আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (২৩ তম পর্ব)

জেনিসারি বাহিনীর বাছাইকৃত তরুণদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন তুর্কি পরিবারে রাখা হতো। এ সময় তারা তুর্কি ভাষা, কৃষিকাজ, পশু পালন এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষালাভ করত। এরপর তাদের ভর্তি করানো হতো রাজধানীর 'এসিসি ওগলান' নামক স্কুলে। এ স্কুলে পড়াকালীনই জেনিসারি ক্যাডেটদের মেধা অনুসারে বিভিন্ন বিভাগে বিভাজন করা হতো- কাউকে শেখানো হতো ইঞ্জিনিয়ারিং, কাউকে নৌবিদ্যা। আবার কাউকে পদাতিক বাহিনীর শিক্ষা কিংবা কেউ হতো আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষজ্ঞ।

ট্রেনিং শেষে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হতো। রাষ্ট্র থেকে বেতন, ভাতা, রেশন, পোশাক এবং পেনশন প্রদানসহ নানারকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো।

জেনিসারি নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে, হিন্দুস্তানে এই বাহিনীর গঠন সম্ভব নয়। প্রথমত, স্থানীয়ভাবে ক্যাডেটদের সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। আবার অন্য দেশ থেকে সংগ্রহ করে তাদের উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হলে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে।

কারণ হিন্দুস্তানে কোনো বাহিনীর সেনাপতি হতে হলে তাকে অবশ্যই অভিজাত পরিবারের সন্তান হতে হয়। অন্যদিকে হিন্দুস্তানে কারোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানানো হলে রাজ্যময় ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেবে। তা ছাড়া সব উচ্চপদে একচেটিয়াভাবে মুসলমানদের নিয়োগ স্থানীয় হিন্দু অভিজাতবর্গ কিছুতেই মেনে নেবে না। তবে জেনিসারির আদলে হেরেমে সীমিত আকারে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।

মূলত আরমান খাঁ এবং বাহলুল খাঁর লিখিত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মহামতি সম্রাট আকবর জেনিসারি বাহিনীর আদলে একটি সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার ইচ্ছা থেকে ফিরে আসেন এবং হেরেমের মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

এর আগে হেরেমগুলোতে কেবল মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হতো কীভাবে একজন রাজপুরুষের জীবনসঙ্গিনী, শয্যাসঙ্গিনী এবং রাজপুত্রের মা হওয়া যায়। এরপর শেখানো হতো গৃহশয্যা, ব্যক্তিগত সাজসজ্জা, নাচ, গান চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি। এসবই করা হতো কেবল একটি সুখী গৃহকোণ গড়ে তোলার জন্য। ফলে হেরেমবাসীকে বিয়ে করার জন্য দরবার তথা সাম্রাজ্যের তাবৎ উচ্চপদস্থ রাজপুরুষরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের কিছুই করার ছিল না।

কারণ হেরেমবাসীর অভিভাবক ছিলেন স্বয়ং শাহেন শাহ। তিনি তার ইচ্ছামতো এবং পছন্দের রাজকর্মচারীর জীবন আলোকিত করার জন্য হেরেমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করতেন।

হেরেমে দুই ধরনের শিক্ষার্থী রয়েছে। প্রথমত, রাজপরিবারের সদস্য তথা রাজরক্তের ধারক মেয়েরা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মেয়েরা। এখানকার পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং শিক্ষাপদ্ধতি সবার জন্য সমান ছিল।

আপনি শুনে অবাক হবেন, আমরা আমাদের আট বছরের শিক্ষাজীবনে কখনো শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর কাছ থেকে কটূ বাক্য শ্রবণ করিনি কিংবা কখনো দণ্ডপ্রাপ্ত হয়নি। অথচ আমাদের পাঠ্যসূচিতে রাজ্যের সব কঠিন কঠিন বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং আমরা তার সব কিছুই শিখেছি। মূলত শিক্ষা পদ্ধতির আধুনিকতা এবং শিক্ষকদের মানের কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা লাভ ছিল এক আনন্দময় ঘটনা।

আমি যখন শিক্ষা লাভ শুরু করি তখন ১০টি মেয়ে ছিল, যারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছিল। এ ছাড়া রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন আরও ১৭ জন।

মোট ২৭ জন মিলে আমরা শিক্ষালাভ করতাম। আর আগেই বলেছি আমার কামরায় আরেকজন মেয়ে ছিলেন মেহেরজান নামে যে কিনা অনেক আগে থেকেই হেরেমে ছিলেন। মেহেরজানের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখলাম। প্রথম রাতে আমরা অনেকক্ষণ জেগে জেগে গল্প করলাম। এক সময় মেহেরজান তার বিছানা ছেড়ে আমার বিছানায় চলে এলো।

আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কাঁদতে লাগল। বলল, অনেক দিন পরিবার-পরিজনের কথা ভুলেছিলাম। আজ তোমাকে দেখে মনে পড়ল আমার ছোট বোনের কথা। তাই তোমাকে স্পর্শ না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম এবং বড় বোন হিসেবে মনে মনে সমীহ করা শুরু করলাম।

সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকল।

পরদিন সকালে নাশতা সারার পর আমাকে ধারণা দেওয়া হলো প্রতি দিনকার কর্মসূচি, শিক্ষা পদ্ধতি এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। এরপর আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হলো এবং সবার সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া হলো। আমাদের দিনের একটি অংশে শিখতে হতো হেরেমের মধ্য থেকে আর বাকি সময়ে আমাদের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। মূলত ঘোড়ায় চড়া, তীর চালানো, তরবারির যুদ্ধ, বন্দুক চালানো এবং গোলাবারুদের ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের শেখানো শুরু হলো।

দিনের নির্দিষ্ট সময়ে আমরা ব্যায়াম করতাম এবং খুব সকালে যোগব্যায়াম করতাম। হেরেমের সব মেয়েই ছিল মুসলমান। ফলে আমাদের নামাজ, কালাম, কোরআন-হাদিস পড়ার পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের মৌলিক মূল্যবোধও শিক্ষা দেওয়া হতো। আমাদের খাদ্য তালিকা এমনভাবে তৈরি করা ছিল যাতে করে বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা খাদ্যমানের পুষ্টি পেতাম। বেশির ভাগ খাবারই ছিল চর্বিবর্জিত।

যেসব খাবারে শরীরে কাম, ক্রোধ, উত্তেজনা এবং হিংসা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সেসব খাবার থেকে আমাদের দূরে রাখা হতো এবং ওইসব খাবারের খারাপ দিক সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হতো।

আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, ভূগোল, অংক, জ্যামিতি, যুদ্ধনীতি এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব (Comparative religian theology)  শিক্ষা দেওয়া হতো। আমরা যাতে এগুলো ভুলে না যাই এ জন্য প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বিতর্কের আয়োজন করা হতো। একবার বিতর্কে আমার দায়িত্ব পড়ল সুলতান মুহাম্মাদ বিন তুঘলক সম্পর্কে বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্য। তাকে কেন ইতিহাসের অন্যতম মেধাবী সম্রাট বলা হয়, আবার কেন পাগলা রাজা বলা হয়- তা নিয়ে আমাকে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলো।

আমি রাত-দিন পরিশ্রম করে হেরেমের লাইব্রেরি থেকে অনেক তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করলাম। আমার বোন মেহেরজান আমাকে যারপরনাই সাহায্য ও সহযোগিতা করল। আমি খুবই আশ্চর্যজনক এবং চমকপদ কিছু তথ্য পেলাম সুলতান সম্পর্কে। তার সম্পর্কে জানতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তার মস্তবড় ভক্ত হয়ে গেলাম। তাকে আমার মনে হতে লাগল ইতিহাসের এক মহানায়ক হিসেবে।

তার ডাক নাম ছিল জুনা খান। সুলতান হওয়ার আগে তিনি যখন যুবরাজ ছিলেন তখন তার নাম ছিল শাহজাদা ফকর মালিক। তার পিতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলক হঠাৎ করেই প্রবল অহংকারী হয়ে উঠেন এবং আলেম ওলামাদের অপমান এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকেন। রাজ্যের জ্ঞানীগুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়েও তিনি রং তামাশা করে কথা বলতেন। ফলে তার মৃত্যু হয় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার মাধ্যমে।

সবাই বিশ্বাস করে, দিলি্লর মেহরুলীতে বসবাসরত সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওলি আল্লামা হজরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার অভিশাপে তিনি মৃত্যুর কবলে পড়েন। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন, যুবরাজ জুনা খান চক্রান্ত করে তার জন্মদাতা পিতাকে মেরে ফেলেন তাড়াতাড়ি সিংহাসনে আরোহণের জন্য। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগছিল যে, আমার স্বপ্নের পাগলা রাজা বাধাহীনভাবে ২৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ সাল অবধি তার রাজত্বকালে পুরো মুসলিম দুনিয়া ছিল উত্তাল। বাগদাদ তখন মোঙ্গলদের দখলে।

হাজার হাজার বাগদাদী মুসলমান মোঙ্গলদের অত্যাচার থেকে পালানোর জন্য পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক লোক ছিলেন, যারা আব্বাসীয় রক্তের ধারক। জুনা খান একবার খবর পেলেন দিলি্লতে আব্বাসীয় খলিফাদের এক রক্তের আত্দীয় এসেছেন। এ খবর শোনার পর সুলতান শুরু করলেন হাউমাউ করে কান্নাকাটি। সভাসদ-পারিষদ বর্গতো মহাঅবাক! প্রকাশ্য দরবারে সুলতান অবোধ শিশুর মতো কাঁদছেন।

তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।

সুলতান কাঁদতে কাঁদতে সিংহাসন থেকে নেমে এলেন। তারপর খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তার খাস কামরায় গেলেন। মাথা থেকে রাজমুকুট নামিয়ে রাখলেন। হাতের রাজ দণ্ডটিও ফেলে দিলেন।

মূল্যবান মণিমুক্তার কণ্ঠহার, হাতের বাজুবদ্ধ আংটি সব কিছু খুলে আশপাশে ছুড়ে মারতে লাগলেন। তারপর মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি কাঁদেন আর বিলাপ করে বলতে থাকেন হায় আল্লাহ আমার এখন কি হবে গো! আমি তো নির্ঘাত জাহান্নামবাসী হবগো। বাগদাদের রাজরক্ত এখন দিলি্লতে রাসূলের বংশধর এখন দিল্লির রাস্তায়, খলিফা হারুন অর রশিদের আত্দীয় এখন আমার মেহমান! অথচ আমি জানি না। ইয়া আল্লাহ তুমি আমায় মাফ কর।

আমার যে ভুল হয়েছে তাতে আমার জায়গা দারুল হাবিয়াতেও হবে না- এসব বলতে বরতে সুলতান তার কান্নার দাপট বাড়িয়ে দিলেন।

পাত্রমিত্ররা সব ভয়ের চোটে হাহাকার শুরু করলেন। এরকম অদ্ভুত কাণ্ড তারা জীবনেও দেখেননি কিংবা শোনেনইনি। কি করা যায় কি করা যায়। এসব নিয়ে যখন গবেষণা চলছিল তখন সুলতান কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালেন।

তারপর তার রাজপোশাক খুলে ফেলে ফকিরি পোশাক পরলেন। সবাইকে বললেন, ওরে তোরা কে কোথায় আছিস। আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে যা। আমি পায়ে হেঁটে ফকিরের মতো হুজুরের দরবারে যাব। সেই কথা সেই কাজ।

তিনি পায়ে হেঁটে রওনা হলেন আব্বাসীয় বংশের লোকটির কাছে।

লোকটির নাম ছিল আবু বকর। দিলি্লর শহরতলীর কোনো এক বস্তিতে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন দীনহীন ফকিরের বেশে। ভারতবর্ষে এসেছিলেন প্রাণ বাঁচানোর জন্য। কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার লোকজনের কাছে নিজের বংশ পরিচয় দিয়েছিলেন একটু খাতির যত্ন পাওয়ার জন্য।

কেউ কোনো খাতির যত্ন না করলেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে থাকল শহরময় এবং এক সময় তা রাজদরবারে সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলকের কানে পৌঁছলো। তিনি হাঁটতে হাঁটতে সত্যিই বস্তিতে এসে পৌঁছলেন। ফকিরের বেশে সুলতান হাঁটছেন আর তার হাতি-ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা সব পেছনে। এই দৃশ্য দেখে শহরবাসী এক অজানা আশঙ্কায় ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল। কেউ কেউ খিড়কির সদর দরজা বন্ধ করে দিল।

অন্যরা জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে অবস্থান নিল।

সুলতানের আগমনের খবরে বস্তিতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। তারা মনে করল সুলতানের সৈন্যবাহিনী হয়তো বস্তি উচ্ছেদ করে ফেলবে। সুলতানের লোকজন গিয়ে বস্তিবাসীদের আসল ঘটনা বলল। একটি চেয়ারে আবু বকরকে বসানো হলো।

সুলতান উপস্থিত হয়ে তার পায়ের কাছে বসে আবু বকরের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। আবু বকর বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। তিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং নিজের করণীয় সম্পর্কে বুঝতে পারলেন। তিনি সিংহ বিক্রমে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এভাবে বেখেয়ালে হয়ে রাজ্য চালাস কেন। সুলতান হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন।

আবু বকর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কাফফারা আদায় করার হুকুম দিলেন। কি সেই কাফফারা আবু বকরের জন্য একটি প্রাসাদ এবং বড় অংকের রাজকীয় পারিতোষিক। সুলতান সঙ্গে সঙ্গে তা কবুল করলেন।

জুনা খানের এত্তোসব কাণ্ডকারখানার জন্য অচিরেই তিনি পাগলা রাজা খ্যাতি পেলেন। এ সুযোগে রাজ্যের অনেক জায়গায় বিদ্রোহ দেখা দিল।

তিনি কঠোর হস্তে সেসব বিদ্রোহ দমন করলেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সত্যিই অপরাজেয় বীর। একবার রাজধানী দিলি্ল থেকে দেওগীরে (বর্তমান দৌলতাবাদ) স্থানান্তর করলেন। বহু লোক মারা গেল। দিলি্ল একটি বিরান নগরীতে পরিণত হলো।

কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি পুনরায় দিলি্লতে রাজধানী স্থানান্তর করলেন। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই তিনি তাম্র মুদ্রা চালু করলেন। এরপর একদিন অতিরিক্ত তৈলাক্ত মাছ পেটপুরে খেয়ে উদরাময় রোগে আক্রান্ত হলেন এবং মারা গেলেন ১৩৫১ সালে।

আমি যখন এতসব বিষয় মজা করে বিতর্ক অনুষ্ঠানে বললাম তখন উপস্থিত সবাই আমার খুব প্রশংসা করলেন। দিনে রাতে নানা কর্মে আমরা আনন্দের মাঝে বড় হতে থাকলাম।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমার যোগ্যতা এবং রূপের কারণে আমাকে আপনার খেদমতের জন্য নির্ধারণ করে রাখা হলো। সেদিন আমার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলো সেদিন আমাকে জানানো হলো আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। আমি আশার আলো আর আনন্দের বন্যায় দোল খেতে থাকলাম এবং অপেক্ষা করলাম আপনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার উদগ্র বাসনা বুকে ধারণ করে। আল্লাহর শুকরিয়া যে আমি শেষ পর্যন্ত আপনার সাক্ষাৎ পেলাম তবে বড্ড অসময়ে। এ কথা বলে আফসানা শাহজাদা সেলিমের বুকে মাথা রেখে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

শাহজাদা যথাসম্ভব চেষ্টা করলেন নিজেকে সংযত রাখার জন্য। কিন্তু তার মনে হলো তিনিও হয়তো আফসানার মতো আবেগতাড়িত হয়ে পড়বেন। একটি রমণী তার জীবন ও যৌবনের প্রথম লালিত পুরুষকে কাছে পেয়ে আবার জীবনের জন্য হারাতে যাচ্ছে- কাজেই তার অনুভূতি ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। শাহজাদা একবার চিন্তা করলেন আফসানাকে উপপত্নী হিসেবে রেখে দেবেন। আবার মনে করলেন এতো রূপবতী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন রমণীতো পত্নী হওয়ারই যোগ্য।

এসব ভাবতে ভাবতে আফসানার প্রতি তার মমত্ববোধ বাড়াতে থাকল। তিনি বুঝতে পারলেন আফসানা তার জীবন কাহিনীর খুঁটিনাটি আর বলতে চাচ্ছে না। এই অবস্থায় শাহজাদা বললেন, কই তোমার দুটি ইচ্ছা পূরণের কথা আমাকে বলো। আফসানা এবার উঠে বসল এবং শাহজাদার হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিল। তার ডাগর দুটি আঁখি রাজপুরুষের ওপর দৃষ্টি রাখল।

তার ঠোঁট দুটি কাঁপতে শুরু করল এক অস্ফুট বেদনায়। শাহজাদা তাকে পুনরায় বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

আফসানা বলল আমার প্রিয় সাহেবে আলম। আমি সারা জীবন আপনার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আপনি যেভাবে রাখবেন সেভাবেই আমি খুশি থাকব এমনকি দাসী হিসেবেও।

আজকের রাতের পর আমাদের যদি আর কোনো দিন দেখা নাও হয় সেক্ষেত্রেও আমার কোনো অনুযোগ থাকবে না। আমি কেবল আপনার পরিচয়ে এই হেরেমে থাকতে চাই। এখান থেকে বের হয়ে অন্য কারও স্ত্রী কিংবা আর কোনো পার্থিব সুখ-শান্তি সমৃদ্ধি পেতে চাই না। আপনি আমাকে আপনার হেরেমের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করে নেবেন এই প্রার্থনা করছি। দ্বিতীয়ত, আমি আপনার সন্তানের মা হতে চাই।

এ জন্য আজকের রাতের পর আপনাকে আমি আর কখনো বিরক্ত করব না। আমার বিশ্বাস হয়তো আজই আমি সৌভাগ্যবতী হতে পারব। সেই ক্ষেত্রে আপনি সুযোগ করে কোনো এক সময় আপনার সন্তানটিকে দেখে যাবেন। আর যদি মরে যাই তবে আমার জন্মস্থানে যেন আমাকে কবর দেওয়া হয় এবং সম্ভব হলে আপনি একবার সেই কবরের কাছে গিয়ে আমার জন্য যদি দোয়া করেন তবে সেটিই হবে এই দাসীর জীবনের পরম পাওয়া! শাহজাদা মনে করেছিলেন আফসানা হয়তো ধনদৌলত অর্থবিত্ত এসব চাইবে। কিন্তু তা না করে সে যেসব মানবিক আবেদন রাখল তাতে তার প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ জাগলো।

তিনি আফসানাকে গভীর প্রণয়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করে কানে কানে বললেন প্রিয়! সব হবে। তোমার সব আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হবে। তোমার সব প্রস্তাব আমি শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করলাম এবং কথা দিলাম অঙ্গীকারসমূহ পালন এবং বাস্তবায়ন করার জন্য। শাহজাদার কথা শুনে আফসানা নিজেকে সেইভাবে সমর্পণ করলেন যেভাবে একজন পুরুষ সর্বান্তকরণে একজন নারীকে পেতে চায়। রাতের আঁধার, চাঁদের আলো, দখিনা বাতাস এবং ফুলের সুগন্ধির সম্মিলনে শাহজাদার সঙ্গে আফসানার মিলন হলো।

একবার অনেকবার এবং বহুবার তারা এসে অপরের সঙ্গে মিশে রইল আদিম বন্যতায়। ভালোবাসার চির অম্লান মাধুর্য এবং অনাবিল প্রশান্তিতে।

সকলের সূর্যের আলো শাহজাদা এবং আফসানার ঘুম ভাঙালো। আজ থেকে দু'জনেরই শুরু হবে এক নতুন জীবন। কিন্তু বিদায়ের কথা মনে হতেই উভয়ের হৃদয় হাহাকার করে উঠল।

কিন্তু নিয়তির বিধানকে স্বাভাবিকভাবেই তারা মেনে নিলেন। রাজ মহীয়সী রুকাইয়া সুলতান বেগমসহ হেরেমের সবাই সঙ্গী করে শাহজাদাকে বিদেয় জানালেন। রাজদরবারে উদ্দেশে রওনার আগে তিনি যখন ঘোড়ায় চড়বেন ঠিক তখনই অনুভব করলেন পিঠে যেন কার বেদনার অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে আর শক্ত একটি ভালোবাসার রশি তাকে এবং তার ঘোড়াকে বেঁধে রেখেছে- তিনি এগুতে পারছেন না। তার সাহস হলো না পেছনের দিকে তাকানোর। ঘোড়ার পিঠে চড়ে শাহজাদা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে দুই পায়ে সজোরে আঘাত করলেন ঘোড়াটির পেটে।

আরব দেশীয় তেজী ঘোড়াটি শাহজাদার বেদনা আর ভালোবাসাকে পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। পেছন থেকে করুণ সুরে ধ্বনিত হতে থাকল আল বিদায় ইয়া হাবিবি। আল বিদায় ইয়া হাবিবি। শাহজাদা স্থির থাকতে পারলেন না। পেছন ফিরে তাকালেন।

আফসানা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে গাছ-পাথরের মতো স্থির হয়ে। তার অমলিন চাঁদ মুখখানাতে কিসের যেন এক প্রভা বিকশিত হচ্ছিল। ঠিক ওই পর্যন্তই দেখতে পেলেন শাহজাদা, কারণ ঘোড়ার দ্রুতগতি এবং পথের দূরত্ব দুয়ে মিলে মত্যলোকের শাহজাদাকে তার আফসানা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। তিনি এগুতে থাকলেন আর পেছনে পড়ে থাকল একটি প্রেম, একটি প্রণয় আর ভালোবাসার এক নিদারুণ স্মৃতিচিহ্ন।

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/index.php     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.