আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গার্মেন্টস কারখানায় উৎপাদিত লাশ: যাদের কেউ নাই বনাম যাদের জন্য আমরা সবাই



অর্থ-কড়ি কিংবা অন্যকোন কিছু যদিও কোন অর্থেই জীবনের ক্ষতিপূরণ হতে পারেনা- তবু শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বুর্জোয়া রাষ্ট্র কোন শ্রেণীকে কেমন দৃষ্টিতে দেখে তা নগ্নভাবে ফুটে ওঠে জীবণের ক্ষতিপূরণের অংকে এবং জীবনহানি প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া না নেয়ার বহর দেখে। কয়েকদিন আগে অগ্নিকান্ডে ২১ গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার পর শ্রমিকের লাশের মূল্য এবং এক বছর আগে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত অফিসারদের ক্ষতিপূরণ এবং এ ধরনের হত্যাকান্ড প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া না নেয়ার ঘটনা থেকে এ বিষটি উৎকট ভাবে চোখে পড়ে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে "গরীব এন্ড গরীব" গার্মেন্টেস এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণের ঘোষণা শুনে নিহতদের একজন জরিনা বেগমের ছেলে মো.জুয়েল বিলাপ করে উঠেছিলেন- "এক লাখ টাকা দাম দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো আমার মায়ের। বোনের লাশের দামও এক লাখ। আর লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য দেবে আরও ১৫ হাজার করে।

গরিব গার্মেন্টসে কাজ করে আমার মা আর বোন যে এখন অনেক বড়লোক হয়ে গেছে!" মো.জুয়েল মা-বোন হারিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন "গরীব এন্ড গরীব" এর মতো কারকাখানায় কাজ করতে আসা গরীবরা যে কেবল জীবনের বিনিময়েই "বড়লোক" হতে পারে। আহা! জুয়েল যদি জানতেন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের জন্য--- ১)প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের উদ্যোগে নিহত পরিবারের দৈনন্দিন খরচ মেটানোর জন্য প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে ১০ বছর পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। ২)পেনসনের টাকা বাদেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান এবং সরকারি বিভিন্ন ফান্ড থেকে কর্মকর্তাদের পদবি ও চাকরিকাল অনুযায়ী ৯০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। ৩)পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ৫৬টি পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে ট্রাস্ট মিউচুয়াল ফান্ডের পে¬সমেন্ট শেয়ার দেওয়া হয়। যেসব কর্মকর্তার ট্রাস্ট ব্যাংকে ঋণ ছিল, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত তাঁদের ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়েছে।

৪)নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের এ পর্যন্ত ৩১ জন আবেদনকারীর মধ্যে ২৮ জনের (স্ত্রী ও সন্তান) চাকরি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুজন কর্মকর্তার স্ত্রীকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে (অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য) চাকরি দেওয়া হয়। ৫)প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ সহায়তায় নিহত পরিবারের মধ্যে মোট চারজন সদস্য বা সন্তানের জন্য এআইইউবি, ব্র্যাক, নর্থ-সাউথ ও শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা বেতনে উচ্চতর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবেদন করা ৭৯ জন সন্তানের স্কুল-কলেজে ভর্তি ও বিনা বেতনে পড়াশোনার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। ৬)পরিবারগুলোর জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

অস্থায়ী আবাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চাহিদা দেওয়া এ পর্যন্ত মোট ৪৪টি পরিবারের সবাইকে বিভিন্ন সেনানিবাসের ভেতর অস্থায়ীভাবে বাসা বরাদ্দ করা হয়েছে। ৭)সব পরিবারের সদস্যদের জন্য সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো, মার্চ ০২,২০১০) অথচ ২১ জন গার্মেন্ট শ্রমিকের হত্যাকান্ডের পর বিজিএমই পরিবার প্রতি ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েই তার দায় সেরেছে আর সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা "গভীর শোক" প্রকাশ, মালিকদের প্রতি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে "প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের আহবান" করা এবং আহতদের "যথাযথ" চিকিৎসার ব্যাবস্থার নির্দেশ দিয়েই খালাশ। ঠিকই তো- শ্রমিকদের মাসিক খরচ তো আর ৪০ হাজার টাকা নয় যে তাদের দশ বছর ধরে ৪০ হাজার টাকা করে মাসোহারা দিতে হবে কিংবা শ্রমিকদের পদবি তো এমন উঁচু নয় যে ৯০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। শ্রমিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় না যে তার সুদ মওকুফ করা হবে, শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের তো আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির যোগ্যতা নেই কিংবা তাদের সন্তানদের তো স্কুল-কলেজ বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার দরকার নাই! যাদের জীবন বস্তিতে বস্তিতে কাটে তাদের জন্য আবার স্থায়ী আবাসনের ব্যাবস্থা করার কি দরকার, রোগে-শোকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু যাদের নিয়তি তাদের কি আর সিএমএইচের মত এলিট চিকিৎসালয়ের প্রয়োজন আছে! কার্ল মার্কসের একটা কথা খুব মনে পড়ছে, মার্কস এই পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা সম্পর্কে তীব্র শ্লেষের সাথে বলেছিলেন- "What a convenient arrangement it is that makes a factory girl to sweat twelve hours in a factory, so that the factory proprietor, with a part of her unpaid labour, can take into his personal service her sister as maid, her brother as groom and her cousin as soldier or policeman!" অর্থাৎ "আরামের কি দারুণ আয়োজন- কারখানায় নারী শ্রমিককে প্রতিদিন বারো ঘন্টা খাটানো হয় যেন কারখানার মালিক সেই শ্রমের অপরিশোধিত অংশ আত্মসাত করে তা দিয়ে সেই নারী-শ্রমিকেরই বোনকে চাকরানী , ভাইকে পরিচারক আর খালাতো-চাচাতো ভাইকে বানাতে পারে সৈনিক বা পুলিশ!"(সূত্র: কার্ল মার্কস- থিওরিস অব সারপ্লাস ভ্যালু, পার্ট ১, চ্যাপ্টার ৪) এরকম আরো অনেক ঘটনার মতই "গরীব এন্ড গরীব" গামেন্টস এ অগ্নিকান্ডের এই ঘটনাটি কিন্তু নিছক দুর্ঘটনা নয়- মালিক, কারখানা পরিদর্শন বিভাগ ও সরকারের অবহেলায় ঘটা হত্যাকান্ড।

ইতিপূর্বেও গত বছর ঐ করাখানায় ৪ জন শ্রমিক অগ্নিকান্ডে মারা যায়। কারখানা ভবনের ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন সত্ত্বেও কারখানা পরিদর্শকের অনুমতি প্রদান বারে বারে দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের কারণ। এভাবে রাষ্ট্রের অবহেলায় বিভিন্ন সময় ভবন ধ্বসে ও অগ্নিকান্ডে গার্মেন্টসেক্টরেই ১৫০০'র বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার। তারা পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা নিয়ে বেচে আছে।

কিন্তু এই সমস্ত মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকদের আজ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। কলকারখানায় পণ্যের পাশাপাশি বিষাক্ত বর্জ্য উৎপাদনের মতোই আগুনে পুড়ে কিংবা ধোয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শ্রমিকের লাশ হওয়াটা আমাদের কাছে ইতিমধ্যেই খুব স্বাভাবিক ঘটনার মতো হয়ে গেছে এবং সেই সাথে বোধহয় "নেসেসারি ইভিল" হয়ে উঠেছে- কারখানায় পণ্য উৎপাদন করতে চাইলে যেমন বর্জ্য উৎপাদন অবশ্যম্ভাবি! ভাবটা এমন, যেন কারখানা থাকলে, হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে চাইলে এই সব একটু আধটু তো সইতে হবেই! ফায়ার এলার্ম সিস্টেম নাই তো কি হয়েছে- ধোয়ার গন্ধ তো আছে- কুত্তার মতো শুকে শুকেই তো শ্রমিক বুঝতে পারে আগুন লেগেছে, এর জন্য "আমাদের" ঘাম ঝরানো পয়সা খরচ করে ফায়ার এলার্ম সিস্টেম রাখার কি দরকার! প্রতি ফ্লোরে কলাপসিবল গেট তালাবদ্ধ থাকে? তালাবদ্ধ থাকবে না তো কি সদর-ঘাট বানিয়ে রাখতে হবে যেন শ্রমিকরা ইচ্ছামত বাইরে আসা যাওয়া করতে পারে, গার্মেন্টস পণ্য বাইরে পাচার করতে পারে! গেটের দারোয়ান? দারোয়ানদের কি আর বিশ্বাস করা যায়, ওরাও তো শ্রমিকদের মতোই হাড় হাভাতে। আর অফিসার হত্যার ক্ষতিপূরণের সাথে শ্রমিকের লাশের ক্ষতিপূরণের তুলনা করেন, আপনে কি পাগল নাকি? দুইটাকার শ্রমিক যার নূন্যতম বেতন মাত্র ১৬৫০ টাকা, সে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আনুক আর যাই করুক, সে আর্মি অফিসার তো আর না! তাই একদিকে অফিসার হত্যার জন্য বিডিআর জোয়ানদের বিচারের আগেই হত্যা চলছে আর গার্মেন্টস শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারার অপরাধে দোষ স্বীকার করেও মাত্র ১,৫০০ টাকা জারিমানা দিয়ে ছাড়া পায় মালিক পক্ষ! ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারিতে চট্টগ্রামের কেটিএস গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে সরকারী হিসেবেই ৫৪ জন গার্মেন্টস শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার ২মাস পর মেজিষ্ট্রেট কোর্টে এই হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করলেও রাষ্ট্রপক্ষের দিক থেকে ঠিক ঠাক অভিযোগ দাখিল না করার কারণে কারখানার দুই পরিচালক এবং এক ম্যানেজারকে জনপ্রতি ১,৫০০ টাকা করে অর্থাৎ সর্বমোট ৪,৫০০ টাকা জরিমানা করে বেকসুর খালাশ দেয়া হয় (সূত্র: ডেইলিস্টার, মার্চ ১, ২০১০)। অন্যদিকে অফিসার হত্যার মতো ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য বিডিআর বাহিনীর খোল-নোলচে পাল্টানো (নাম পাল্টিয়ে করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি, পোষাকও পাল্টানো হয়েছে) থেকে শুরু করে প্রচলিত বিডিআর বিধি-১৯৭৬ অনুসারে সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর থাকার কারণে "বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন ২০১০" নামে একটা নতুন আইন প্রণয়ন করে ফেলা হয়েছে যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ভালো কথা, কিন্তু আগুনে পুড়িয়ে শ্রমিক হত্যা প্রতিরোধ করার জন্য কি করা হয়েছে বা হচ্ছে? নতুন আইন তো দূরের কথা প্রচলিত আইন মানার ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং প্রয়োজনে ফ্যাকটরি অর্ডিন্যান্সকে আপগ্রেড করা এবং তা বাস্তবায়ন করার কোন পদক্ষেপই তো দেখছি না।

যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে কারখানা তৈরী করা হয়েছে কি-না, কারখানায় যথাযথ অগ্নিনির্বাপন ব্যাবস্থা আছে কি-না, ফায়ার এক্সিট আছে কি-না, থাকলে সেটা সবসময় খোলা থাকে কি-না, নিয়মিত ফায়ার ড্রিল হয় কি-না ইত্যাদি সাধারণ রুটিন মূলক কাজগুলো নিশ্চিত করার জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর দিয়ে নিয়মিত ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের ব্যাবস্থা করা এবং এসব ব্যাবস্থা না থাকলে মালিকপক্ষকে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা ইত্যাদির ব্যাপারে রাষ্ট্রের তো কোন মাথা ব্যাথা দেখছি না। ফলে, বরাবরের মতোই, ঈদ বোনাস, সময় মতো নূন্যতম মজুরী পরিশোধ ইত্যদি খুব সামান্য দাবী আদায়ের জন্য যেমন শ্রমিকদেরকে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়, এবারও এই অগ্নীকান্ডে হতাহত শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, দোষী মালিক পক্ষের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো ও কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য শ্রমিকদেরকে রাজপথে নামতে হয়েছে। যাদের কেউ নাই তাদের জন্য রাজপথ-ই সই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.