আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুদ্রার তৃতীয় পিঠ



শৈশবস্মৃতির নিস্তরঙ্গ দৃশ্যপট ভেদ করে হঠাৎ হঠাৎ কিছু মুহূর্ত মানসপটে জ্বালায় আলো। আমি সেসবের অর্থ করতে পারিনা । চাইওনা অর্থের আতিশয্য নিজস্ব রাজত্বে এতটুকু চিড় ধরাক । তবু কড়ি দিয়ে চারগুটি খেলার মুহূর্তগুলি আজো ব্যবচ্ছেদ করতে বসি আনমনে। তখন কে জানত এই কড়িগুলোই এক সময় অর্থের সমার্থ ছিল ! আমরা শুধু জানতাম চারটা কড়িই উবুড় হয়ে পড়লে চার ।

খেলা শুরুর জন্য লুডুতে যেমন ছক্কা দরকার চারগুটিতেও তেমনি চার । আর যদি চারটা গুটিই চিৎ হয়ে পড়ে তাহলে ষোল । চিৎ হয়ে পড়া চারটা গুটি তুলে নেয়ার জন্য পড়ে যেত হুড়োহুড়ি । কারন ষোল হলে তা আর একার থাকেনা । হয়ে হঠে সকলের ।

যে যতগুলো গুটি তুলে নিতে পারত তার তত চার যোগ হত । এই তো ছিল শৈশবের একটি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ । তারপর ধীরে ধীরে বয়স বাড়তে থাকে । পরিচিত হতে থাকি নানান ধরনের মুদ্রার সাথে । বাতিল হয়ে যাওয়া পাকিস্তানী মুদ্রাগুলো যত্ন করে রাখতাম পয়সা খেলার জন্য ।

ওগুলোর মধ্যে যেগুলো ভারি ছিল সেগুলো ছুড়ে মেরেই পয়সা খেলা চালানো হত । আমাদের পঞ্চাশ পয়সার তুলনায় সেগুলো ছিল অনেক ভারি । আর প্রথম যে ভারতীয় মুদ্রাটি আমার হাতে পড়ে, মনে পড়ে, কয়েক বছর যত্ন করে নিজস্ব খেলার সরঞ্জামের কৌটায় রেখেছিলাম সেটা । তখন কে জানত এই ফরেন কারেন্সির একমাত্র বৈধ মালিক বাংলাদেশ ব্যাংক! না জানা এই তথ্যের কারণে, আজ মনে হয়,পুলিশ চাইলে আমাকে সেই বয়সেই কারাগারে পাঠাতে পারত অবৈধ মুদ্রা রাখার দায়ে । যেমন ঢাবিতে ভর্তি হবার অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম -এখানে মেয়েদের সাথে কথা বলা আইনত দন্ডনীয় ! অন্তত, পঁচিশ পয়সা !! পয়সা খেলার আরেকটা মাধ্যম ছিল হাতের মধ্যে পয়সা ঘুরিয়ে মাটিতে চেপে ধরা ।

পয়সার শাপলা পিঠে যে বাজী ধরতে চাইত সে ডান পাশে আর অন্যরা বাম পাশে পয়সা ফেলত । মুদ্রার এই দুই পিঠই আমার চেনা জানা ভুগোলের সাথে মেলে । আমরা যারা জুয়া খেলতামনা তারা জানতামনা এই পয়সা খেলাও এক ধরনের জুয়া খেলা । এক সময় তাসের সাথে পরিচিত হই । পরিচিত হই জুয়ার সাথে ।

নাহ্ । জুয়া খেলা হয়ে ওঠেনি আমার । জীবন বয়ে চলে স্রোতবতী নদীর মত । ফারাক্কার ছোবলে সেখানে জোয়ার-ভাটায় হাহাকার পড়লেও বয়ে চলা থেমে থাকেনা । মাটির উঠোনের সীমানা পেরিয়ে একদিন স্বপ্নবান মুখগুলো পা বাড়ায় রাজধানীতে ।

রাজধানী ছাড়া আর কে পারে কারো স্বপ্নকে ধারন করতে ? তারপর নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে স্বপ্নগুলো পা দেয় কর্মজীবনে । কেউ সফল । কেউ অসফল-কারণ “সে রোদ্দুর হতে পারেনি । ” আলো আঁধারের ভেদ যারা বোঝেনা তারা কি বুঝবে রোদ্দুর না হবার যন্ত্রনা ! আবু বকরের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত । আরো শোকাহত তার মরনোত্তর প্রকাশিত রেজাল্টে ।

রাজনীতির ঠাস ঠাস বুননে কেউ কেউ দু-একটা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে । বৃহত্তর কল্যাণের তরে সামান্য ত্যাগ ! যাদের হাঁড়ে-রক্তে গড়ে ওঠে প্রাহেলিক সভ্যতা; সভ্যতার চাকা পিষ্ট করার জন্য আর কাকে খুঁজবে ? কিন্তু যে ছেলে বেড়ে উঠেছিল এদেশের খোলা আকাশের নীচে। ঢাবিতে ভর্তি হবার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল রাজধানীতে । পরবর্তিতে নেশার রাজ্যের কাছে হারিয়ে বসে নিজস্ব রাজত্ব ! ফিরতে পারেনি হারানো বৈভবে ! তাকে নিয়ে আমরা শোকার্ত হইনা । মাঝে মাঝে শুধু পরিসংখ্যানে দেখি রাজনীতির চেয়ে নেশার মরণ ছোবলে নষ্ট হচ্ছে ঢের বেশি তরুনের জীবন ।

কিংবা তারই ক্লাসমেট যার কাছে সে প্রথমবারের মত দ্বিতীয় হয় পিরোজপুর সরকারী বালক স্কুলে পড়ার সময় । যে ঢাবিতে ভর্তি হয় ল'য়ে । আজ যে পড়াশুনো ছেড়ে পড়ে আছে পিরোজপুরে । বাড়ী আর বাস স্টান্ডে যাতায়াত করে চলে জীবন- আমরা কী শোকার্ত হই পথ হারিয়ে ফেলা এই সব জীবন দর্শনে ? মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের চেনা-জানা ভূগোল কত সংকীর্ণ ! কত সহজেই সব কিছুকে আমরা ভাল-খারাপের কাতারে ফেলে দেই । তৃতীয় নয়নের মত মুদ্রার তৃতীয় যে আরেকটি পিঠ আছে ভুলে যাই সে কথা ।

‘জীবন জটিল বড়’ তবু আমাদের জীবনদর্শনে জটিলতা নেই । আমরা সব ভালর কৃতিত্ব নিজের দখলে নিয়ে খারাপের দায় চাপিয়ে দেই অন্যের ঘাড়ে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.