্ন করে। অজ্ঞতা এবং মোহ বশত এই খুতগুলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এরিয়ে যাই। হাদিস সংকলন ও শরিয়া আইনএর ইতিহাসঃ মধ্যযুগে লিখিত হওয়ায় অবৈজ্ঞানিক হাদিসএর অস্তিত্ব যেমন খুবি স্বাভাবিক তেমনি মধ্যযুগীয় বহু নৈতিক ধারণাই যে আমাদের সময়ের চিন্তা ভাবনার সাথে খাপ না খাওয়াটাই স্বাভাবিক।

তবে হাদিস শাস্ত্রের এইরকম বহুবিধ স্ববিরোধীতা এবং লজ্জাজনক বৈচিত্র কিভাবে গড়ে উঠলো তা বোঝার জন্য হাদিস সংকলনের ইতিহাস বোঝাটা এবং এর সাথে সাথে ইসলামী শরিয়া কিভাবে পরিবর্তিত হলো তা বোঝাটা বেশ জরুরি। হাদিস বলতে বোঝায় ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদের আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, আচরণ, অন্য কারো কোন কাজ বা স্বিদ্ধান্তে সমর্থন ইত্যাদি। হাদিস সংকলন কোন জীবনী না হলেও এর আলোচ্য বিষয় মোহাম্মদের জীবন। মোহাম্মদএর সবচেয়ে পুরনো যেই জীবনীগ্রন্থের কথা জানা যায় তাও লিখিত হয়েছিল তার মৃত্যুর প্রায় দেড়শ বছর পর, বাকি গ্রন্থগুলা দুইশ/আড়াইশ বছর পর। হাদিস সংকলনগুলাও লিখিত হয়েছিল মোহাম্মদএর মৃত্যুর আড়াইশ/তিনশ বছর পর।

এই গ্রন্থগুলায় কতটুকু সত্য কাহিনী লেখা আছে তা নিশ্চিত করা সম্ভব না। তবে এতটুকু পরিস্কার যে, শরিয়াহ বলতে এখন আমরা যেই সুসংবদ্ধ কোরআন এবং হাদিসএর ধারণা পাই তা চিরকাল এমন ছিলনা, মোহাম্মদের জীবনী এবং তার কর্মেরও বহু বিভিন্ন আলাদা আলাদা বিবরণ ছিল। হাদিস সংকলনের কাহিনী বোঝার আগে যা বোঝা দরকার তা হলো যে হাদিস সংকলনগুলো লেখার আগে লক্ষ লক্ষ হাদিসএর অস্তিত্ব ছিল। অন্তত ৪০টা হাদিসএর ব্যাক্তিগত সংকলন ছিল বেশিরভাগ মুসলমানেরই। এর পেছনে কারণ খুব সম্ভবত ৪০টা হাদিস জানা থাকলে আলেম হওয়া যাবে এবং বেহেশতে যাওয়া যাবে এই ধরণের বিশ্বাস, এই বিষয়ে একটা হাদিস আছে।

ইহুদিরা জ্বাল হাদিস তৈরি করেছে এইরকম কন্সপাইরেসি থিওরী হাদিস সংকলনের সমকালে বেশ প্রচলিত ছিল। আদতে, নানান রকম হাদিস তৈরি হওয়ার বাস্তব কারণ বুঝতে গেলে কিছু ঘটনা ঘাটলেই খানিকটা আচ করা সম্ভব হবে। যেমন নারী নেতৃত্ব হারাম এই হাদিসটা যিনি প্রথম বর্ণনা করেছিলেন তিনি আয়েশার বাহিনী থেকে পলায়নের বিচারের সময় নিজের জীবন বাঁচাতে এই হাদিস বর্ণনা করেন। আর তাছারা মুখে মুখে ছড়ানো কাহিনী বা আইনএর কোন গাছ পাথর নাই, মোহাম্মদের জীবন এবং কর্মের তাই লক্ষ লক্ষ নানামুখি কাহিনী তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছুনা। প্রথম সবচেয়ে বিখ্যাত হাদিস সংকলক ইমাম বুখারি তার বুখারি শরীফ রচনার সময় প্রায় কয়েক লক্ষ হাদিস মিথ্যা গণ্য করে পুড়িয়ে দেন।

এত সতর্কতা সত্ত্বেও খোদ মুসলমান আলেমরাই বুখারি শরীফএর অনেক হাদিসকে জান্নি হাদিস বা দুর্বল হাদিস বলে গণ্য করেন, অর্থাৎ এই হাদিসগুলা ভুল বা মিথ্যা হওয়ার সুযোগ আছে। আর আধুনিক জ্ঞান বুদ্ধি ও চোখ দিয়া বিচার করলে এইসব জান্নি হাদিসের বাইরেও আরো বহু বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় ভুলভাল অথবা বর্তমান যুগে অচল হদিসএর খোজ পাওয়া যাবে। সিয়া এবং সুন্নি হাদিস সংকলন আবার এক না। সুন্নিরা যেখানে ছিহাহ সিত্তাকে সবচেয়ে শুদ্ধ হাদিস সংকলন বলে গণ্য করে সিয়ারা সেইখানে একেবারেই ভিন্ন এক কিছু সংকলনের অনুসরণ করে। এই ছয়টা গ্রন্থও হুট করে ইসলামী শরিয়ায় গুরত্বপুর্ন হয়ে ওঠে নাই, এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে।

এমনকি ইসলামী শরিয়াহ শুরুর দিকে খুব একটা হাদিস নির্ভরও ছিলনা। সবচেয়ে পুরনো সুন্নি মাজহাব হানাফি মাজহাবে ইজতিহাদ তথা ইজমা কিয়াসএর গুরুত্ব অনেক, এই মাজহাব শুরুর দিকে একেবারেই কট্টোর হাদিস পন্থী ছিলনা। উল্লেখ্য, হানাফি মাজহাব যখন সৃষ্ঠি হয়েছে তখন পর্যন্ত কোন ছিহাহ সিত্তার কোন হাদিস সংকলন লিখিতই হয় নাই। অন্যদিকে সর্বশেষ সুন্নি মাজহাব হাম্বল্লি মাজহাবের আবির্ভাব ছিহাহ সিত্তার সবগুলো সংকলন লিখিত হওয়ার পর। হাম্বলি সুন্নি মত প্রবলভাবে হাদিসপন্থী এবং ইজতিহাদ তথা ইজমা কিয়াসএর ব্যবহারকে পুরাপুরি অস্বিকার করে।

হানাফি থেকে হাম্বলি মাজহাব আবির্ভাব পর্যন্ত ইসলামী শরিয়তের বিকাশ, হাদিস নির্ভরতা এবং তারপরে এর অপরিবর্তনীয় অলঙ্ঘনিয় রূপে আত্মপ্রকাশের ইতিহাস খুবি বৈচিত্রময়। এই লেখার পরবর্তি পর্বে হাদিস সংকলন এবং ইসলামী শরিয়তের বিকাশ নিয়া বিস্তারিত আলোচনা করার আশা রাখি।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.