ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির ৭ নম্বর কক্ষে রক্তের নমুনা দিয়ে বেরিয়ে এলেন নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার ইসলামগাতী গ্রামের নূরজাহান বেগম। প্রথম আলোকে বললেন, ‘মেয়ের খোঁজ পাওয়ার জন্য রক্ত দিছি। ’
নূরজাহান বেগমের ছোট মেয়ে সালেহা খাতুন কাজ করতেন সাভারের রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায়। গত ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর থেকে সালেহাকে আর পাওয়া যায়নি।
মেয়ের জন্য কেঁদেছেন, পরিচিত-অপরিচিতের কাছে ছুটে গেছেন খবর জানতে।
কিন্তু সাভারে আসার জন্যও কাউকে পাননি। ৫ জুন নারায়ণগঞ্জে থাকা দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওই আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে ৬ জুন ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন নূরজাহান বেগম।
রক্ত কেন দিলেন, ডিএনএ পরীক্ষা কী, কীভাবে মেয়ের খবর নিশ্চিত হবেন—এর কোনো কিছুই জানেন না নিরক্ষর নূরজাহান। প্রশ্ন করলেই আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন।
অনেক কষ্টে শুধু এটুকুই বলেছিলেন, ‘যদি জানা যায় মেয়েটি কোথায় আছে!’
ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির কর্মকর্তারা নূরজাহান বেগমের হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলেছেন যত্ন করে রাখতে। প্রয়োজনের সময় কর্তৃপক্ষই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
অন্যান্য প্রাথমিক তথ্যের পাশাপাশি কাগজে একটি সাংকেতিক সংখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর বলা হয়েছে, ‘বায়োলজিক্যাল মাদার’ পরিচয় শনাক্ত করার জন্য নূরজাহান রক্ত দিয়েছেন।
রানা প্লাজায় নিহতদের মধ্যে ২৯১টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এদের স্থান হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে। প্রতিটি কবরে একটি করে নম্বর দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে জমা দেওয়া নমুনার সঙ্গে কবরের নম্বরের মিল আছে। স্বজনের ডিএনএ পরীক্ষা শেষে ওই নম্বরধারীর ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে পরিচয় শনাক্ত করা হবে।
ল্যাবরেটরির কারিগরি পরামর্শক শরীফ আখতারুজ্জামান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ৩১৯টি মৃতদেহের নমুনা (মূলত দাঁত ও হাড়) তাঁদের দেওয়া হয়েছে।
আর ৬ জুন পর্যন্ত বাবা, মা অথবা সন্তানের দাবি নিয়ে রক্তের নমুনা দিয়ে গেছেন ৫৪২ জন। এখন এসব নমুনার রাসায়নিক বিশ্লেষণের কাজ চলছে। পুরো কাজ শেষ হতে সর্বোচ্চ ছয় মাস সময় লাগবে।
ল্যাবরেটরির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রক্তের নমুনা বিশ্লেষণের কাজে সময় কম লাগে। ইতিমধ্যে অর্ধেক রক্তের নমুনার বিশ্লেষণের কাজ শেষ হয়েছে।
বেশি সময় লাগছে দাঁত ও হাড়ের বিশ্লেষণে। কাজের এই পর্যায়ে বাইরে থেকে বাড়তি জনবল এনে দ্রুত কাজ শেষ করাও সম্ভব নয়। তেমন উদ্যোগও নেই।
তবে শরীফ আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, দুই ধরনের ডিএনএ রূপরেখা তুলনা করার জন্য একটি নতুন সফটওয়্যার কেনার চেষ্টা চলছে (ডিভিআই: ডিজাস্টার ভিকটিম আইডেন্টিফিকেশন)। দুর্যোগের সময় বহু মানুষের ডিএনএ পরীক্ষায় এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনার পর এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছিল।
কীভাবে সালেহা শনাক্ত হবে: প্রতিটি জীবের কোষের অভ্যন্তরে থাকে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে থাকে ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোম গঠিত ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) দিয়ে। ডিএনএ জীবের বংশগতির ধারক ও বাহক।
আর জিন হলো ডিএনএর একটি নির্দিষ্ট অংশ, যা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য—যেমন চোখের রং, চুলের রং ইত্যাদি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
ডিএনএ রূপরেখা (ডিএনএ প্রোফাইল) মানুষের বংশগতির চিত্র, যা সাধারণত সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং পরীক্ষাগারে মানুষের পরিচয় শনাক্ত করার কাজে বংশগতির চিত্র পেতে ১৬টি নির্দেশক (এসটিআর মার্কার) ব্যবহার করা হয়।
অজ্ঞাতনামা মৃত ব্যক্তির ডিএনএ রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে একটি নির্দেশকের বিপরীতি দুটি পৃথক সংখ্যা পাওয়া যায়। একটি সংখ্যা একটি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে।
১৬টি নির্দেশক থেকে ৩২টি সংখ্যা পাওয়া যায়। এই ৩২টি সংখ্যাই ব্যক্তির ডিএনএ রূপরেখা। এর ভিত্তিতে ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়। রোগনির্ণয় বা অন্য ক্ষেত্রে নির্দেশক ভিন্ন, ডিএনএ রূপরেখাও ভিন্ন।
একইভাবে আত্মীয়ের দাবিদার ব্যক্তির ডিএনএ রাসায়নিক বিশ্লেষণ করলে ৩২টি সংখ্যা বা ডিএনএ রূপরেখা পাওয়া যায়।
এরপর অজ্ঞাত মৃত ব্যক্তির ৩২টি সংখ্যার সঙ্গে আত্মীয়ের দাবিদার ব্যক্তির ৩২টি সংখ্যা পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে দেখা হবে। সংখ্যাগুলো একই হলে নিকট আত্মীয় প্রমাণিত হয়। এভাবে অজ্ঞাত মৃত ব্যক্তি কার মেয়ে, মা বা সন্তান, সে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।
ল্যাবরেটরির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, কাচের নলে রাসায়নিকের মধ্যে দাঁত বা হাড়ের নমুনাগুলো রাখা। গাঢ় নীল রঙের ছিপি দিয়ে নলগুলোর মুখ আটা।
প্রতিটি নলের ওপর একটি করে সংখ্যা লেখা। রাসায়নিকে নির্দিষ্ট সময় রাখার পর সেগুলোর ডিএনএ বিশ্লেষণ করবেন প্রযুক্তিবিদেরা।
নূরজাহান বেগমের রক্তের নমুনা থেকে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তাঁর ডিএনএর রূপরেখা পাওয়া যাবে। সরকারের জমা দেওয়া ৩১৯টি নমুনা বিশ্লেষণ করে পৃথক ৩১৯টি ডিএনএ রূপরেখা পাওয়া যাবে। এই ৩১৯টি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির ডিএনএ রূপরেখার পাশে নূরজাহান বেগমের ডিএনএ রূপরেখা রেখে মিলিয়ে দেখা হবে।
নূরজাহান বেগমের ৩২টি সংখ্যার সঙ্গে যদি কারও ৩২টি সংখ্যা মিলে যায়, তাহলে সেটিই হবে মেয়ে সালেহা খাতুনের মৃতদেহের নমুনা। ওই নমুনার সংখ্যা অনুসরণ করে জুরাইন কবরস্থানে সালেহার কবর শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
আধুনিক বিজ্ঞানের এই জটিল বিষয় নূরজাহান বেগম বুঝতে চান না। তিনি শুধু চান মেয়ের ঠিকানা কোথায় হয়েছে, তা জানতে। কিন্তু এর জন্য তাঁকে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।