গত কয়েকদিন ধরেই ববকে মনমরা, বিমর্ষ দেখা যাচ্ছে। এমনিতে কেউ বুঝবে না। কিন্তু আমার সাথে ববের ঘনিষ্ঠতা বেশি বলে আমি ব্যাপারটা টের পেয়েছি। আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। হয়ত কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার।
মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমার ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভাল লাগে না। ববের কিছু বলার থাকলে ও এমনিতেই আমাকে বলবে।
ঠিক সাতটার সময় বব আবার আমার ডেস্কের সামনে আসল। এই মানুষটা এত সুন্দর সময় মেনটেন করে কিভাবে? ওকে কোনদিন আমি অফিসে দেরি করতে দেখিনি। অফিসে কেন, কোন জায়গায়ই সে দেরি করেনা।
আমি ববের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ও আসতেই দুজনে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
বব চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করছে। আমি ওর পাশে বসে আছি। প্রায় দশ মিনিট ধরে গাড়ি চালানোর পর বব মুখ খুলল।
-শাহেদ, তুমি কত বছর ধরে আমেরিকায় আছ?
-আট বছরেরও বেশি।
-এখানেতো তোমার কোন আত্মীয়স্বজন নেই?
-না নেই। তবে আমি বাংলাদেশের যেই এলাকায় থাকি, ওখানের এক বড় ভাই আছে।
-তোমার মত আমারও কোন আত্মীয়স্বজন নেই আমেরিকায়।
-আমি জানি।
তুমি আগেই বলেছ।
-আচ্ছা শাহেদ, তোমার কি কখনও একা, একা লাগে? এই যে কেউ নেই, কোন আত্মীয়স্বজন নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, খারাপ লাগে না?
-প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। খুবই অসহায় লাগত। অফিস থেকে বাসায় গিয়ে কিছুতেই সময় কাটত না। তবে বিয়ে করে নিধিকে আমেরিকা নিয়ে আসার পর একাকীত্ব কেটে গেছে।
-তোমার বাচ্চা কেমন আছে শাহেদ?
-আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছে। ও তোমাকে খুব পছন্দ করে বব। তুমি ওর জন্য যে পুতুলটা নিয়ে গিয়েছিলে, সারাক্ষণই ওটা দিয়ে খেলে।
বব হাসল। -তোমার মেয়ের বয়স জানি কত?
-দু’বছর দু মাস হল।
-তোমার স্ত্রীকে তুমি খুব ভালবাস, তাইনা?
আমি হাসলাম। -হ্যাঁ।
-তোমার সাথে ওর পরিচয়টা কিভাবে হয়েছিল?
আমি কিছুটা অবাক হলাম। বব আগেও আমাকে এই প্রশ্নটা কয়েকবার করেছে। আমিও প্রতিবার জবাব দিয়েছি।
আজ সে আবারো এই প্রশ্নটা কেন করল বুঝলাম না। তবে আমি উত্তর দিলাম আবারো। -বিয়ের আগে ওর সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না। আমার বাবা-মা ওকে দেখে পছন্দ করে। আমিও ওকে দেখে পছন্দ করি।
ওর পরিবারও আমাকে পছন্দ করে। আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।
-তুমি খুব লাকি শাহেদ।
-তোমার কি মন খারাপ বব?
বব মাথা নাড়ল। -আমার মন ভীষণ খারাপ।
-কেন, জানতে পারি?
-তোমাকে জানানোর জন্যইতো নিয়ে এসেছি শাহেদ। একটু অপেক্ষা কর। আগে রেস্টুরেন্টে যাই।
বাকি পথ আর কথা বলল না বব। চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে গেল।
বিশ মিনিটের মধ্যে আমরা রেস্টুরেন্টে পৌছে গেলাম। খুব বড় কোন রেস্টুরেন্ট নয়। খুব একটা ভিড়ও নেই আজকে। কোনার দিকে একটা টেবিলে বসলাম আমরা। ওয়েটারকে খাবারের অর্ডার দিল বব।
-আমি তোমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছি বলতে পারবে শাহেদ?
-কেন?
-গত সোমবার আমি লিয়ানাকে এখানে অন্য একটা ছেলের সাথে ডিনার করতে দেখেছি।
আমি ছোটখাট ধাক্কা খেলাম। লিয়ানা ববের স্ত্রী। বব লিয়ানাকে খুব ভালবাসে। আমি বললাম- হয়ত ওর কোন কলিগের সাথে এসেছিল।
বব হাসল। দুঃখের হাসি। -আমি ওদের দুজনকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছি।
আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। লিয়ানাকে বব এত ভালবাসে, আর এই মেয়েটা ববের সাথে এরকম করল!
-তুমি যে চেয়ারটায় বসে আছ, ওটাতে ঐ ছেলেটা বসেছিল।
আর আমার চেয়ারটায় বসেছিল লিয়ানা।
আমি এবারো কিছু বললাম না। চুপচাপ ববের কথা শুনে গেলাম।
-তোমাকে আমি বারবার তোমার আর নিধির কথা কেন জিজ্ঞেস করি জানো? কারণ তোমাদের কথা শুনতে আমার ভাল লাগে। বিয়ের আগে তোমাদের কোন পরিচয়ই ছিল না।
অথচ তোমরা আজ প্রায় চার বছর হল সংসার করছ। লিয়ানার সাথে আমার পরিচয় প্রায় চার বছরের। এ বছর বিয়ে করলাম। কিন্তু আমাদের এই সংসার এক বছরও টিকবে না মনে হয়।
-বব, বাদ দাও এসব কথা।
তোমার মন আরো খারাপ হবে।
বব আমার কথা শুনল বলে মনে হল না। ও বলে চলল- লিয়ানার জন্যই আমি আজ আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আমেরিকায় এসেছি। ও এখানে খুব ভাল একটা জব পায়। আমি ওকে অনেক মানা করেছিলাম এখানে আসতে, ও শুনল না।
ও ওর ক্যারিয়ারের জন্য এখানে আসল। আমিও একটা চাকরি জুটিয়ে এখানে চলে আসি সবকিছু ছেড়েছুড়ে। কিন্তু ও এখন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
-তুমি ২০-২৫দিন ছুটি নিয়ে লিয়ানাকে নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ঘুরে আস। সবকিছু দেখবে আবার আগের মত হয়ে যাবে।
বব মাথা নাড়ল। -কিছুই আগের মত হবে না শাহেদ। লিয়ানার সাথে সম্পর্কের আগে আরো দুজনের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। ওদের সাথে ব্রেক-আপের পর আমি এতটা ভেঙ্গে পড়িনি। লিয়ানার সাথে সম্ভবত আমার ডিভোর্স হয়ে যাবে।
আমি ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব শাহেদ? ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।
-তুমি ছুটি নেও বব। ছুটি নিয়ে লিয়ানাকে নিয়ে ঘুরে আস। সম্পর্কটা তাহলে মনে হয় ভাঙবে না।
-তুমি প্রতিদিন কয়টায় বাসায় ফিরো? আমার দিকে হঠাৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল বব।
-রাত প্রায় ন’টার মত বাজে, কেন?
-এই যে তোমার বাসায় ফিরতে এত রাত হয়, নিধি কখনও তোমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলে?
-নাতো। কেন?
-আমারও রাত নয়টার মত বাজে বাসায় ফিরতে। লিয়ানার সবচেয়ে বড় অভিযোগ এটা নিয়ে। আমি নাকি ওকে সময় দেই না। সারাদিন শুধু কাজ নিয়েই পড়ে থাকি।
এটা নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে ওর সাথে আমার সম্পর্ক খুব খারাপ যাচ্ছে। অথচ ইংল্যান্ডে আমি যে চাকরি করতাম, তাতে এত কাজের প্রেসার ছিল না। আমি লিয়ানাকে যথেষ্ট সময় দিতে পারতাম। ওর কারণেই সব ছেড়েছুড়ে এখানে আসলাম। আর এখন ঐ আমার দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ে দিচ্ছে।
-বব তুমি ভেঙে পড়ো না। এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। তুমি ছুটি নাও। লিয়ানাকে সময় দাও।
-আজকে তোমার সাথে আমি কেন ডিনারে এসেছি জানো?
-কেন?
-গত তিন সাপ্তাহ ধরে আমি প্রতিদিন একা একা ডিনার করি।
লিয়ানা প্রতিদিনি বাইরে থেকে খেয়ে আসে। আজকে ওকে আমার সাথে ডিনার করতে বলেছিলাম। ও স্রেফ বলে দিয়েছে ওর অন্য প্রোগ্রাম আছে।
আমার ববের জন্য খুব খারাপ লাগল। এই সদা হাস্যময়, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা চল্লিশোর্ধ মানুষটি আমার সামনে শিশুর মত কাঁদছে।
আমি কি বলে ওকে সান্ত্বনা দিব ভেবে পাচ্ছি না। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
একটু পর বব চোখ মুছে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল- তোমাকে দেখলে আমার ভীষণ হিংসা হয় শাহেদ। তোমরা একজন আরেকজনকে বিয়ের আগে কখনও দেখনি, অথচ কি সুন্দরভাবেই না তোমরা সংসার করছ! তোমাদের কালচার অনেক সুন্দর।
আমার জন্ম যদি ইংল্যান্ডে না হয়ে বাংলাদেশে হত!
ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। বব চুপচাপ খেতে থাকল। আর কোন কথা বলল না।
দুই সাপ্তাহ পরে ববের সাথে লিয়ানার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বব মনমরা হয়ে অফিসে আসে।
কাজ শেষে আবার চলে যায়। আমি ওকে কয়েকবার আমার বাসায় যেতে বলেছি, ও যায়নি। কয়েকদিন ডিনারে যাওয়ার জন্য বলেছি। ও তাও এড়িয়ে গেছে। অফিসের সদা হাসোজ্জ্বল এই মানুষটি হঠাৎ করেই একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়।
তিন মাস পর ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি বব আত্মহত্যা করে। ঐদিন ছিল তার ৪৩তম জন্মবার্ষিকী। আমি রাতে ওকে উইশ করে একটা মেইল পাঠাই। ও আমাকে ফিরতি একটা মেইল পাঠায়। এটাই আমাকে করা ববের শেষ মেইল।
তাতে লেখা ছিল- যে হাতটা তুমি ধরেছ, মৃত্যু ব্যতীত সেই হাত তুমি ছেড়োনা। তোমাদের জন্য শুভকামনা।
[ পরিহাসের কথা হচ্ছে বব যেই কারণে বাংলাদেশে জন্মাতে চেয়েছিল, সেটা আস্তে আস্তে এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। পাইকারি হারে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমদানির সাথে সাথে আমরা প্রেম প্রেম খেলা, ব্রেক-আপ ব্রেক-আপ খেলাও আমদানি করেছি। এই খেলা চলতে থাকলে অচিরেই এদেশেও অনেক ববের দেখা মিলবে।
]
উৎসর্গঃ এদেশের তরুণ প্রজন্মকে।
আমি এদেশে কোন বব দেখতে চাই না।
©Muhit Alam ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।