আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : সেই গান সেই সুর হারিয়েই কি গেল?



♫ দিয়েছি তো শান্তি আরো দেব স্বস্তি। দিয়েছি তো সম্ভ্রম, আরো দেব অস্থি। প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত। ... ... ... এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল কোনদিন আমরা যে ভাঙবোই। মুক্ত প্রাণের সাড়া জ্বালবোই।

আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে নতুন সূর্যশিখা জ্বলবেই। ... ... ... জনতার সংগ্রাম চলবেই। ♫ এমনি হাজারো গান গেয়ে দিন দিন বাংলার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ যুগিয়ে গেছে যে প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, সেটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। শুধু গান নয়, বিভিন্ন কলেবরের অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিদিন সকাল-বিকাল হাজির হত এই বেতার যুদ্ধরত হাজার হাজার বাংলাদেশির সামনে। প্রচার করত নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।

বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে তুলে ধরত রণাঙ্গণের খবরাখবর। [চিত্র : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের লোগো] এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাও হয়েছিল অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই রেডিও পূর্ব পাকিস্তান প্রচার করে আসছিল আন্দোলনের পক্ষে। পাকিস্তান সরকার ২৫ মার্চ রাতেই দখল করে নেয় ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সকল গণমাধ্যম। কিন্তু চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার প্রেরণ কেন্দ্রটি তখনো পাক সেনারা পুরোপুরি দখলে আনতে পারেনি।

এখানকার কলাকুশলীদের মধ্যে ১০ জন তরুণ বিপ্লবী তখন এখানকার ১০ মেগাওয়াট ট্রান্সমিটারটি দিয়ে প্রচারণা শুরু করেন 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি...'। এভাবেই তারা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করে দেন এবং গোটা জাতি যেন ফিরে পায় আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা আর যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দৃঢ় মনোবল। এখান থেকেই ২৬ ও ২৭ মার্চ ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই বেতারের ট্রান্সমিটারটির শক্তি সীমিত ছিল। বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত একটি জাপানি জাহাজ সেই বার্তাটি শুনতে পায়।

পরে রেডিও অস্ট্রেলিয়া ও বিবিসি থেকে বার্তাটি পুনঃপ্রচার করা হয়। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি এই কেন্দ্রের প্রচারণা। ৩০ মার্চ ১৯৭১ পাক বাহিনী গুড়িয়ে দেয় কেন্দ্রটি । তখন কেন্দ্রের ১ মেগাওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার খুলে নিয়ে সেই ১০ তরুণ ২টি গ্রুপে ভেঙ্গে পালিয়ে যান ত্রিপুরা আগাফা সীমান্তের বন এলাকায়। সেখান থেকেই ৩ এপ্রিল থেকে আবার প্রচার শুরু করেন।

পরে আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রটিকে। সেই ১০ জন বীরের মধ্যে ছিলেন বেলাল মুহাম্মাদ, সৈয়দ আব্দুশ শাকের, মোস্তফা আনোয়ার, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আব্দুল কাসেম সন্দ্বীপ, আমিনুর রহমান, রাশেদুল হোসেন, এ এম শরিফুজ্জামান, কাজী হাবিবুদ্দিন মনি আর রেজাউল কারিম চৌধুরী। এঁদের সব্বাইকে জানাই প্রাণভরা শ্রদ্ধা! ১৭ এপ্রিল শপথ-নেয়া মুজিবনগর সরকার আগে থেকেই চাইছিলেন একটা শক্তিশালী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে। অবশেষে ভারত সরকারের সহায়তায় ৫০ মেগাওয়াটের মিডিয়াম ওয়েভের একটি ট্রান্সমিটার ২৬ মে ১৯৭১ সালে কলকাতার বালিগঞ্জের একটি বাড়ি থেকে প্রচার শুরু হয় "জয় বাংলা বাংলার জয়" সূচক সঙ্গীতের "স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের"। প্রথম থেকেই এই প্রচার কেন্দ্রে যোগ দিতে শুরু করেন অনেক শিল্পী সাহিত্যিক কলা কূশলীরা।

এর একটা পুর্ণাংগ লিস্ট পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওয়েব সাইটে। প্রতিদিন সকাল ৮:৩০ থেকে ৯টা এবং বিকেল ৫টা থেকে ৭টা এই ২ সময় প্রচারিত হত বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা। এগুলোর মধ্যে ছিল খবর, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ 'বজ্রকন্ঠ', কোরান পাঠ, কথিকা, জীবন্তিকা, নাটক, নকশা, ফিচার আরো কতকিছু। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল এম আর আখতার মুকুলের 'চরমপত্র'। মুকুল এখানে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় পাক আর্মিকে ব্যঙ্গ করে তাদের করুণ অবস্থার চিত্র তুলে ধরতেন।

আরেকটা খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল কল্যাণ মিত্রের 'জল্লাদের দরবার'। এখানে ইয়াহিয়া খানের কর্মকান্ডগুলোকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরা হত; ইয়াহিয়া খান এই অনুষ্ঠানে পরিচিত ছিলেন 'কেল্লাফতে খান' নামে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বা বলাইবাহুল্য প্রোগ্রাম ছিল একাত্তরের গানগুলো। এই গানগুলো যুদ্ধের ময়দানে অনুপ্রাণিত করত বীর বাঙালিদের। ৬ দিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ স্বীকৃত হবার পর এই কেন্দ্রই বাংলাদেশ বেতার- রূপে সম্প্রচার শুরু করে।

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ঢাকায় এর কার্যক্রম শুরু হয়। হাজার হাজার গান তৈরি করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে, প্রচার করা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। শিল্পীই ছিলেন প্রায় ১২০ জনের মত। এদের মধ্যে রয়েছেন – সপ্না রায়, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, তপন মাহমুদ, প্রবাল চৌধুরী, ফকির আলমগীর, উমা খান, কুইন মাহজাবীন, মিতালী মুখার্জী, মালা খুররম, মৃণাল ভট্টাচার্য, রথীন্দ্রনাথ রায়, রফিকুল আলম, রুপা ফরহাদ, শাহীন সামাদ, রিজিয়া সাইফুদ্দিন, সান্‌জিদা খাতুন প্রমুখ। সুরকার/শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন – সমর দাস, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, সুজেয় শ্যাম প্রমুখ।

এদেরকে আমরা সম্মানার্থে বলি শব্দসৈনিক। এঁরা হয়ত অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু যারা অস্ত্র হাতে রণাঙ্গণে ছিলেন তাদের প্রেরণার বাণী তো এরাই শুনিয়েছিলেন। এরাও তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান যোদ্ধাই। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গেয়েছিলেন সপ্না রায়। আপেল মাহমুদের 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি'।

বিজয়ের পর সুজেয় শ্যাম লিখেছিলেন ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’। এরকম কত সুন্দর সুন্দর গান যে তৈরি হয়েছিল সেসময় তার ইয়ত্তা নেই। রুপা ফরহাদ একটা গান গেয়েছিলেন ‘চাঁদ, তুমি ফিরে যাও’। এই গানটি নিয়ে দারুন একটা কাহিনি আছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঈদের চাঁদ উঠল।

কিন্তু ঈদ কি আর উদযাপন করার মত মানসিকতা করো ছিল তখন! এই গানটা লেখা হল। সেদিন – তার পরের দিন - সারাদিন ধরে এই গানটাই বাজল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। এই গানটার প্রথম লাইনটাই শুধু আমার মনে আছে। তবে এর সারকথা হচ্ছে – ‘হে ঈদের চাঁদ! তুমি কেন এসেছ? তুমি ফিরে যাও। রক্তে রক্তে লাল হয়ে আছে বাংলার বুক।

চাঁদের রুপালি আলো তুমি কোথায় রাখবে?’ অদ্ভুত সুন্দর এক সুর, অদ্ভুত আবেগময়ী এর ভাষা। সবাই প্রাণ ভরে গানটি শোনে আর চক্ষু মোছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই গানটি সম্ভবত আমাদের কারো কাছে আজ নেই। স্বাধীনতার ৩৮ বছর চলে গেল, কিন্তু আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই গানগুলোকে সংরক্ষণ করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করলাম না। এই গানটির গায়ক রুপা ফরহাদ আজো আমাদের মাঝে রয়েছেন, কিন্তু তাকে আমরা কখনো দেখলাম না, কেউ চিনলাম না।

এটি শুধু একটি উদাহরণ দিলাম। এরকম হাজার হাজার অসাধারণ গান আমাদের রয়েছে, যেগুলোর সব গুলো তো দূরে থাক, সম্ভবত এর ২০ ভাগও আমাদের কাছে আজ নেই। হায়! দুর্ভাগ্য!!! রুপা ফরহাদের মত যারা স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন, তাদেরকে তাদের ত্যাগের প্রাপ্য স্বীকৃতিটকুও আমরা দিতে পারলাম না। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি বেসরকারি রেডিওর এক অনুষ্ঠানে রুপা ফরহাদরা এই আক্ষেপই প্রকাশ করলেন। তার কাছেই শুনলাম কলকাতার বালিগঞ্জের সেই বাড়ির ছোট্ট একটি স্টুডিও কুঠরিতে কিভাবে কত ত্যাগ স্বীকার করে তারা এইসব প্রোগ্রাম রেকর্ড করেছেন।

আধা ঘণতার মধ্যেই তারা একটা গান লিখে সুর করে গেয়ে অন-এয়ারে দিয়ে দিতেন। চিন্তা করা যায়! দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে শরণার্থী হয়ে কত কষ্ট সয়ে তারা এই যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিলেন! এর বাইরেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ত্রিপুরার বিভিন্ন বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে তারা এইসব গান গেয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট বাংলার মানুষের মাঝে আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। তাই আজ এই ৩৮ বছর পর আমাদের দাবি- যা হবার হয়ে গেছে। আর পেছনের দিকে না তাকিয়ে আজই আমাদের এই অসম্পাদিত কাজগুলো করতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যেসব সম্মানিত কর্মী ‘শব্দসৈনিক’ আজও আমাদের মাঝে রয়েছেন তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।

তারা যেসব গান গেয়েছেন সেগুলোর কোন রেকর্ড যদি আমাদের কাছে থেকে না থাকে, তবে আবার সেগুলো রেকর্ড করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, শুধু শুনেছি, আমরা সেই সব গান শুনতে চাই। সেসব গান শুনে শুনে আমরা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে আরো নিবিড়ভাবে বুঝতে চাই। আমাদের এই সাধ কি পূরণ হবে না? আমাদের অবহেলায় যেন এগুলোর কোন কিছুই হারিয়ে যাবার সুযোগ না পায়। আর এগুলোকে ইন্টারনেটে স্বাধীন বাংলা এতার কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বা অন্য কোন মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দেবারও দাবি জানাই।

সূত্র: ইন্টারনেট ও বিভিন্ন এফএম রেডিও অনুষ্ঠান


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.