আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন ব্লগার, একজন হুমায়ূন আহমেদ আর একজন মা

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! (এই গল্পটিই দুদিন আগে "এই গল্পটি অন্যরকম" শিরোনামে পোস্ট দিয়েছিলাম। বিশেষ কারণে এর গঠনগত কিছু পরিবর্তন সাধন করলাম। ) ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকাতেই একটা ছোটখাটো ধাক্কা খেলাম। ১১টা ৩০ বাজে। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলাম আমি।

মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ থেকে সবটুকু ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করলাম। আমার ওঠার কথা ছিল ভোরে। সাড়ে ছয়টায়। অথচ এখন বাজে সাড়ে এগারোটা! মোবাইলটা চেক করলাম। অ্যালার্ম দিয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারলাম না।

তারপরই মনে পড়ল, মাকে ডাকতে বলেছিলাম সাড়ে ছয়টায়। মা নিশ্চয়ই ডাকেন নি। সাথে সাথে আমার সবটুকু রাগ মায়ের উপর গিয়ে পড়ল। যেন আমি যে উঠতে পারিনি এতে আমার কোনই দোষ নেই। যেন সব দোষ মায়েরই।

মানুষের মেজাজ খারাপ হলে মুখেও তার একটা ছাপ পড়ে। মুখের পেশিগুলো অদ্ভুতভাবে শক্ত হয়ে যায়। আমার তাই হল। মুখ চোখ শক্ত করে আমি বিছানা থেকে উঠলাম। এখন প্রথম গন্তব্য বাথরুম।

তারপর পি সি। তারপর...আসলে তার পরে কি করব এটা আমি এখনও ভাবি নি। আমার পরিচয়টা বোধকরি এখন দিয়ে দেয়া যায়। আমি সরব। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশোনা করি।

অবসর সময় কাটাই আড্ডা, ফেসবুকিং আর ব্লগিং করে। ব্লগে আমি মূলত ছোটগল্প লিখি। থাকি মা আর ছোটবোনের সাথে। আর এখন আমার সামার ভ্যাকেশন চলছে বলে একটু ফ্রি, তাই তো আপনাদের সামনে মনের কথাগুলো বলতে এসেছি। পরিচয়পর্বের সমাপ্তি হোক এখানেই।

আমরা মূলগল্পে ফিরে আসি। বাথরুমে যাবার পথে মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে নিশ্চয়ই অদ্ভুত দেখাচ্ছিল, আমাকে দেখেই মা ফিক করে হেসে দিলেন। বললেন, অবশেষে ওঠার সময় হয়েছে নবাবপুত্তুরের! এরকম কথায় আমার লজ্জা পাবার কথা ছিল। মুখ রাঙ্গা করে "কি যে বল না তুমি মা" বলে মাথা নিচু করে চাপা হেসে পালিয়ে বাঁচার কথা ছিল।

কিন্তু আমি সেটা করলাম না। মুখচোখ কঠিন থেকে কঠিনতর করে বললাম, আমাকে ডাকো নি কেন? মা বললেন, কই? ডাকলাম তো! আমি প্রচণ্ড বিরক্তির একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে বললাম, কি ডাকলা? টেরই তো পেলাম না। কালকে না কতবার বললাম দরকার হলে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডেকে দিবা? তোকে কতবার ডেকেছি জানিস তুই? মা অবাক হয়ে বললেন, আর তুই এরকম করছিস কেন? এত সকালে কি কাজ তোর? সেটা তোমার মাথায় ঢুকবে না, বুঝেছ? চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম আমি, তোমার মত ব্রেনে সেটা ঢুকবে না। কথা শেষ করে আমি আর দাঁড়ালাম না। গটগট করে হেঁটে বাথরুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলাম।

মা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তবে আমার এ ব্যবহারের সাথে উনি পরিচিত। তাই হয়তো এই হতভম্ব ভাবটা বেশিক্ষণ থাকবে না। বাথরুমে অনেকক্ষণ মাথায় পানি দিয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করলাম আমি। মায়ের সাথে কথা বলতে গেলেই যে কি হয়, বুঝে উঠতে পারি না।

খুব রাগান্বিত হয়ে উঠি মাঝে মাঝে। হয়তো যাদের উপর আমাদের অধিকার আছে, যাদের সাথে সম্পর্কটা কাগজ কলমের নয়, ভালবাসার - তাদের উপরই আমাদের অভিমান হয় সবচেয়ে বেশি, অথবা রাগের প্রকাশটা হয় অতিরঞ্জিত। ব্রাশ টাশ করে পি সিতে বসার জন্য তাড়াহুড়ো করে রুমে ফিরছি, এমন সময় মা বললেন, খেতে আয়। মেজাজটা আবার গরম হয়ে গেল আমার। পি সিতে বসার কথা ছিল সেই সাড়ে ছয়টায়।

অথচ এখন বাজে পনে বারোটা। এখন যত তাড়াতাড়ি পারি পি সি নিয়ে বসব, এর মধ্যে খাওয়ার যন্ত্রণা কারো ভালো লাগে? কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে গিয়ে পি সিটা স্টার্ট দিলাম আমি। উইন্ডোজের পাসওয়ার্ড দিয়ে ডেস্কটপ ওপেন করলাম। এমা ওয়াটসনের একটা লাস্যময়ী ভঙ্গি আমার ডেস্কটপটা আলো করে জ্বলজ্বল করতে থাকল। অভ্যাসবশত প্রথমেই Google Chrome ওপেন করলাম আমি।

ফেসবুকে ঢুকে ইউজারনেম আর পাসওয়ার্ড দিলাম। একটু পরেই আমার ফেসবুক হোমপেজটা লোড হয়ে গেল। দেখি সাতাত্তরটা নোটিফিকেশন, ইনবক্সে ছয়টা মেসেজ। ইনবক্স ওপেন করে দেখি যা ভেবেছিলাম তাই, প্রায় সবকটাই মেয়ের মেসেজ। সম্ভবত আমার গল্প পড়ে ভালো লেগেছে বলে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টের সাথে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে।

ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দেখলাম ৯টা। এর মধ্যে ৬টাই মেয়ে। সব ধুমাধুম Accept করলাম। এখন আর প্রোফাইল দেখার সময় নেই। অন্য দিন হলে দেখতাম।

এখন আমাকে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। Notification পেজটা ওপেন করে কোনমতে একবার চোখ বুলালাম। দেখি পোলাপান বেহুদা ছবি ট্যাগ করে রেখেছে, বেহুদা লিঙ্ক দিয়ে রেখেছে আমার ওয়ালে। ধ্যাত! তবে আমার রিসেন্ট নোট "ভালবাসি বলে রে বন্ধু আমায় কাঁদালে"তে এ পর্যন্ত লাইক পড়েছে ১২৩ টা। ওটা গতকালই পোস্ট দিয়েছিলাম।

পেজে আর দেয়া হয় নি। আসলে অনেকগুলো পেজ আমাকে অনুরোধ করে গল্প দেবার জন্য। কয়েকটা আবার টাকাও দিতে চায়। আজিব দুনিয়া। আমার গল্প পেজে দিলে লাইকসংখ্যা হাজার ছাড়ায় প্রায় প্রতিবারই।

ব্রাউজারটা বন্ধ করে এম এস ওয়ার্ড ওপেন করতে যাব, এমন সময় মা হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমার সামনে তখন পুরনো এক বান্ধবীর প্রোফাইল খোলা। পড়লাম মহা ফাঁপরে। মা প্রোফাইল পিকচার দেখে ফেললে কি না কি মনে করবেন। আবার ব্রাউজার বন্ধ করলে ডেস্কটপে তো এমা ওয়াটসন লাস্যময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেই।

কি করি? উভয় সংকট। স্বভাবতই মায়ের উপর রেগে গেলাম আমি। কি হইসে? আমি না বলসি আমার রুমে না বলে ঢুকবা না? মা আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে বললেন, খেতে আয়। আমি গলার স্বর চড়িয়ে বললাম, মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার তো আছে, নাকি? এখন তো আমি আর পিচ্চি নাই। চল খোকা, খেয়ে নিয়ে তারপর করিস, মা আমার হাত ধরেন।

টান মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিই আমি। ততক্ষণে স্ক্রিনে আমার এম এস ওয়ার্ডের New Document এর সাদা পৃষ্ঠায় কার্সর ব্লিঙ্ক করছে। এখন খাব না। কখন খাবি? পরে খাব। মা এখন যাও তো।

পরোটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এবার ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে গেল আমার। কতবার বললাম খাব না? কথা কানে যায় না? সকালে জাগাতে বললাম, তা পারল না, আর এখন এসে ঘ্যানঘ্যান করছে, কোন মানে হয়? মা চলে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অভ্র ওপেন করলাম।

এখন আমার লেখার পালা। একটা গল্প লিখতে হবে আমাকে। একটা ছোট, অথচ দারুণ, গল্প। ঠিক পাঁচ মিনিট পর মা আমার ঘরে পরোটা দিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম যে সাথে গরম গরম গরুর মাংস আর সবজিও দিয়ে গেছেন তিনি।

জলে জিব ভিজে উঠল আমার। নাহ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। কারো দিকে না তাকিয়ে আমি হাত ধুতে চলে গেলাম। হাত ধুয়ে এসে গপাগপ খেয়ে প্লেটটা ডাইনিং রুমে রেখে আসলাম আমি। তারপর বন্ধ করে দিলাম দরজাটা।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। সোয়া বারোটা বাজে। নাহ, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। গল্পের এক লাইনও লেখা হয় নি। বেশ কয়েকবার দু এক লাইন করে লিখে আবার ডিলিট করে দিতে বাধ্য হলাম আমি।

উফ, মনটা বিক্ষিপ্ত। তাই গল্প আসছে না। আবার ফেসবুকে ঢুকলাম আমি। সাধারণত অনলাইন হই না, আজ হলাম। দেখি অনেকগুলো মেয়ে অনলাইনে।

অনলাইন হবার এক মিনিটের মধ্যে পাঁচজন আমাকে হাই দিল। আমি একজনের "হাই"তে রিপ্লাই দিলাম। দশ-পনের মিনিট চ্যাট করলাম ওর সাথে। ও বলল, আমার গল্প নাকি ওর খুবই ভালো লাগে। খুবই নাকি সুইট মনে হয়।

চ্যাট ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু নতুন কাউকে বেশি পাত্তা দিতে নেই। নাহলে মাথায় চড়ে বসবে। নিজের তৈরি এ নিয়মটা মেনেই আমি "বাই" দিয়ে অফলাইন হয়ে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ ফেসবুকে ঘুরে আবার ওয়ার্ড ওপেন করলাম আমি। মাত্র একটা লাইন লেখা হয়েছে।

কিন্তু পরের লাইনে কি লিখব সেটা ভুলে গেছি। আমি প্রথম লাইনটা ডিলিট করে দিলাম। মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। গল্প একদমই বের হচ্ছে না। নাহ, গল্প বের হওয়া খুব দরকার।

খুবই দরকার। লেখালেখি আর কাটাকাটি করতে করতে একটা বেজে গেল। দেখি মাত্র দুই প্যারা লেখা হয়েছে। এখনও গল্পের প্রারম্ভিকাটাই আসে নি। ভাবলাম, টয়লেট করে এসে আবার শুরু করব।

সেজন্য দরজা খুললাম। টয়লেট থেকে আসার পথে আবার মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। বাবা, সামনের দোকান থেকে একটু চিনি এনে দে না! মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল আমার। মুখ ফসকে বেরিয়েই আসছিল, ক্যান, ঘরে কি কাজের লোক নাই? কিন্তু বের হল না। উত্তর না দিয়ে আমি আমার রুমে ঢুকে পড়লাম।

মা বাইরে থেকে বললেন, আর আমার মোবাইলে টাকা ফুরায়ে গেসে বাপ, তুই একটু জহিরের দোকান থেকে ফ্লেক্সি দিয়ে আয় না! নাহ, এ তো দেখি ডাবল ঝামেলা। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এখন বাইরে যাবার কোন মানেই হয় না। একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত টানা লিখলাম। লেখাটা মনে হয় ভালোই হচ্ছে।

আর আমার লেখক ইমেজ তো আছেই। যা-ই লিখি, পাঠক গিলতে বাধ্য। এরই মধ্যে মা দুইবার দরজা ধাক্কিয়ে চিনি এবং ফ্লেক্সির কথা বলে গেছেন, আর আমি সেটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। একটা পর্যায়ে মা হাল ছেড়ে দিয়ে আর বিরক্ত না করে চলে গেলেন। আড়াইটার দিকে ক্লান্ত হয়ে মাথা ধোয়ার জন্য দরজা খুললাম।

দেখি ডাইনিং টেবিলের উপর চিনি রাখা। কে আনল চিনি? বাসায় তো আর কেউ নেই। মা নিজেই নাকি? বাথরুমের দিকে যাচ্ছি, মা বলে উঠল, গোসল করে নে। এখন করব না। কখন করবি? পরে।

কর না। আড়াইটা তো বাজে। তাতে কি? আচ্ছা, চিনি আনল কে? কে আবার, আমি। ক্যান, আমাকে আরেকবার বললেই তো আমি যেতাম। তোমাকে কষ্ট করে যেতে বলেছে কে? না, তুই তো অ-নে-ক ব্যস্ত।

মা ব্যঙ্গ করে বললেন। আমি অনেক ব্যস্ত, না? যুতসই জবাব খুঁজে না পেয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম আমি। মাথা ধুয়ে বের হবার সময় মা আবার গোসল করার কথা বললেন। আমি কোন কথা না বলে রুমে সে দরজা লাগিয়ে দিলাম। তারপর আবার বসলাম পি সির সামনে।

এতক্ষণ যা লিখেছি একবার পড়লাম। ভালোই লাগলো। বেশ ভালো আগাচ্ছি। এরই মধ্যে কিছু রহস্য, ক্লাইম্যাক্স আর ধাঁধাঁ ঢুকিয়ে দিয়েছি গল্পের মধ্যে। পাঠক পড়তে গিয়ে বেশ ধন্ধে পড়ে যাবে।

কিন্তু শেষটায় সব রহস্য ফাঁস হবে। দারুণ একটা হ্যাপি এনডিঙ হবে তখন। আর ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত হবে লেখাটি। আবার লেখা শুরু করলাম। এবার কিছুটা মায়া ও ভালবাসার ব্যাপার আনতে হবে গল্পে।

নাহলে মেয়েরা পড়ে মজা পাবে না। আর মেয়েরা মজা না পেলে লেখকজন্মই বৃথা। সাড়ে তিনটার দিকে খুব ক্ষুধা পেল। কি করা যায়? গোসল না করলে তো মা খেতে দেবে না। কিন্তু না খেলেও তো হবে না।

দরজা খুলে বের হলাম। টেবিলে ভাত নেই। মা! খাব। আগে গোসল কর। আজকে গোসল করব না।

গোসল না করে ভাত খায় নাকি কেউ? পরে করব গোসল। পরে কখন? বিকালে। মা টেবিলে ভাত বেড়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি খেতে হবে। হাতে সময় নেই।

সন্ধ্যায় ৬টার মধ্যে গল্প শেষ করতে হবে। আমার তাড়াহুড়ো দেখে মা বললেন, আস্তে খা বাপ। গলায় বাঁধবে। আমি কিছু বললাম না। হাপুস হুপুস খেতে লাগলাম।

আমি খাইয়ে দেব? মাথা নাড়ালাম। না। তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে পড়লাম। মা বললেন, কি খেলি? পেট ভরল ওইটুকু খেয়ে? আমি কিছু বললাম না। হাত ধুয়ে পি সিতে বসার পর মা পানি দিয়ে গেলেন।

বললেন, গোসলটা করে একটু ঘুমিয়ে নে। আমি পি সি থেকে চোখ না সরিয়েই পানিটা এক ঢোঁকে শেষ করলাম। তারপর বললাম, মা একটা কাজ করছি। তুমি যাও তো। কি কাজ? আহ যাও না।

মা পানির মগ হাতে চলে গেলেন। আমি আবার গল্পে মনোযোগী হলাম। কিন্তু এবার কেন যেন গল্পের ফ্লো হারিয়ে ফেললাম আমি। যা লিখতে চাচ্ছি কিছুতেই মাথায় আসছে না। আর এতক্ষণ যা লিখেছি পুরো ভুয়া মনে হচ্ছে।

ধ্যাত! খুব মেজাজ খারাপ হল আমার। একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসলে কেমন হয়? কিন্তু সময় নেই। একদম সময় নেই হাতে। ছয়টার আগেই শেষ করতে হবে গল্পটা। দেখি, গান শুনলে যদি মাথাটা ক্লিয়ার হয়।

হেডফোন কানে লাগিয়ে Skillet এর It's not me it's you গানটা ছেড়ে দিলাম। এটা আমার অনেক প্রিয় একটা গান। শুনলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। একই গান চার পাঁচ বার শুনলাম। যাক, এখন অনেই ভালো লাগছে।

এবার ধীরেসুস্থে গল্পটা শেষ করি। এভাবেই সাড়ে চারটা বাজল। আমার গল্প তখন অর্ধেকও শেষ হয় নি। পাঁচটা বাজল। সাড়ে পাঁচটা।

হ্যাঁ, গল্পটা অনেকটা গুছিয়ে এনেছি। কাহিনীর গাঁথুনি বোধহয় ভালোই হয়েছে। এবার দারুণ একটা ফিনিশিং দিলেই কেল্লাফতে। আমি ফেসবুকে ঢুকে "ভালোবাসার গল্পকথা" নামের একটা পেজটা ওপেন করলাম। এই পেজটা বিভিন্ন লেখকের লেখা দারুণ দারুণ সব ভালোবাসার গল্প শেয়ার করে।

সেগুলো পড়তে ভালোই লাগে। এই পেজের লাইকার সংখ্যা কয়েকদিন আগেই ৫০০০০ ছাড়িয়েছে। খুঁজে খুঁজে একটা পোস্ট বের করে দশমবারের মত পড়লাম আমি, "...অনুষ্ঠিত হবে "গল্প লেখা প্রতিযোগিতা"। লেখা পাঠানোর শেষ সময়, তেসরা মে সন্ধ্যা ৬টা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা" হ্যাঁ, এই প্রতিযোগিতার একজন প্রতিযোগী আমি নিজেই।

আমি খুব ভালো করেই জানি ভালো কিছু লিখলে আমিই জিতব প্রথম পুরষ্কার। কারণ, ইতোমধ্যে মেয়েভক্তদের মধ্যে আমার জনপ্রিয়তা মারাত্মক। ওরা নিশ্চয়ই আমাকে প্রমোট করবে, আমার লেখা শেয়ার করবে। এখন বাজে ৫টা ৪০; আর মাত্র বিশ মিনিট আছে। আমার গল্পটা শেষ করতে খুব বেশি হলে পনের মিনিট লাগবে।

আর তারপরই... ৫টা ৪৩ এর সময় মা এসে বললেন, কাজলকে কোচিং থেকে নিয়ে আয়। ক্যান? ড্রাইভার কই? আজকে ওর ছুটি। আমি পারব না। তাহলে কে যাবে? কেন ও একা আসতে পারে না? আচ্ছা তুই কি বল তো সরব, এই প্রথম খেপে গেলেন মা, কাজল সেভেনে পড়া একটা মেয়ে, এখন এই শহরের রাস্তায় ও কতটা আনসেফ তুই জানিস? আমার মাথায় তখন কিছুই ঢুকছে না। ওতে শুধু একটাই চিন্তা, গল্প শেষ করতে হবে।

আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, তাহলে তুমি যাও। আমাকে আর ডিস্টার্ব কোর না। মা খুব অবাক হয়ে ধরা গলায় বললেন, আমি যাব? আমি? যাও, বললাম আমি, পি সি থেকে চোখ না সরিয়েই, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে আর ডিস্টার্ব কোর না। মা পাথর হয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি ঝড়ের গতিতে লিখতে থাকলাম।

আমার কানের পাশে, নাকের নিচে জমা হল বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফিনিশিং দেব দেব, ঠিক এই মুহূর্তে কারেন্টটা চলে গেল। মাথা খারাপের মত হয়ে গেল আমার। পি সিতে ইউ পি এস নেই। তারমানে শেষে আমি যা লিখলাম তা "সেভ" হবার আর কোন উপায় থাকল না।

রাগে দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হল আমার। মা তখনও সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ আমার মনে হতে লাগলো যে আজকের ঘটনার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী মা। মা-ই ইচ্ছা করে সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গায় নি, মা-ই ইচ্ছা করে আমাকে চিনি আনতে জোর করেছে, বোনকে কোচিং থেকে আনতে জোর করেছে। মা যদি কথা বলে ঐ সময়টুকু নষ্ট না করত তাহলে এতক্ষণে গল্পটা মেইল করা হয়ে যেত।

মা-কে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে থাকি আমি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই থেমে যাই। ডুকরে কেঁদে উঠি। মায়ের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকি বাচ্চাদের মত।

আর মা দৌড়ে এসে আমাকে বুকে তুলে বলেন, কি হয়েছে সোনা? কি হয়েছে? মা আমাকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেন। মায়ের স্পর্শে আমি যেন বহুদিন আগের সেই ছোট্ট অবুঝ সরব হয়ে যাই। মা আমাকে পাখা দিয়ে বাতাস করেন। পরমের মাঝে একটু আরাম পেয়ে আমি প্রশান্তিতে আঃ আঃ করে উঠি। একটু পরেই তলিয়ে যাই অতল ঘুমে।

বাইরে তখন অজস্র কাকের কা-কা শোনা যায়। *** দশ দিন পর। "ভালোবাসার গল্পকথা" পেজের অ্যাডমিন আসিফ ঘোষণা করল, "...এবার আমি মঞ্চে আহবান করছি, পাঠকের ভোটে এবারের গল্প প্রতিযোগিতার সেরা লেখক, যাকে আপনারা সবাই চিনেন ও জানেন, সেই পাঠকনন্দিত বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদকে"। হুমায়ূন আহমেদ ধীরপায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। দর্শকদের করতালিতে মিলনায়তন যেন ফেটে পড়ছে।

মঞ্চে উঠে হুমায়ূন আহমেদ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আজকে কি দিবস? মিলনায়তন যেন ফেটে পড়ল, মা দিবস! হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমরা কি সবাই মা-কে ভালবাসি? সবাই বলল, বাসি! হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমরা কি শুধু একদিন মা-কে ভালবাসবো? সবাই বলল, না! হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তাহলে আমরা কি প্রতিক্ষণ, প্রতিসময় মা-কে ভালবাসবো? সবাই বলল, হ্যাঁ! হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমরা কখনো, কোন অবস্থাতেই মা-কে ছেড়ে যাব না তো? সবাই বলল, না! হুমায়ূন আহমেদ বললেন, অনেক ভালবাসি তোমাকে... দর্শকরা চিৎকার করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলল, মা!!! হুমায়ূন আহমেদ নিঃশব্দে চোখের জল মুছলেন। শাওনকে বিয়ের পর থেকেই তার মা বেগম আয়েশা ফয়েজ তার সাথে ভালোভাবে কথা বলেন না। মা থেকেও না থাকার মত-এই কষ্ট তার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? হুমায়ূন আহমেদ মাথা নিচু করে মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন। তিনি চান না কেউ তার অশ্রুসজল চোখদুটো দেখে ফেলুক। ঠিক সেই মুহূর্তে সরব তার মায়ের সাথে মিলনায়তনের পিছন দিকের একটা সিটে বসে আছে।

তার দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে টপটপ করে। আমরা যতদূর জানি, সেই অশ্রু "মা-দিবস" উপলক্ষ্যে আয়োজিত "মায়ের জন্য ভালবাসা" শীর্ষক গল্প প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট প্রাইজ না পাবার জন্য নয়। বরং সেই অশ্রু...থাক, সেটা সরব আর তার মমতাময়ী মায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। (সমাপ্ত) লেখকের কথাঃ ১/ এই গল্পের আইডিয়া আমি পাই সামুর ব্লগার "একজন অপদার্থ"র গল্প থেকে। উনার আসল নাম হীরক ওয়াজেদ।

উনাকে না বলেই উনার আইডিয়া হাইজ্যাক করলাম, হা হা। ২/ হুমায়ূন আহমেদ আমাদের তরুণ লেখক প্রজন্মের জন্য সবসময়ই একজন আদর্শ হয়ে থাকবেন। উনাকে না বলে উনার চরিত্রটা ব্যবহার করলাম। আশা করি উনি এটা কখনও দেখতে পেলেও কিছু মনে করবেন না। উনার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.