আমি অতি সাধারণ মানুষ গল্পের ঘটনা সম্পূর্ণ বাস্তব। গল্পের প্রয়োজনে কিছু এদিক ওদিক করেছি। কিন্তু মূল ঘটনা অপরিবর্তিত। কারো কাছে এটা কোন সিনেমার কাহিনী মনে হলে আমার কিছু করার নেই।
[১]
ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছি আমি আর নাবিল।
খিলগাঁও এসে আমাদের রিক্সা জ্যামে পড়ল। ফ্লাইওভারেও আজকাল কাজ হচ্ছে না। এই ফ্লাইওভার না থাকলে কি হত আল্লাহ্ মালুম।
জ্যামে বসে আমরা দেশ ও দশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। কি করলে দেশের উন্নতি হবে, ঢাকা শহরের জ্যাম দূর করা যাবে এসব নিয়ে জ্ঞনগর্ভ কথাবার্তা হচ্ছে আমাদের মধ্যে।
তবে শেষমেশ আলোচনা এসে ঠেকল আমাদের ডিপার্টমেন্টে এ বছর ভর্তি হওয়া দুজন মেয়েকে নিয়ে। তাদের নিয়ে কি আলোচনা হচ্ছিল আমাদের মাঝে তা এখানে বলাটা সমীচীন মনে করছি না। খুশবন্ত শিং তার “ট্রেন টু পাকিস্তান” উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন উপমহাদেশের মানুষ একত্র হয়ে যেই বিষয় নিয়েই আলোচনা শুরু করুক না কেন, তার শেষটা হয় যৌনতায়। কথাটা উনি খুব একটা ভুল বলেন নাই। আমরা দুইজনও যেহেতু এই উপমহাদেশের বাইরের কেউ নই, আমাদের আলোচনাও তার সূত্রানুসারেই এগিয়ে চলছে।
জ্যাম ছেড়েছে। আমাদের রিক্সা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমি তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটা দেখলাম। আমাদের উল্টা দিকের রাস্তায় রিক্সায় করে নুহা আপু যাচ্ছে। নুহা আপুকে দেখে আমি অবাক হইনি, অবাক হয়েছি তার পাশে বসা মানুষটাকে দেখে।
বলা ভাল স্তম্ভিত হয়েছি। শাহেদ ভাই বসে আছে নুহা আপুর পাশে! চার বছর আগে মারা যাওয়া মানুষটি আবার কোন জাদুবলে আজ নুহা আপুর পাশে বসে আছে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
নুহা আপু আমাকে দেখেনি। ওনাদের রিক্সা আস্তে আস্তে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। আমি স্তদ্ধ হয়ে রিক্সায় বসে আছি।
আমার মাথা কাজ করছে না।
[২]
নুহা আপুরা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত। পাশাপাশি থাকার কারণে আমার আম্মার সাথে ওনার আম্মার ঘনিষ্ঠতা হয়। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মাঝে মধ্যে কম্পিউটার গেম খেলার জন্য নুহা আপুর বাসায় যেতাম।
NFS আর Road Rush গেম খেলে বিমল আনন্দ লাভ করতাম।
আমাদের প্রতিবেশি হওয়ার এক বছরের মাথায় নুহা আপুর বিয়ে হয়। আপু তখন ভার্সিটির থার্ড ইয়ারে পড়ত। ধুমধামের সাথেই তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেন জামিল আঙ্কেল । শাহেদ ভাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভাল চাকরি করে।
শান্তিনগরে নিজেদের বাড়ি আছে। বিয়ের পর নুহা আপু শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ওখানে থেকেই ভার্সিটিতে পড়াশুনা করত।
সবকিছু সুন্দরভাবে চলছিল। আঙ্কেল আন্টি তাদের মেয়ের বিয়ে দিয়ে খুশিই ছিলেন।
নুহা আপুও সুখেই ছিল। কিন্তু এক বছর পরই সমস্যা দেখা দেয়। শাহেদ ভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পরে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পরেনি। ক্যান্সার শাহেদ ভাইয়ের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
ডাক্তাররা বললেন ওনার আয়ু আর বড়জোর ছয় মাস।
হঠাত করেই এত সুন্দর, হাসিখুশি পরিবারটায় শোকের ছায়া নেমে এল। আঙ্কেল মনমরা হয়ে বসে থাকেন। আন্টি আম্মার কাছে এসে কান্নাকাটি করেন। আমিও নুহা আপুদের বাসায় আর গেম খেলতে যাই না।
চারিদিকেই একটা নিরানন্দ পরিবেশ।
অনেকেই বলেছে শাহেদ ভাই জেনেশুনে ইচ্ছা করেই তার ক্যান্সারের কথা গোপন করেছে। নুহা আপুর তাই শাহেদ ভাইকে ডিভোর্স দেয়া উচিত। নুহা আপু এসব কথায় কান দেননি। তিনি এসব কথা বিশ্বাসও করেননি।
আমাদের বাসায় একবার নুহা আপু আসলে আম্মার সাথে তার কথাবার্তা শুনে আমি এটা বুঝতে পারি।
-না আন্টি, ও কখনি এটা করেনি।
-তুমি শিওর নুহা?
-আমি শিওর, নুহা আপু আত্মবিশ্বাসের সাথে মাথা নাড়ে।
-আমার কিন্তু মনে হয় শাহেদ তোমার সাথে ফ্রড করেছে। ও বিয়ের আগেই এটা জানত।
-না আন্টি। আমি হয়ত মাত্র এক বছর ওর সাথে সংসার করেছি, কিন্তু ও যে আমার সাথে মিথ্যা বলেনি এটা শিওর। ও যদি মিথ্যা বলত আমি বুঝতে পারতাম।
আম্মা মাথা নাড়লেন। -হবে হয়ত।
তা এখন কি করবে?
-দেখি আন্টি কি করা যায়। অন্যান্য ডাক্তার দেখাচ্ছি। দোয়া করবেন।
-দোয়াতো সবসময় করি। তা বাইরে নিয়ে যাবে?
-দেখি আন্টি।
এখনো শিওর না, বলে নুহা আপু উঠে দাঁড়ালেন। আজকে যাই আন্টি।
-আচ্ছা।
আমারও নুহা আপুর কথাটাই সত্যি বলে মনে হত। নুহা আপুর মত চমৎকার একজন মানুষের সাথে কেউ প্রতারণা করেছে এটা মানতেই কষ্ট হয়।
আমি নুহা আপুর কথাই বিশ্বাস করতাম। শাহেদ ভাই ওনার সাথে প্রতারণা করেনি। উনি বিয়ের পরই ওনার অসুস্থতার কথা জানতে পারেন।
শাহেদ ভাইয়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। ধীরে ধীরে উনি স্মৃতিশক্তি হারাতে শুরু করেন।
মানুষজনকে আর চিনতে পারেন না। ঠিকমত আর খাওয়া দাওয়া করতে পারেন না। ছোট বাচ্চাদের মত বিছানাতেই পেসাব পায়খানা করেন দেন। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি করেন। নুহা আপু ক্লান্তিহীনভাবে ওনার সেবাযত্ন করে যান।
কখনই ওনাকে ভেঙে পড়তে বা ধৈর্য্যহারা হতে শুনিনি।
একদিন বিকেলে আমি আম্মার সাথে মার্কেটে যাই। নুহা আপুর শ্বশুরবাড়ি মার্কেটের পাশেই। কেনাকাটা শেষে আমরা শাহেদ ভাইদের বাসায় যাই। বাসায় ঢুকে দেখি নুহা আপু ভাত খাচ্ছে।
তখন ছয়টা বাজে। আম্মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন- এখন খাচ্ছ যে?
-ও আজকে সারাদিন খুব চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। বাসায়ও কেউ ছিল না। একটু আগে খাওয়া দাওয়া করিয়ে শুইয়ে দিয়েছি। তাই দেরি হয়ে গেল।
-আর মানুষজন কোথায়?
-রত্না ভার্সিটি গিয়েছে। ওর আজকে পরীক্ষা। আর বাবা-মা রাজশাহী গিয়েছে।
-রাজশাহী কেন?
-শুনেছে ওখানে নাকি কোন পীর আছে, ঐ পীরের পানিপড়া খেলে যেকোন রোগ ভাল হয়ে যায়। ঐ পানিপড়া আনতে গেছে।
আমি অবাক হয়ে নুহা আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। ওনার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। উনি এই একবছরে কত পরিবর্তিত হয়ে গেছেন। বাবা-মায়ের আদুরে সেই মেয়েটিই এখন স্বামীর প্রতি নিষ্ঠাবান একজন স্ত্রী। যে শত ক্লান্তির মাঝেও স্বামীর প্রতি দায়িত্ব পালনে পিছপা হয় না।
হঠাৎ ভিতরের রুম থেকে চিৎকার ভেসে এল। শাহেদ ভাইয়ের ঘুম ভেঙে গেছে। নুহা আপু খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলেন। হাত ধুয়ে আপু শাহেদ ভাইয়ের রুমে গেলেন। আমরাও তার পিছু পিছু শাহেদ ভাইয়ের রুমে গেলাম।
শাহেদ ভাই বিছানায় পেসাব করে দিয়েছেন। নুহা আপু শাহেদ ভাইকে ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। ওনাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে এনে চেয়ারে বসালেন। শাহেদ ভাই চুপচাপ বসে আছেন। কোন কথা বলছেন না।
মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। নুহা আপু বিছানার চাদুর পাল্টে নতুন চাদুর বিছিয়ে শাহেদ ভাইকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলেন। শাহেদ ভাইও কোন প্রতিবাদ না করে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
আমরা চুপচাপ সবাই রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। নুহা আপু আবার হাত ধুয়ে খেতে বসলেন।
আম্মা বললেন-শাহেদ কি এখন বিছানাতেই পেসাব-পায়খানা করে সবসময়?
নুহা আপু খেতে খেতে উত্তর দেন- সবসময় না। মাঝে মাঝে।
-শাহেদ কি কাউকেই চিনতে পারে না এখন?
-আবছা আবছা। কথাবার্তাও ঠিকমত বলতে পারে না। জড়িয়ে যায় মুখে।
আমি আর আম্মা খুব বেশিক্ষণ বসলাম না। নুহা আপুর খাওয়া শেষ হলে কিছুক্ষন কথাবার্তা বলেই বেরিয়ে পড়লাম।
দুইমাস পরে শাহেদ ভাই মারা যান। তার মৃত্যুর পর নুহা আপু তার বাবার বাসায় চলে আসে। সময় গড়িয়ে যায়।
নুহা আপু একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেন। তার বাবা-মা আবার তাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। অনেক প্রস্তাব আসে তার বিয়ের জন্য। তার কথা শুনে অনেক অবিবাহিত ছেলেও তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায়। উনি রাজি হন না।
ওনার বাবা-মাও জোর করেন না। মেয়ে একবার বড় ধরণের আঘাত পেয়েছে। আরেকবার কিছু হোক এটা তারা চান না।
ইতিমধ্যে টঙ্গীতে নুহা আপুদের নিজস্ব বাড়ি নির্মানের কাজ শেষ হয়। ওনারাও চলে যায় টঙ্গী।
আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে যায়। মাঝে মাঝে ফোনে আম্মার সাথে আন্টির কথা হয়। দেখা সাক্ষাৎ আর হয় না। দূরত্ব মানুষের মধ্যে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়।
[৩]
আমি বাসায় ফিরলাম।
রিক্সার ঘটনাটা আম্মাকে বললাম। আম্মা তখন আমাকে আরেকটা বিস্ময়কর খবর দিলেন।
-তোকে বলতে ভুলে গেছি মুহিত। গত মাসে নুহার বিয়ে হয়েছে। নুহার এ জামাইয়ের চেহারাও অনেকটাই শাহেদের মত।
-অনেকটা কি! আমি তো ওনাকে শাহেদ ভাই মনে করেছিলাম। উনি কি শাহেদ ভাইয়ের কোন আত্মীয়?
-না। ওর সাথে শাহেদদের কোন সম্পর্কই নেই। শাহেদের বাড়ি হবিগঞ্জ, আর নতুন জামাইয়ের বাড়ি কুষ্টিয়া।
আমি অবাক হয়ে ভাবি আল্লাহ্ সুবাহানাহুওতাআলার সৃষ্টির রহস্য।
সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি মানুষের কি অপূর্ব মিল! মানুষের ভাল কাজের প্রতিদান আল্লাহ্ দেন। শাহেদ ভাইয়ের প্রতি নুহা আপুর অসাধারণ আত্মত্যাগের বদৌলতে আল্লাহ্ এই পৃথিবীতেই শাহেদ ভাইকে আবার পাইয়ে দিয়েছেন। এ যেন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নুহা আপুর প্রতি এক উপহার।
©Muhit Alam
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।