আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেরারী বসন্ত



মাংক্রাত মুরুং ভিডিপি বা মুরুং বাহিনীর সদস্য। প্রায় সময় দেখা হয় মাতাল অবস্থায়, কোন স্বাভাবিক অবস্থায় নয়। আমাকে দেখলে সামরিক কায়দায় একটা সেল্যুট দেয়। আমি ও তার মত সেল্যুট দিয়ে প্রতি সম্মান জানাই। অতপর করমর্দন করতে গিয়ে আমার হাতে লোহার মত শক্ত একটা চাপ দেয় যা এককালে যে বলবান লোক ছিল তা উপলব্দি করা যায়।

অত পর টেনে নিয়ে যায় কোন হোটেল রেষ্টুরেন্টে। হুকুম করে, এই চা নাস্তা দাও। সে চা নাস্তা খায় না,শুধু আমার জন্য অর্ডার করে। আমি যখন চা নাস্তা খায় তখন গভীর ভাবে আমার আপাদমস্তক পরখ করে। আমার মাথা গায়ে হাত বুলায়।

কত দাংখ অয়ে তুমি! ( কত বড় হয়েছ তুমি!)। চা নাস্তার বিল আমি দিতে চাইলে বাধা দেয়,নিজেই তা পরিশোধ করে। পরে এই ভাবে দেখা হলে তার আগেই আমি সেল্যুট দেয়। প্রায় সময় সে আমাকে কলা পানীয়,নাস্তা ইত্যাদি একটা না একটা কিনে দেয় কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন কিছু খায় না বা নেয় না। তুমি আমিত্তুন চিনিয়ে না?( তুমি আমাকে চেন?) আমি মাথা নাড়ী, নাহ! তুমি বাবাত্তুন পুচার লও,( তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কর)।

আমি বাড়ীতে আমন্ত্রন জানালেও আরেক দিন যাবো বলে অন্যত্র চলে যায়। আমার ও লোকটাকে কেমন জানি চেনা চেনা মনে হয়, কোথায় জানি দেখেছি স্পষ্ঠ মনে করতে পারি না। আরেক বার যখন দেখা হল তখন একই আদব কায়দাচ্ছলে জিজ্ঞেস করে, আমিত্তুন চিনিয়ে নাহ? ( আমাকে চিনেছ?) আমি মাথা নাড়ী, নাহ। তুমি বাবাত্তুন পুচার ন লয়? ( তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করনি?) নাহ। হটাৎ বুক চাপড়িয়ে আর পিঠ দেখিয়ে বলে, আমি-য়া তুমি ঘোড়া,এই পিঠ লই য়া তুমিত্তুন বইয়েত্তে( আমিই ছিলাম তোমার ঘোড়া, এই পিঠেই তোমাকে বহন করেছি)।

আমি খুব লজ্জিত হয়ে যায়, যে নাকী শৈশবে আমাকে লালন পালন করেছে তাকে আমি চিনতে পারছি নে। কি করবো ভাবি, কি করা যায়? একবার আমার হাত ধরে ভালমত পরখ করে বলেছিল, তুমি ঘড়ি খুব সুন্দর (তোমার ঘড়িটা খুব সুন্দর),আমিত্তুন এগোয়া ঘড়ি লাগিয়ে, কিনি ন পারিল য়া( আমার ও একটা ঘড়ি দরকার কিন্তু কিনতে পারছি নে)। কথাটা মনে পড়ে গেল। কিনে দেয়ার তো সামর্থ নেই। তাই আমার নিজের হাতের ঘড়ি খুলে দিয়ে তার হাতে পড়িয়ে দিলাম।

বললাম, দাদা এই ঘড়ি তোমাকে দিলাম। সে নিজেকে আমার ঘোড়া বলে পরিচয় দিলেও আমি কেমন জানি প্রতিপালক আপনজনের মত ভাবতে লাগলাম। অনেকদিন তার দেখা পাইনে, কোন পাড়ায় তার বসবাস তাও জানা হয়নি, জানি না সে কেমন আছে? একটু একটু মনে পড়ে শৈশবের স্মৃতি। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে সেই সোনালী দিনগুলো। আলীকদম সদর থেকে তিরিশ চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সেই রিজি সিংগা ও দুলুঝিড়ি পার্বত্য উপত্যকায় আমাদের বসতি।

বাবা সদরে জায়গা জমি বর্গাচাষে দিয়ে স্বপরিবারে সেখানে চলে যান ২৯২ নং চাইম্প্রা মৌজা হেডম্যানের দ্বায়িত্ব পালনে। ২৯২ নং হেডম্যান ছিলেন থোয়াই খুমী,বাবার ধর্মস্থ পিতা। এই হেডম্যান বৃদ্ধ হলে বাবাই তার সকল দ্বায়িত্ব পালন করতেন। সবাই মুরীবাবু বলেই ডাকতো। চলতি বা শরৎ- শীতের মৌসুমে সেকালে চাকমা পাড়া বা পরিবারে নবান্নের মেলা আর ¤্রােদের গোহত্যা উৎসব চলত।

সেকালে প্রশাসন বলতেই কিছুই দেখিনি। এই হেডম্যানরাই সকল নেতৃত্ব দিতেন। এই গো হত্যা উৎসবে স্বপরিবারে যোগদান এবং খাজনা আদায় করার সময় এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যাওয়া আসার সময় এই মাংক্রাত মুরুংই আমাকে পিঠে বহন করে নিয়ে যেত। পাড়ার বাহিরে বাঁশের কারুকার্যে বানানো থাকতো সিংহদ্বার। সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে পাড়ার লোকজন বাদ্যযন্ত্রসহকারে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাত।

বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অতিথি দের পাড়ার অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হত। পাড়ার অভ্যন্তরে দুতলা বাঁশের কারুকার্যের মাচাঙের ভিতর বিশাল আকারে ষাড় বাধা। অতিথিদের যথাযথ আসনে বসিয়ে বিভিন্ন পাড়া থেকে বাদ্যযন্ত্রসহকারে আসা মুরুং নারীপুরুষ সেই মাচাং এর চারিদিকে নৃত্যগীত করতো। কেউবা মদ পান করে মাতাল। তালমাতাল অবস্থায় বিচিত্র ভঙ্গীতে নাচ গান আর আনন্দ উল্লাস করতো।

দশ পনের কেজি চাল ভতি করা যায় এমন মাটির কলসি বা গজিতে পাহাড়ীয়া মদ তৈয়ার করে ঘরের সিড়ির নীচে মাটিতে স্থাপন করতো। সেখান থেকে বাঁশের পাইপ দিয়ে নারী পুরুষ এই জগড়া বা পাহাড়ী মদ পান করতো। বিভিন্ন পাড়া থেকে কয়েকদল মাচাঙের চারিদিকে নৃত্যগীত করার পর একজন বলবান যুবক বর্শা নিয়ে চুপিসারে এসে মাচাঙে বাঁধা ষাড়কে বধ করত। ষাড় বধ করার সাথে সাথেই তার জিহবা কেটে নিয়ে মাচাঙে রেখে দেয় সেই ঐতিহাসিক নিয়মে। অতপর কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে সেই মৃত ষাড় টানা হেচড়া শুরু হয়ে যায়।

প্রতিপক্ষরা টেনে নিতে পারলে অনেক বোতল মদ জড়িমানা দিতে হয় এই গো হত্যার মূল আয়োজককে। কিন্তু আয়োজকের দলবল মজুদ থাকে বিধায় প্রতিপক্ষরা তা টেনে নিতে পারে না। পাড়ার কার্বারীর বাড়ীতে অতিথিদের জন্য পরিপাটি বিছানা বিছানো হত। সেই বিছানায় বাবা বা হেডম্যান বসলে পাড়ার লোকেরা নানা উপঢোকন নিয়ে জুমের খাজনা বা কর দিতে আসে। সেই উপঢোকন ও খাজনা দিয়ে পঞ্চাঙ্গ প্রনাম করে।

অতিথিদের জন্য নানা রকম খাদ্য সামগ্রী আপ্যায়ন করা হয়। বাবার সঙ্গী সাথীরা সেই আপ্যায়নে মদ ও পান করতেন। কিন্তু ছোটদেরকে বা আমাদেরকে অন্যত্র নিয়ে খাবার আপ্যায়ন করা হত। পাড়ার সবার খাজনা প্রদান করা হয়ে গেলে আমাদেরকে আবার বাদ্য যন্ত্রসহকারে পাড়ার সিংহদার অবধি পৌঁছে দিতেন। হেডম্যানের পক্ষ থেকে তাদেরকে যথাসাধ্য আর্থিক পুরস্কার প্রদান করে বিদায় নেয়া হত।

এইভাবে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় গিয়ে খাজনা আদায় করার স্মৃতি আজো মানস পথে ভেসে উঠে। এই সেই মাংক্রাত মুরুং যে নাকী আমাকে শৈশবে লালন পালন এবং কোলে পিঠে বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেত। তখন ছিল সে তারুন্যে উদ্দীপিত এক শক্তিশালী নওজোয়ান। সেকালে চাকমা বা তঞ্চঙ্গ্যাদের তেমন তফাৎ ছিল না। তঞ্চঙ্গ্যারা চাকমাদেরকে আনক্যা আর চাকমারা তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে তনুঞা বলে জানতো ।

এই নবান্নের মেলায় শুকর, ছাগল ও অসংখ্য মোরগ মুরগী জুমে সেই সোনালী ধান ক্ষেতে এবং নির্ঝর- নিঝরিনীতে বধ করতো। অছা বা ওঝা নামে একজন লোক এই নবান্ন উৎসবের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। যে সকল দেব দেবী নামে এই সব পশু পাখী বধ করা হয় তারা হলেন, শ্রী মা লক্ষী, মা গঙ্গা, বসুমতি,কালায়া, পরমেশ্বরী, ঢলেশ্বরী, মেঘমালা বা মেঘদেবী, ভ’ত, যক্ষ¥া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পাড়া পরশীকে আমন্ত্রণে মাচাঙ ঘরের মাচাঙ উঠানে কলাপাতায় সেই নবান্নের ভোজ আজো সাধ জাগে। মানস পথে ভেসে উঠে সেই জুমের দৃশ্য, যেখানে গৃহীনীকে সাজানো হয় সুব্র পোষাকে শ্রী মা লক্ষী হিসেবে, যিনি জুমে শুকর মোরগ মুরগী বধের স্থান থেকে একটি সুতার রশি বেয়ে গৃহমুখী আগমন এবং গৃহের লোকজন পানিতে তার পা ধৌত করে দিয়ে সসম্মানে বরন করেন।

যে সুতার নালী স্পর্শ করে গৃহীনী গৃহে আসে তার আদি কথা হচ্ছে; বসুন্ধরায় যখন খরা দূর্ভিক্ষ চলছে তখন কালায়া নাকি স্বর্গে শ্রী মা লক্ষী কে আনার জন্য যান এবং বিনয়ের সাথে মানবের দু:খ কষ্টের কথা বর্ননা করেন। এই স্বর্গ থেকে মার্কষা জাল সেতুর মাধ্যমে শ্রী মা লক্ষী সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে এই বসুন্ধরায় পর্দাপন করেন। নির্ঝর বা নির্ঝরিনীতে ছাগল ও মোরগ মুরগী বধ করার পর একটি মোরগ আগুনে পুঁড়ে ফ্রাই করা হয়। সেই ফ্রাই করা মোরগের একটি রান ছিড়ে নিয়ে এবং বাঁশের এক চোঙা মদ নিয়ে গৃহ কর্তা নবান্ন পরিচালনাকারী ওঝাকে প্রদান করেন। সেই বাঁশের চোঙা থেকে মদ পান করে ওঝা বিগত রাতে দেখা স্বপ্ন সবার সামনে বর্ণনা করেন।

নিজের,গৃহস্থের এবং পাড়ার সবার শুভ অশুভ উন্নতি অবন্নতি বিশ্লেষন করেন। মাংক্রাত মুরুং যে বালকটিকে কোলে পিঠে লালন পালন করেছে সে ও হয়েছে আজ তিন চার সন্তান- সন্ততির জনক, মস্তকে গজিয়েছে সুব্র কাঁশফুল। সেই হেডম্যানের বাচাই করা বলবান যুবক পড়ন্ত বিকেলে হারিয়ে ফেলেছে শরীরের শক্তি সামর্থ সব, বারে বারে অন্বেষন করতে চাই যেন সেই ফেলে আসা দিন, ফেরারী বসন্ত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।