আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিএনএ টেষ্টঃ প্রথম পাঠ; টেষ্টটিউব বন্দি রহস্যের জাল ভেদ করে বেরিয়ে এলো মিসেস নাতাশার খুনী...

আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে তুমি তোমার বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেছো... নিজ বাসায় নির্মমভাবে খুন হয়েছেন প্রখ্যাত পরিবেশবাদী আইনজীবী মিসেস নাতাশা। স্বামী কর্মসুত্রে ঢাকার বাইরে থাকাতে সুযোগ নিয়েছে হত্যাকারী। আশ্চর্যজনকভাবে কিছুই খোয়া যায়নি ফ্ল্যাট থেকে। বেশকিছুদিন থেকেই নগরীর এক ভুমি দস্যুর কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছিলেন তিনি। অপরাধ-- অবৈধভাবে নদী ভরাট করে এবং নদী-তীরবর্তি অংশে গাছ কেটে প্রায় ১০০ একর জায়গাতে সুবিশাল রিসোর্ট তৈরিতে বাধ সেধেছেন মিসেস নাতাশা।

সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে মামলা। ক’দিন বাদেই শুনানি। ঠিক এইসময়েই এই তিনি শিকার হলেন এই নৃশংস হত্যাকান্ডের। অত্যন্ত চতুর পেশাদার খুনিই ঘটিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড; প্রাথমিকভাবে এমনটিই ধারনা পুলিশের। দৃশ্যত কোন আলামতই রেখে যায়নি খুনি; এমনকি খুনে ব্যবহ্রত ধারালো অস্ত্রটিও পাওয়া যাচ্ছেনা।

হাইপ্রোফাইল কেইস হিসেবে আলামত সংগ্রহে নেমে পড়লেন চৌকস সিআইডি কর্মকর্তা মি. রিয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজি তে অনার্স-মাষ্টার্স শেষে কমনওয়েলথ স্কলারশীপ নিয়ে আবার মাষ্টার্স করেছেন লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে- ক্রাইম ফরেনসিকস এ এবং যার সামার ইন্টার্নশীপ ছিল এলজিসি ফরেনসিকসে। কিছুদিন কাজ করেছেন ইউকে’র ফরেনসিক সায়েন্স সার্ভিসে। দেশে ফিরেই যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ সিআইডির একজন ফরেনসিক এক্সপার্ট হিসেবে। অনেক কিছুই সংগ্রহ করছেন নিবিড় চিন্তামগ্ন হয়ে; খুব সাবধানে এবং সযত্ন।

মিসেস নাতাশার মেঝেতে গড়িয়ে যাওয়া রক্ত, ছিটকে পরা টিস্যু, রুমের কোনায় ছিটিয়ে থাকা কিছু চুল; পরিধেয় কাপড়, কাগজপত্র। সবকিছু দেখে মি রিয়াজের বুঝতে অসুবিধে হয়না হাতে গ্লাভস ব্যবহার করেছে খুনি। হটাৎ চোখ আটকালো বেডের কোনে সাইড টেবিলে রাখা গ্লাস আর পানির বোতলে। আধাগ্লাস পানি যেন টানেলের ফাকে এক চিলতে আলোর মত ধরা দিল মি. রিয়াজের কাছে। নিজের অজান্তেই বলে উঠলেন—গট ইট!! হত্যাকান্ডের ১০তম দিন… স্থানঃ সিআইডি ভবনের মিডিয়া কমিউনিকেশন ফ্লোর… সকাল ১০টা।

জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন। হাতবেধে কড়া পাহারায় হাজির করা হলো সেই খুনি কে…বেরিয়ে এসেছে রহস্য। খুনি চিহ্নিত এবং মোটিভও পরিস্কার । পূর্ব-ধারনা অনুযায়ী সেই ভুমি দস্যুর প্রত্যক্ষ ইন্ধনেই খুন করা হয় প্রখ্যাত আইনজীবি মিসেস নাতাশাকে… খুনের আগে সম্ভাব্য সবধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয় যাতে খুনীকে কোনভাবেই সনাক্ত করা সম্ভব না হয়। পার পেলনা খুনী।

ঠান্ডা মাথায় খুনের পর গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়েছিলেন সেই রাতে খুনী সুব্রত রাইন । খুন হওয়ার পুর্বে;সম্ভবত বাসায় ফিরেই একই গ্লাসে পানি খেয়েছিলেন মিসেস নাতাশা। অবশেষে মিসেস নাতাশার রক্ত, টিস্যু ও পরিবারের ডিএনএ’র সুত্র ধরে সেই গ্লাসের গায়ে লেগে থাকা হাল্কা লিপিষ্টিক থেকে আলাদা করা হয় মিসেস নাতাশার ডিএনএ। অন্যদিকে গ্লাসের মুখ থেকে পাওয়া গেছে খুনীর স্যালাইভা এবং আলাদাকৃত সেই ডিএনএ ল্যাব টেষ্ট রিপোর্ট মিলে গেছে সন্দেহভাজনদের একজনের সাথে। অন্যান্য এভিডেন্স এবং জটিল ইন্টারোগেশন কনফার্ম করেছে সুব্রত রাইনই ছিল সেই রাতের খুনী… এবার আসুন জানি কিভাবে সম্ভব হয় এটা…… পটভূমিঃ সাগর রুণি হত্যাকান্ডের কয়েকমাস পর হটাত সবাইকে একটু নাড়াচাড়া দিয়েছে র্যা ব এর ডিএনএ টেষ্ট বিষয়ক সংবাদ।

যদিও এর ফলাফল জানতে আমাদের আরো কিছুদিন (?) অপেক্ষা করতে হবে। সাগর-রুনি হত্যাকান্ডে ডিএনএ পাওয়া যাবে এটা স্বাভাবিক—কিন্তু হত্যাকারীর ডিএনএ কার সাথে ম্যাচ করবে (!!)এটা নিয়ে আমাদের আগ্রহের কমতি নেই। মানুষের অল্প-বিস্তর আগ্রহ কে একটু উষ্কে দেয়াই এই পোষ্টের উদ্দেশ্য। পড়াশুনা ও কাজকর্মের সুবাদে কিছুটা জানাশুনা আছে তাই এই অপচেষ্টা। দুই পর্বে বিভক্ত এই পোষ্টের প্রথম পর্ব বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং এতে ডিএনএ টেষ্ট সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব (বিরস বদনে)।

দ্বিতীয় পর্বে থাকবে এর সুবিধা-অসুবিধা, কিছু বিখ্যাত কেইস ষ্টাডি, কিছু আইনগত দিক এবং সম্ভাবনার কথা... শুরুতেই জানতে হবে --ডিএনএ আসলে কি? আমরা দেখতে আমাদের বাবা-মা দের মতোই কিংবা একটা হাতির বাচ্চা দেখতে তার মা এর মত। কিন্তু কেন? আমরা অন্যকিছুর মত কিংবা হাতির বাচ্চাটা বাঘের অনুরুপ হতে পারতো। এখানেই রহস্য লুকিয়ে। আর এই রহস্য পেছনে আছে একধরনের মলিকুল যার নাম ডিএনএ বা ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড। এই মলিকুল একজন মানুষের সারাদেহের প্রতিটা কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে এরা অত্যন্ত শক্তভাবে ক্রোমোজোম নামক একটি কাঠামোতে আবদ্ধ থাকে(অন্য জায়গা- যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া তেও পাওয়া যায় অল্প পরিমানে)এবং সব জায়গায় একই রকম গঠন ও কাজ।

এই ডিএনএ তৈরি হয় মুলত চার ধরনের রাসায়নিক অনু (বেইস) দিয়ে—যাদের কে বলা হয় ১। এডিনিন (A), ২। গুয়ানিন(G) ৩। সাইটোসিন (C), ৪। থাইমিন (T)।

এবং মানুষের ডিএনএ তে প্রায় ৩ বিলিয়ন (জ্বি, আপনি ঠিকই পড়েছেন- ৩ বিলিয়ন!)এই চার রকম বেইস থাকে। এই ডিএনএ তে দুটি স্ট্র্যান্ড থাকে এবং বেইসগুলো একটি আর একটির সাথে যুক্ত অবস্থায় থাকার কারনেই (এডিনিন সাইটোসিনের সাথে এবং গুয়ানিন থাইমিনের সাথে) এটি দেখতে অনেকটা মই এর মত। ডিএনএ’র কাজ কি? শুরুতেই যেমনটা বলেছি আমরা দেখতে আমাদের বাবা-মা’দের মত হই এই ডিএনএ এর কারনেই। অর্থাৎ, বংশগতির ধারক ও বাহক এই ডিএনএ। আমার গায়ের রঙ কি হবে, আমার চুলের রঙ কালো না ব্লন্ড হবে, লম্বা না খাটো হব, রাগি না শান্ত হব এর সবকিছুই নির্ধারিত করে দেয় ডিএনএ।

আমাদের জন্মের সময় আমাদের বাবা’র কাছ থেকে পাই এর অর্ধেক অংশ এবং মা’এর কাছ থেকে আসে বাকি অর্ধেক ডিএনএ। (কিন্তু আমাদের মাইটোকন্ড্রিয়াতে যে ডিএনএ আছে তার পুরো্টাই আমরা পাই মা এর কাছ থেকে। কেননা শুক্রানুর মাইটোকন্ড্রিয়া নিষেক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়না। ) সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই যে, ৯৯ ভাগ মানুষের ডিএনএ একই রকম। মাত্র ১ভাগ ডিএনএ ই নির্ধারন করে দেয় আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য! এখন প্রশ্ন হল কিভাবে এই ডিএনএ বাবা-মা’এর বংশগত (জেনেটিক)তথ্যসমুহ তাদের সন্তানদের মাঝে বহন করে নিয়ে যায়? এর উত্তর জানতে হলে আমাদের একটু ভেতরে যেতে হবে।

আমাদের শরীরে ডিএনএ’র পুরো অংশ জুড়েই কিন্তু বাবা-মা এর তথ্য সমুহ থাকেনা। এই ডিএনএ’র কিছু অংশ কার্যকর অর্থাৎ সেইসব অংশই শুধু মাত্র তথ্য বহন করে এবং পরবর্তি জেনারেশনে তা ছড়িয়ে দেয়। এই কার্যকর অংশটিকে বলা হয় “জ়িন”—আমাদের শরীরে যার সংখ্যা মাত্র ২০ হাজারের মত। এবং যেহেতু আমাদের শরীরে প্রত্যকটা ক্রোমোজম জোড়ায় জোড়ায় বিদ্যমান তাই প্রত্যকটা “জিন” এর একটি করে হুবুহু কপি থাকে যাদের কে বলা হয় একটি আরেকটির এলিল (allele)। এই জিন-ই মুলত আমাদের শরীরে প্রোটিন তৈরির মাধ্যমে সমস্থ তথ্য পাচার করে দেয়! ডিএনএ’র বাকি অকার্যকর অংশ (আপাত ভাবে)কে বলা হয় জাঙ্ক ডিএনএ।

এবার আসি ডিএনএ টেষ্ট কি এই প্রসঙ্গে? যেমন্ টা আগেই উল্লেখ করেছি মাত্র ১ ভাগ ডিএনএ-ই মানুষের সাথে মানুষের পার্থক্য গড়ে দেয় (আকার ও বৈশিষ্টগত)। বিজ্ঞানীরা ঠিক এই ভ্যারিয়েশনটাকেই কাজে লাগিয়েছেন ডিএনএ টেষ্ট এর আইডিয়াতে। এই ১ ভাগ ডিএনএ তেই গঠনগত পার্থক্য সাধারণত প্রত্যেকটি মানুষ্কে আলাদা আলাদা এবং দুজন মানষের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। এই ১ ভাগ ডিএনএ’র যেসব অংশ জিন তৈরিতে কাজে লাগেনা (নন কোডিং)সেসব অংশে বেইস গুলো (এডেনিন, গুয়ানিন ইত্যাদি) রিপিটেটিভ আকারে থাকে; যেমন-ATTCGATTCGATTCG. কমপক্ষে ১ টি বেইস এর পার্থক্য কেই টার্গেট করে আলাদা করা যায় দুজন ভিন্ন ব্যক্তিকে। এই টেষ্টে ডিএনএ’র ১৩টা অংশে (লোসাই)এর বেইস সমুহ কে পরিক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়।

এই স্পেসিফিক ১৩ টা অংশেই দুজন ভিন্ন ভিন্ন (অনাত্মিয়)মানুষের ডিএনএ’র গঠন হুবুহু একই রকম হবে এমন সম্ভাবনা প্রায় শুন্য (৬ মিলিয়নে ১ টা)। দুজন যময ব্যক্তির (আইডেন্টিক্যাল টুইন)ডিএনএ’র ১৩ টা অংশ প্রায় একই রকম হবে। তবে পরিক্ষাগারে দুইটি ডিএনএ’র কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ টা অংশে মিল পাওয়া গেলেই ধরে নেয়া হয় এই দুটি ডিএনএ একই ব্যক্তির। কিভাবে করা হয় এই ডিএনএ টেষ্ট? সাধারনত উন্নত বিশ্বের প্রতিটা দেশেরই ডিএনএ প্রোফাইল ডাটাবেইস আছে। এটা হতে পারে তাদের দেশের মানুষের ডিএনএ থেকে তৈরি করা কিংবা শুধু ক্রিমিনালদের ডিএনএ নিয়ে তৈরি করা।

কোন একটা ক্রাইম সংঘটিত হওয়ার পর সেখান থেকে অপরাধীর জ্ঞাতসারে কিংবা অজান্তে রেখে যাওয়া আলামত থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে ডাটাবেইস এর ডিএনএ’র সাথে কিংবা সন্দেহভাজন দের ডিএনএ সংগ্রহ করে ওই ১৩ টা অংশের গঠন মিলিয়ে দেখা হয়। আলামতের ডিএনএ’র সাথে যে অপরাধির কিংবা সন্দেহভাজনের ডিএনএ’র এই ১৩টা অংশে মিল বেশি পাওয়া যায় তাকে ঘিরেই সাধারনত তন্দন্ত এগুতে থাকে-এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনিই মূল অপরাধি হিসেবে চিহ্নিত হন। ক্রাইম জোন আলামত থেকে ডিএনএ সংগ্রহঃ ভয়ঙ্কর মারাত্মক পেশাদার না হলে সাধারনত সব অপরাধিই কিছু না কিছু আলামত রেখে বা ফেলে যায় যা থেকে পরবর্তিতে তার বা তাদের ডিএনএ উদ্ধার সম্ভব। এসব নমুনার মধ্যে থাকে—রক্ত, চুল, টিস্যু,থুথু বা কফ, সিমেন, অপরাধে ব্যবহ্রত আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা ছুরি, সিগারেট এর বাট, আক্রান্ত ব্যক্তির গায়ে কামড় কিংবা নখের আচড় অথবা পরিহিত কাপড়, অপরাধির খাবার কিংবা খাবারে ব্যবহ্রত জিনিসপত্র—যেমন গ্লাস, মগ, চামচ ইত্যাদি, অর্থাত অপরাধির স্পর্শে এসেছে এমন সব কিছু থেকেই ডিএনএ উদ্ধার করা সম্ভব। এই টেষ্টের ক্ষেত্রে অনেক ভাবেই ডিএনএ এর উপস্থিতি ও মিলিয়ে দেখা যায়।

নমুনার পরিমান নির্ধারন করে দেয় ঠিক কোন পদ্ধতি অনুসরন করে টেষ্ট করা হবে। যদি পর্যাপ্ত পরিমান ডিএনএ নমুনা থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় তবে এনজাইমেটিক পদ্ধতি (RFLP), যদি খুব অল্পপরিমান থাকে তবে চেইন রি-একশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়; এছাড়াও রয়েছে আরো কিছু পদ্ধতি। গ্রহনযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে চেইন রিএকশন এন্ড রিপিটেটিভ সিকোয়েন্স এনালাইসিস কেই ধরা হয় যা যুক্তরাষ্টের এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) করে থাকে যাকে বলে Combined DNA Index System বা CODIS । দ্বিতীয় পর্ব… ভালো লাগলে অচিরেই…  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.