বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই আবুলের সাথে আমার পরিচয়। পাশের গ্রামে ওর বাড়ি। বরাবরই ও কিছুটা বোকা ধরনের। মাঝে মাঝে এমন সব কান্ড করে বসে যা বলার নয়। বলা চলে নামের সাথে ওর কাজেরও বেশ মিল ছিলো।
বয়স আর কতোই হবে পনেরো-ষোল বছর।
ওদের সংসারের অবস্থাও খুব খারাপ। তার বৃদ্ধ বাবা ভানগাড়ি চালিয়ে সংসারটা কোনো মতে টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের গ্রামের সামনে দিয়েই সে প্রতিদিন মাদ্রাসায় যেতো। রাস্তায় অনেকেই ওকে জ্বালাতন করতো।
আমি শহর থেকে গ্রামে গেলেই ওর সাথে দেখা হতো। কিন্তু সেই হ্যাবলা-কান্ত আবুল যে এভাবে নায়ক বনে যাবে ভাবতেই পারছি না। মানুষের মুখে মুখে এখন একটাই নাম জিহাদী আবুল। ঈদের পরের দিনের ঘটনা। আপনাদের কাছে ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি কি বলেন?
ঈদের পরের দিন আমাদের গ্রামে অদূরে হিজলতলি বাজারে গেলাম মোবাইলে ফ্লেক্সি নিতে।
ফ্লেক্সি নিয়ে ভ্যানস্ট্যান্ডে এসে একটা ভ্যানে বসলাম। তখন সন্ধ্যা হতে চলেছে। অনেকগুলো ভ্যান সারি করে রাখা। কিন্তু যাত্রী তেমন একটা নেই। শুধু আমার ভ্যানে হুজুর টাইপের দুজন পান চিবোচ্ছে।
হঠাৎ কোথা হতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আবুল। ঘামে ওর গা ভিজে গেছে।
ওর এ অবস্থা দেখে আমি ওকে বললাম, কি রে আবুল, কি হয়েছে। আবুল তখনো হাঁপাচ্ছিলো। হাঁপাতে হাঁপাতেই ও বললো, "ভাইজান আজক্যা হামি এক বিশাল কাম করিছি।
শালারা আবুলক্ চিনে না তো। একন বোজো দরজার কি অবস্তা। "
আমি বললাম, কার দরজা, কিসের দরজা?
ভ্যানের হুজুরগুলো ফ্যাছ করে প্যানের পিক ফেলে নড়েচড়ে আবুলের দিকে তাকালো। আর আবুলের উপস্থিতি টের পেয়ে দুই মিনিটের মধ্যেই ১৫/২০জন ওখানে জুটে গেলো।
আবুল পাঞ্জাবীর পকেট থেকে হাতরুমাল বের করে চোখ-মুখ মুছে নিয়ে বললো, "বিশ্বাস করিন আপনিরা, দরজার অবস্তা এ্যাক্কেবারে শ্যাষ ক্যরা দিছি।
ওডা না বদলালে আর চলবে না। "
এবার সমস্বরে সবাই বললো, কার দরজা, কিসের দরজা?
আবুল বললো, "কিসের দরজা আবার। শালারা ফাজলামি শুরু করিচে। লষ্টামি শুরু করিচে। লালফুল সিনেমা হলের পশ্চিম দিককার দরজাডা নোয়ার অড দিয়া এ্যাক্কেবারে গুঁড়া ক্যরা দিছি।
"
সবাই খুব আগ্রহী হয়ে বললো, তারপর তারপর?
হঠাৎ আমার ভ্যানের ওই দুই হুজুর লাফিয়ে উঠে বললো, তারপর শুনে আর কি হবে। সিনেমা হলের দরজা ভেঙ্গে আবুল বিশাল একটা সওয়াবের কাজ করেছে। এই পবিত্র দিনে এমন কাজ অবশ্যই জিহাদী কাজ বলে বিবেচিত হবে। ততক্ষণে ওখানে লোকের ভীড় জমে গেছে। দুই হুজুর ভীড় ঠেলে আবুল কাছে গিয়ে ওকে কাধে তুলে নিয়ে ‘ জিহাদী আবুল জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে মিছিল শুরু করলো।
সাথে সাথে আমজনতাও গলাফাটিয়ে জিহাদী মিছিল করলো।
সারারাত ধরে ওই ঘটনার কথাটা ভাবলাম। ঘুম হলো না বললেই চলে। সকালে স্থানীয় পত্রিকায় দেখলাম প্রথম পাতায় বক্স করে আবুলের বিরত্বগাথা ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন ইসলামী নামধারী সংগঠনগুলোর তৎপরতা লক্ষ্য করলাম সারাদিন।
সন্ধ্যায় শুনলাম আবুলকে একটি ইসলামী দল সংবর্ধণা দেবে আগামীকাল। আমার কাছে সবকিছু কেমন যেনো ঘোর লাগছিলো।
পরদিন বিকালে গ্রামের স্কুল মাঠে তৈরী করা হলো বিশাল মঞ্চ। নামীদামি ধর্মীয় নেতাদের সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হলো। দলে দলে লোক ‘ জিহাদী আবুল জিন্দাবাদ, নষ্টামি নিপাত যাক’ স্লোগান দিয়ে মাঠে হাজির হলো।
আবুলের বাবাকে চেনাই যাচ্ছে না। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছেন মঞ্চের অগ্রভাগে। পাশেই জিহাদী আবুল। আবুল মিটিমিটি হাসছে।
আবুলের বিরত্ব নিয়ে আকাশপাতাল বক্তব্য দিলেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।
বক্তারা বললেন, আজকের যুগে এমন সোনার টুকরা পরহেজগার ছেলে পাওয়াই কঠিন। যেখানে ঈদের মতো পবিত্র দিনেও মানুষ সিনেমা হলে যাচ্ছে নোংরামি দেখতে, সেখানে আবুলের এ বীরত্ব চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরপর ফুলের তোড়া ও নগদ কয়েক হাজার টাকা পুরস্কার দিয়ে জিহাদী আবুলকে সংবর্ধিত করা হলো। সব শেষে মাইকে বক্তব্য দিতে এলো আবুল। মঞ্চের সামনের আমজনতা আবুলের মুখেই সেদিনের বিরত্বগাথা শুনতে চাইলো।
দেখলাম ওর হাতপা র্থ র্থ করে কাঁপছে। আর কাঁপবেই না বা কেনো এর আগে তো ও কখনো মাইকে কথা বলেনি। তার ওপর এমন একটা অনুষ্ঠান। আর অনুষ্ঠানের মধ্যমণিই আবার সে। আবুল শুরু করলো ওর বক্তব্য, হামার কওয়ার মতো কিচু নাই।
সেইদিন সকালে ঘুমোত থ্যাকা উঠঠাই গেছি সিনেমা হলত। য্যায়া দেকি সাড়ে ৯টার শো’র সব টিকেট শ্যাষ হয়্যা গেছে। হামার ম্যাজাজটাই খারাপ হয়্যা হয়্যা গ্যালো। চিন্তা করনু শালা ঈদটাই মাটি। দরজায় কান রেখে কিছুক্ষণ সিনেমার ডায়লক শুননু।
সবগুলা পোস্টার দেখনু। ১২টার শো’র টিকেটটাও পানু না। ম্যাজাজ আরো খারাপ হলো।
এদিকে মঞ্চের হুজুরগুলোর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। আবুলের বাবা বলল, আবুল আয় বাপ আর কিচু কওয়া লাগবে না।
আবুল বললো, থামো তো আব্বা শেষ ফিনিশিংডা দিয়া লেই। এ্যারপর হামি ভাবনু ৩টার টিকেট তো পামো। এ আশায় আরো তিন ঘোনটা বস্যা থাকনু। গেটম্যানোক ১৫টাকা ঘুষও দিনু। সে একটা টিকেট যোগাড় কর্যা দিবার চালো।
হায় রে আল্লাহ্ , কি আর কমো তোমরাই কও। সারাদিন বস্যা থ্যাকা ৩টার টিকেটও পানু না। হামার গাওত তো খুব আগ লাগলো। এলিংয়ের কাছে একটা নোয়ার অড আছলো। ওডা দিয়া শালা হলের দরজা ভ্যাঙ্গ্যা শ্যাষ কর্যা দিনু।
আর এমন একডা কাম করার পর গাডদের দু-চারডা লাঠির আঘাত ত্যামন কিচু মনে হয়নি। হঠাৎ জিহাদী আবুলের মাইকটা বন্ধ হয়ে গেলো। আমজনতা আর কিছু শুনতে পেলো না। তারপরও তারা ‘জিহাদী আবুল জিন্দাবাদ’ বলে গলাফাটিয়ে স্লোগান দিতে লাগলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।