আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হরতালে গেল আরও চার প্রাণ

১৮-দলীয় জোটের টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন গতকাল সোমবার চারজন নিহত হয়েছে। চট্টগ্রামে টেম্পো উল্টে, লালমনিরহাটের পাটগ্রামে গুলিতে ও নাটোরে ইটের আঘাতে একজনের মৃত্যু হয়। ঢাকার সাভারে গত রোববার রাতে অগ্নিদগ্ধ পোশাক কারখানার কর্মকর্তা গতকাল সোমবার সকালে হাসপাতালে মারা গেছেন।

এ ছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহন ভাঙচুর এবং হরতাল-সমর্থক, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়।

আটক করা হয় অন্তত ৬৬ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে অন্তত ১৭ জনকে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আজ মঙ্গলবার হরতালের দ্বিতীয় দিন। কাল বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় হরতাল শেষ হবে।

রাজধানীর গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের গুলশান-২ নম্বরের ৫৫ নম্বর সড়কের বাসার প্রাচীরে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা।

এর আগে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অদূরে ১০-১২ জন হরতাল-সমর্থক ঝটিকা মিছিল বের করে ছয়-সাতটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। এ ছাড়া রাত আটটার দিকে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে তিনটি, আদাবরে দুটি ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।

রাত আটটার দিকে দয়াগঞ্জে একটি যাত্রীবাহী বাসে এবং রাত সাড়ে আটটার দিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের বিপরীতে একটি সিএনজি-চালিত অটোরিকশায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। রাত নয়টার দিকে মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে আগুন দেওয়া হয়।

সকালে কাঠেরপুল, সায়েদাবাদসহ কয়েকটি এলাকায় হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়।

মোহাম্মদপুরে শিবিরের মিছিল থেকে একটি বাস ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। মহাখালীতে গাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগে দুই শিশুকে আটক করা হয়। ভোরে গাবতলীর বালুর মাঠে মিছিল বের করে রাস্তায় টায়ারে আগুন দেন ছাত্রদলের কর্মীরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল, মিরপুর বাঙলা কলেজ, নাবিস্কো, দোলাইরপাড়-সহ বিভিন্ন এলাকায় ককটেল ফাটানো হয়।

মহানগর পুলিশ জানায়, যানবাহনে আগুন, ভাঙচুর ও ককটেল ফাটানোর অভিযোগে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদের মধ্যে ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাকির হোসেন (৩০) টেম্পোযোগে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। তিনি টেম্পোচালকের বাঁ পাশে ছিলেন। পেছনে ছিলেন মাহতাব হোসেন নামের যাত্রী। তিনি জানান, নগরের চান্দগাঁও থানার মৌলভীপুকুর পাড় এলাকায় পৌঁছলে এক পিকেটার টেম্পো লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়ে।

এ সময় টেম্পো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাঁ পাশে উল্টে জাকিরের ওপর পড়ে। তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তবে চান্দগাঁও থানার ওসি আবদুর রউফ দাবি করেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা।

জাকির নগরের দামপাড়া এলাকার আলী হোসেনের ছেলে। আলী হোসেন বলেন, ‘হরতাল-সমর্থকদের ধাওয়ায় টেম্পো উল্টে যায় বলে শুনেছি।

সকাল নয়টার দিকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পৌর শহরের সোহাগপুরে ধরলা সেতুর এক প্রান্তে হরতাল-সমর্থকেরা এবং অন্য প্রান্তে আওয়ামী লীগ-সমর্থকেরা অবস্থান নেন। দুই পক্ষ হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে স্লোগান দেয়। আওয়ামী লীগ-সমর্থকেরা মিছিল নিয়ে সেতু পেরিয়ে সোহাগপুর বাজারের দিকে যেতে চাইলে দুই পক্ষে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ যোগ দেয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও পুলিশ পিছু হটে।

পরে ইউএনও আবু হায়াৎ মো. রহমতুল্লা ও থানার ওসি সোহরাব হোসেন অতিরিক্ত পুলিশ ও আনসার নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। পুলিশ হরতাল-সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছোড়ে। এ সময় পৌর ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক নাসির উদ্দিন (২২) গুলিবিদ্ধ হন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া সংঘর্ষে পুলিশের সদস্যসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন।

ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করা হয়।

ওসি সোহরাব বলেন, পুলিশের গুলিতে নাসির নিহত হয়েছেন কি না, তা তিনি নিশ্চিত নন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে তিনি গুলিবিদ্ধ হতে পারেন।

সিরাজগঞ্জ থেকে সকালে প্রায় ৫০ জন শ্রমিক ট্রাকে করে বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়ক হয়ে নাটোরে আসছিলেন। ট্রাকটি গুরুদাসপুর উপজেলার নয়াবাজার এলাকায় পৌঁছলে হরতাল-সমর্থকদের ইটের আঘাতে শ্রমিক ইসহাক মোল্লা (৪২) আহত হন।

চালক দ্রুত ট্রাক চালিয়ে আড়মারী এলাকায় যান। সেখানে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে ইসহাকসহ আরও কয়েকজন আহত হন। সেখান থেকে তাঁকে গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করার পর তাঁর মৃত্যু হয়। ইসহাকের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দক্ষিণ মথুরাপুর গ্রামে।

থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, পিকেটারদের দেখে ওই শ্রমিক ট্রাক থেকে নেমে দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে আহত হন।

এদিকে ঢাকার সাভারে রোববার রাতে দুর্বৃত্তদের বোমায় অগ্নিদগ্ধ পোশাক কারখানার কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান (৩২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ফিলিপনগরে।

জানা গেছে, আশুলিয়ার নয়ারহাট এলাকার বিশ্বাস সিনথেটিকের ক্রয় কর্মকর্তা মোস্তাফিজ শ্রমিক হাসানুল ইসলামকে (৩০) নিয়ে রোববার দুপুরে যন্ত্রপাতি কিনতে রাজধানীর নবাবপুরে যান। যন্ত্রাংশ নিয়ে তাঁরা একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ফেরার পথে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার সেনানিবাসের মুন্সী আব্দুর রউফ ফটকের সামনে বোমা হামলার শিকার হন। অটোরিকশায় আগুন ধরে গেলে মোস্তাফিজ, শ্রমিক হাসানুল ও অটোরিকশাচালক আফাজ গাজী আহত হন।

রাতেই ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে তাঁদের ভর্তি করা হয়।

আশুলিয়া থানার এসআই মনোয়ার হোসেন বলেন, হাসপাতালে সোমবার সকালে মোস্তাফিজের মৃত্যু হয়। আফাজের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

বগুড়া সদর থানার সামনে এবং থানার কাছে পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ফাটানো হয়। বগুড়া জেলা জজ আদালতের সামনে হাতবোমার বিস্ফোরণে এজিপি আবদুল ছালেক সরদার আহত হন।

গাজীপুর সদর উপজেলার সালনা, চান্দনা চৌরাস্তা ও টঙ্গী এলাকায় সকালে তিনটি গাড়িতে আগুন দেন হরতাল-সমর্থকেরা। চান্দনায় আগুনে কাভার্ড ভ্যানচালকের ছেলে মো. মনিরুজ্জামান (১৭) দগ্ধ হয়। আহত হন তার বাবা রমজান আলী (৫৫)। পুলিশ রোববার রাতে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা মাঠসংলগ্ন আশরাফ সেতু এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয় পিকেটাররা।

এ সময় হুড়োহুড়িতে পাঁচ-ছয়জন যাত্রী আহত হন। নারায়ণগঞ্জ নগর যুবদল মিছিল বের করার পর পুলিশ ধাওয়া দিলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়।

যশোর শহরে দড়াটানায় বোমায় পথচারী মোস্তাক ফিরোজ (৩০) আহত হন। বাগেরহাটের রামপালে জামায়াতের মিছিলে লাঠিপেটা করে পুলিশ। সেখান থেকে দুজনকে আটক করা হয়।

রাজবাড়ীর পাংশা পৌর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদকসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

কুমিল্লা নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। লাকসামের কান্দিরপাড় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মনির হোসেনকে কুপিয়ে জখম করেছেন হরতাল-সমর্থকেরা। বরুড়ায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন।

ফেনীতে নূর মোহামঞ্চদ (১৮) নামের এক পিকেটারকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একলাশপুরের গাবুয়া বাজারে হরতাল-সমর্থকদের ওপর যুবলীগ-ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের কর্মী ফয়সাল আবেদিন আহত হন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের আলাদাউদপুরে পরিবহনশ্রমিকদের হামলায় দুই হরতাল-সমর্থক আহত হন। আমতলী থেকে একজনকে আটক করা হয়। জেলা শহরের কলেজপাড়া-সংলগ্ন রেললাইনে সকালে আগুন দেয় পিকেটাররা।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর পৌর শ্রমিক দলের সভাপতি ফুল মিয়াসহ বিএনপির দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াত ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হয়। সন্ধ্যায় শহরের বড় ইন্দারা মোড়ে শিবির মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে দুই পক্ষে সংঘর্ষে পুলিশের আট সদস্যসহ ২৩ জন আহত হন। নীলফামারী শহরের কালীবাড়ি এলাকায় পিকেটাররা চ্যানেল আইয়ের ভিডিও এডিটর আবদুর রশিদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে।

পিরোজপুরে চারটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে ৬৪ জন আহত হন। পুলিশ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭ জনকে আটক করেছে। বরগুনার আমতলীতে তিনজনকে আটক করা হয়। বরিশালের গৌরনদী উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বদিউজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চাঁদপুর শহরের বাবুরহাট থেকে জামায়াতের এক কর্মীকে আটক করা হয়। মেহেরপুর সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামে হরতালের সমর্থনে নারী-পুরুষ আলাদা মিছিল করে।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে শিবগঞ্জ রেলক্রসিংয়ে ভোরে গাছের গুঁড়ি ও বস্তা ফেলে আগুন ধরিয়ে দেন হরতাল-সমর্থকেরা। গফরগাঁও-ভালুকা সড়কের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেয় পিকেটাররা। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২০টি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয়, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা)

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।