আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মকথন

নিজেকে নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা, এখোনো করে যাচ্ছি . . .

আমার বন্ধু, মোজাম্মেল, সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হওয়াতে অভাববোধটা কোন সময়ই সে বুঝেনি, প্রতিপত্তিশালী, আচরণ আর চলনেও সাহেবী আয়েশটা ছিল। একদিন দুজনে ওদের দোতলা বাড়ীর ছাদে, মাঝের টেবিলটাতে একটা ফলের ঝুড়ি, তাতে সাজানো হরেক রকম ফল। কথাচ্ছলে হঠাৎই বেশ তাচ্ছিল্যতায় ঝুড়িটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল “নে নে ফল খা, তোরা তো আর এই যশোর ছেড়ে ওই খুলনাতেও যেতে পারবিনা, জীবনে এই গ্রাম ছাড়া তোদের কোনদিনই শহর দেখা হবেনা” - জিদ্টা সেইদিনেরই, ঘুরে উঠে এলাম। মনে মনে জীবনে এই অপমানের প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞাও নিয়েছিলাম। তখনকার সময় বাবা সাধারণ কৃষক।

অর্থ অভাবে পড়াশোনা, সে তো বিলাসিতা। তবুও ইচ্ছাশক্তিকে জয় করে মেট্রিক পাসটা হল। ততদিনে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি, কিন্তু কৃষক বাবার ভরা ক্ষেতের মাঠ আর আমার পড়াশোনা, দুটো প্রসঙ্গই যেন প্রশ্নবিদ্ধ ? বাবা একদিন প্রচন্ড মারলেন, পড়াশোনার জন্য, কে খরচ দিবে ? তার চেয়ে যেন মাঠেই কাজ করি, অন্তত উপার্যন হবে। রাগে, ক্ষোভে, দু:খে বাবার মুখটাও দেখিনি-শুধু গায়ের গামছাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়, যাবার আগে বলেছিলাম “আমি আর ঘরে ফিরবনা, কোনদিনও না” - আর ঘরে ফেরাও হয়নি, যখন ফেরা হল, তখন আর অবশিষ্ট কিছুই ছিলনা। সময়টা সনের হিসেবে ৬৯।

তখন তো আর অত পত্র-পত্রিকা পাওয়া যেতনা, সম্বল ছিল রেডিও, তাও দু-এক গ্রাম মিলে একটা। বাড়ী থেকে সেই যে বেরিয়েছি আর ফিরিনি, কোন যোগাযোগও পর্যন্ত রাখিনি। মানুষের ভীড়ে চায়ের স্টলে দাড়িয়ে রেডিও বাজছিল। হঠাৎ একটা খবর সমস্ত আকর্ষন কেড়ে নিল। “লোক নিচ্ছে, আর্মিতে লোক নিবে-লাইনে দাড়াতে হবে।

” আগামীকালই, রওনা দিলাম সাথে সাথে, যে কয়টা পয়সা ছিল তাতে হেঁটে আর গাড়ীতে মিলে পৌছে গেলাম। মাগুড়া স্টেশন। শ’ - শ' লোক লাইনে। “কোনছে ট্রেড লেনা হ্যায় ?” পশ্চিম পাকিস্তানীর আকষ্মিক এ প্রশ্নে কিছুটা ভড়কে গেলাম, কারণ ট্রেড কি তা তো জানা ছিলনা, - অতীত স্মৃতি আর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ, “স্যার আমাকে এমন একটা ট্রেড দেন, যাতে আমি দেশ বিদেশ ঘুরতে পারি। ” জয়েন হল চিটাগং-এ, তিন মাসের মাথায় পোষ্টিং অর্ডার চলে এল।

গন্তব্য পশ্চিম পাকিস্তান। “মোজাম্মেল, দোস্ত - এ চিঠিটা যখন লিখছি, তখন আমি মাঝ সমুদ্রে, এখন গভীর রাত, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের পথে। ” - চিঠির শুরুটা করেছিলাম এভাবেই। কতটাই না প্রতিশোধপরায়ন ছিলাম। ট্রেনিং শেষে চাকরি শুরু হল।

ভালই চলছিল, মাস শেষে কড়া কড়া নোটের মাইনে, সামান্য খরচ ছাড়া সবটুকুই জমিয়ে রাখতাম। এতদিনে মনে পড়ে গেল বাবার কথা, গ্রাম - ভাই, বোন এদের সবার কথা। সময় গড়িয়ে তাও বছর দুয়েক পার হয়েছিল। বাবার জন্য বেশ কিছু জামা-কাপড় আর জমানো টাকাগুলো হাতে দিয়ে পুরোনো রাগটাকে বিসর্জন দেব, এই ভেবেছিলাম, ছুটিও নিলাম, প্লেনের টিকেটও কনফার্ম। যেদিন দেশে ফেরার কথা, তার আগের দিনের পাওয়া টেলিগ্রাম জীবনটাকে আরও একবার ওলট পালট করে দিল।

সব হিসেব নিকেষকে শুন্যের কোঠায় নিয়ে দাড় করাল। সমস্ত উপার্যন এ জীবনের কাছে খুব, অতি তুচ্ছ মনে হল। বাবা যখন নাকি মারা যায়, শুধুই তিনি আমার নাম-ই করেছিলেন, জীবনের শেষ দিন, শেষ মুহুর্তের একটাই চাওয়া ছিল, আমাকে একটিবার দেখবার। সেই যে বের হলাম, সেই তো শেষ দেখা ছিল। জীবনের এ ভূল, ভূলের কষ্ট কোনদিন শোধরাবার নয়।

যার জন্য ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া সে মানুষটিই নেই, কার জন্য আমি, কার জন্য আমার এসব। অবশেষে যখন দেশে ফেরা হল - ৭১’ সন। জানুয়ারী মাস। ৩ মাসের ছুটি ছিল। ছুটি শেষ হবার আগেই দেশে শুরু হল গন্ডগোল।

২৫শে মার্চ রাতের ঘটনা। ২৬শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে যোগদানের তারিখ। যখন শুনলাম ক্যান্টনমেন্টেও নাকি মানুষ মারা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত না গিয়ে সোজা ভারতে চলে গেলাম। ৮নং সেক্টরের সাথে থেকে শুরু হল আরেক যুদ্ধ, দেশকে বাঁচাবার যুদ্ধ। ৯মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে যখন বিজয় এল, দেশ ভাগ হল, এদেশের সেনাবাহিনীতেই যোগ দিলাম।

আমিই ছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নন-কমিশনড্ অফিসারের মধ্যে সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা অফিসার-যখন অবসরে গ্রহণ করি। গত হয়েছে অনেকটা সময়। আজ কোথায় তারা! কোথায় মোজাম্মেল, সেই গ্রাম, গ্রামের ধুলোমাখা পথ- যেখানে আজ কাঁচা পাকা রাস্তা, খসে পড়া স্কুলের দেয়ালে এখন চুনের রং, অবারিত ক্ষেতের মাঠ, রোববারের হাট, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান, যুদ্ধ, সংগ্রাম, দেশ ভাগ, কোথায় বাবা, বাবার সেই মুখখানি ... ................................................................................. তার গলাটা ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এসেছে , চোখটাও ঝাপসা, চশমাটা একবার খুলে মুছে নিতে দেখলাম। বিষন্নতায় ডুবে থাকা মানুষটাকে কেমন জানি অগোছালো মনে হচ্ছিল, যতবারই কারণ জিজ্ঞেস করেছি এর আগে, এড়িয়ে গিয়েছে। কোথাও যেন খুব একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত নতুবা দুশিন্তা তাকে ভর করে আছে।

এভাবেই আজ যখন মানুষটি বলছিল তার -এ আত্মকথন, অতীত হয়ে যাওয়া জীবনের কিছুটা সময়ের কালক্ষেপণ। সে মানুষটির সামনেই আমি, বলা যায় মুখোমুখি দুজনে। অতীত খুঁজে ফেরা এ মানুষটির সামনে আমাদের বর্তমানকে বড্ড অসহায় মনে হল, তাইত স্বান্তনা দেবার মত সত্যি কোন সাহস আমারও ছিলনা। . . . . . . . . . . . . . . . স্মৃতিকথামূলক এ লেখাটি আজ উৎসর্গ করা হল আমার বাবা'কে। বাবা’র জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, তার কর্মজীবনের সহযোগী, যুদ্ধের সহযোদ্ধা এবং সর্বপোরি পারিবারিক ও সম্পর্কযুক্ত সকল অস্তিত্বের প্রতি রইল সালাম।

তাঁর সন্তান এবং পরিবারের পক্ষ হতে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।