আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।
(তখন আমাদের কৈশোর। সময় আর জীবনকে ভাঙ্গার প্রতিযোগিতায়-সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। হুট করে চলে যাই অচেনা লোকাল বাসে চড়ে নতুন কোন রাস্তায়।
তারপর কিছু না ভেবেই নেমে পড়ি দুঃখী দুঃখী চেহারার কোন চায়ের দোকানে। সেখানে বসে মানুষ দেখি, বৃষ্টি দেখি, আর দেখি সময়। নিজের ভেতরের অনুসন্ধিৎসু মনটাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনি-ভেঙ্গে ফেলি, আবার জোড়া লাগাই। দলবেঁধে হেঁটে চলি মাইলের পর মাইল। রাস্তা ভুলে গাঁয়ের পথে- জিগ্যেস করে করে দিক খুঁজে পাওয়া, এসব তখন যেন নিত্যদিনের খেলা।
ঝুম বৃষ্টিতে রাজপথে সিগারেট নিয়ে নেমে যাই প্রতিযোগিতায়-কে আগুন না নিভিয়ে খেতে পারে। হেরে গেলে চায়ের দামে ক্ষতিপূরণ। জীবন তখন ঢেউ এর মতন।
ঠিক এমন সময়েই অনির্বাণ এলো আমাদের প্রশ্রয় হয়ে। আমাদের আর পায় কে? মুখে গান অনির্বাণের-আর বুকে সাতটা সাগরের শব্দ; যেন আমরা সবাই প্রকৃতির প্রহরী।
আমরাই অনির্বাণ। নেভানো যায় না। )
অনির্বাণ-১
অনির্বাণ আমার বন্ধু।
অনির্বাণের সাথে যখন আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল,
তখন সময়টা ছিল বড় অদ্ভুত!
আমরা হাইওয়ের উপর দিয়ে, অনেক দূরে একটা অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছি;
লাল আকাশ, সন্ধ্যে হয়ে আসছে-দুপাশে ফাঁকা মাঠ
আমরা চা খাব বলে গাড়িটা দাঁড় করিয়েছি
একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত চায়ের দোকানে;
এমন সময় দেখতে পেলাম, লাল আকাশকে পেছনে রেখে,
একটা ছেলে মাঠ পার হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললঃ 'চিনতে পাচ্ছিস'?
আমি বললামঃ 'না'।
ও বলেঃ 'ভালো করে দেখ'।
আমি সেই চুরি যাওয়া আলোতে ওকে চিনলাম-
আমার বন্ধু অনির্বাণ।
আমার চোখের সামনে পুরনো দিনগুলো ছায়াছবির মত ভেসে উঠছে।
আমি ওকে প্রশ্ন করলামঃ 'অনির্বাণ, তুই এখানে!'
ও বললোঃ 'তাইতো কথা ছিল বন্ধু। আমাদের তো এখানেই থাকার কথা ছিল।
'
আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।
আমি খুব বোকার মত ওকে প্রশ্ন করলামঃ 'অনির্বাণ, কি করছিস এখন'?
ও বললোঃ 'যা কথা ছিল বন্ধু; মানুষের মাঝখানেই আছি'।
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা। একটা অপরাধ বোধ আমাকে গ্রাস করছে।
ও বললোঃ 'তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে'।
আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম।
ও জানালার কাছে এসে বললোঃ 'এখন তো তোর নাম হয়ে গেছে-তুই তো বিখ্যাত হয়ে গেছিস! সুখেই আছিস, কি বল?'
আমার গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে,
অনির্বাণ আমার জীবন থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে।
অনির্বাণের শেষ কথা গুলো আজোও আমার কানে আলপিনের মত বেঁধে-
সুখেই আছিস...
সুখেই আছিস...
অনির্বাণ-১
দেখে যা, যা অনির্বাণ,
কি সুখে রয়েছে প্রাণ।
কি সুখে রয়েছি আমি,
কি সুখে বেচেছি গান।
সেদিনের মিটিং এর মাইক
সেদিনের কলেজের স্ট্রাইক
সেদিনের মাতাল পদক্ষেপ
বেঠিক সিদ্ধান্তের আক্ষেপ-
আজকের এই মাপা পদচারণ
সেদিনের তালের কাছে ম্লান।
শ্রমিকের মুক্তির গান
কৃষকের হাতিয়ারে শান
শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন
ঘৃণার প্রতিপালনেতে যত্ন-
আজ তোর ঘামে ভেজে যে পথের ধুলো
হয়তো সেথায় আমার হত স্থান।
-এলবামঃ কে যায়!
অনির্বাণ-২
অনির্বাণ-২
সেই ফেলে আসা মেঠোপথের বাঁকে-দুপায়ে ধুলো,
আজো দাঁড়িয়ে সে ভাবছে কি হলো!
তবে কি মিছে ছিল সেই দিনগুলো-সেই
শেকল ভাঙ্গার গান।
শোন তবে আজ, ছুঁড়ে ফেলেছি মণি-মুক্তার সাজ,
সাতটা সাগর বুকে তুলছে আওয়াজ,
নেমেছি পথে দু'চোখেতে সন্ধান-
আমি আসছি অনির্বাণ
সেই প্রশ্নের দিতে জবাব।
সুখ আছে তোর চোখে, তোর বুকে আমার গান।
ফের যাব তোর সাথে, রোদ্দুর নিয়ে হাতে
যেখানে একা একা ছিল তোর পথ চলা
রোদ বৃষ্টি মাখা, মানুষে মানুষে ঢাকা
অন্তরে, প্রান্তরে কথা বলা।
পায়ে পায়ে হেঁটে যাব, মানুষেতে মিশে যাব
তখুনি মুক্ত হবে আমার গান।
-এলবামঃ চল যাব তোকে নিয়ে
অনির্বাণ-৩
আমার বন্ধু অনির্বাণকে নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে।
অনির্বাণ, সেই যে সেই ছেলেটা,
যে তার পড়াশুনা, ক্যারিয়ার সমস্ত কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে
মানুষের মুক্তির জন্য গ্রামে গঞ্জে হারিয়ে গেল, আর ফিরে এলনা।
আজকে তার কথা বলব না।
আজকে বলব শতরূপার কথা।
শতরূপা অনির্বাণের বান্ধবী ছিল-আমরা সবাই জানতাম ওদের বিয়ে হবে।
শতরূপা এখন একটা স্কুলে পড়ায়, আজও বিয়ে করেনি।
আমার সাথে দেখা হল সেদিন।
আমি বললাম 'কিরে, কেমন আছিস?'
ও বলল 'দিব্যি আছি। '
নানা কথার পর জিজ্ঞেস করলাম 'অনির্বাণের কি খবর?'
ও বলল 'জানি না'।
'বলে ওকে তো জানিস, তিন বছর আগে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রত্যন্ত একটা গ্রাম থেকে একটা চিঠি লিখেছিল, ব্যস। '
আমার খুব কৌতুহল হয়, চিঠিটা চাই। ও আমায় পাঠিয়েও দেয়।
এখন আমি যে গানটা গাইব এই গানটা কোন গান নয়,
এটা অনির্বাণের চিঠি শতরূপার উদ্দেশ্যে...
অনির্বাণ-৩
তোকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন আমার অন্তহীন, রাত্রিদিন।
তবু বাঁধ সাধে আরেক আশা, ফুটপাতে যাদের বাসা
আগে তাদের জন্য একটা ঘর বানাই,
তারপরে তোর সিঁথিতে, তারার সিঁদুর রাঙিয়ে দিতে-করব ঋণ।
তোর দুচোখ দেখে আমায়, আমার দুচোখ দেখে আকাশ,
সে আকাশ কালো করে, মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
জানি তোর আমি অপরাধী, তুই বাদী তুই বিবাদী
তুই সিদ্ধি শক্তি অপরিসীম।
কিন্তু যারা গঞ্জে গাঁয়ে, বঞ্চনার উজান বাঁয়ে,
আগে তাদের জন্য যৌথ খামার বানাই।
তারপরে তোর সিঁথিতে, তারার সিঁদুর রাঙিয়ে দিতে-করব ঋণ।
ফেলে আসা দিনের স্মৃতি আমার বুকে বাড়ায় ক্ষত,
দুহাত তুলে আকাশপানে, শুধোই মহাকাল আর কত?
হয়ত ফেরা যায় ঘরে, পিঠ দেখানো রাস্তা ধরে,
কিন্তু মুখ দেখাবো কি করে তোকে?
আজও মানুষ এ ভূখন্ডে, বাঁচছে বোবা দ্বিধা দ্বন্দ্বে,
আগে তাদের মুক্তির ভাষা শেখাই।
তারপরে তোর সিঁথিতে, তারার সিঁদুর রাঙিয়ে দিতে-করব ঋণ।
-এলবামঃ তীর্যক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।