------ বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন, (১ম, ২য় ও ৩য় খন্ড)
প্রকাশক-সাকী আনোয়ার,
অধুনা প্রকাশ
পরিচয়টা কতটুকু সমৃদ্ধ? তার চেয়ে বড় নিশ্চয়ই পরিচয়টা জানা। শেকড় কোথায় তা অনুসন্ধান করা। অন্তত, আমি সেটাই মনে করি। প্রিয় পাঠক বিনয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত একটি প্রসঙ্গ টেনে বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন গ্রন্থের ভূমিকার অবতারণা করছি। আমার নিরক্ষর কৃষক দাদার পুত্র আমার বাবা কোন গুণীজন নন।
তিনি অষ্টম শ্রেণী পাস। একজন জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, জেলা আদালতের সম্মানিত জুরি সদস্য। সর্বোপরি স্বচ্ছ ধ্যান ধারণার আধুনিক মনের মানুষ। বাবার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তার অনেকটাই আমার মা, চাচা ও গ্রামের মুরুব্বীদের কাছে শুনে। একান্তই ব্যক্তিগত ইচ্ছে পূরণের জন্য যখন বাবার অতীত ও পূর্বপুরুষ সম্পর্কে তার কাছে জানতে চেষ্টা করেছি, সফল হইনি।
সে সময়, আব্বার কাছে আস্তে কথা বলা ছিল অর্থহীন। উচ্চকণ্ঠে বললে তাঁর প্রতি অসদাচরণ মনে করে (তাঁর আচরণ দেখে তাই মনে হয়েছে) কখনো ধমকে দেন বা চুপ থাকেন। জানা হল না আমার বাবার সম্পর্কে পুরোপুরি। আর কোনদিন হবেও না। তিনি নেই।
এই অজ্ঞতার দায় একান্তই আমার।
আপনজন সম্পর্কে সম্পূর্ণ না জানার দুঃখবোধ, অন্যদিকে দেশের গুণী স্বজন সম্পর্কে জানার আকাক্সক্ষা এবং জেনে একটা বই করার ইচ্ছে থেকে “বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন জীবনালেখ্য” গ্রন্থের কাজে হাত দেই। প্রশ্ন উঠবে কেবল ময়মনসিংহ কেন? কারণ হিসেবে বলি, বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্যতম জেলা নেত্রকোণায় আমার জন্ম। একসময় ময়মনসিংহ জেলারই অংশ ছিল সেটা। আমার শেকড় সেখানেই।
অন্যদিকে আমার যে দুঃখবোধ তার বিস্তৃতি দেখছি মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে। আমার ধারণাটি আরো বদ্ধমূল হয়েছে, যখন দেখি গ্রন্থে যাদের জীবনালেখ্য ছাপা হয়েছে তাঁদের মধ্যে একে অন্যের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয়নিÑব্যতিক্রম কিছু ছাড়া। কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতা, পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে এমনটা হওয়া খুব স্বাভাবিক স্বীকার করছি। তবে এটাও সত্যি আমাদের শেকড়, স্বজন সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা পূর্ণাঙ্গ নয়।
২.
বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয়টি জেলার উর্বর মাটিতে জন্ম নিয়েছেন কত না গুণী ব্যক্তিত্ব।
যারা সমৃদ্ধ করেছেন দেশকে, কেউ কেউ আপন গুণে হয়েছেন আর্ন্তজাতিকভাবে বরেণ্য। এমনই গুণী অনেক স্বজন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তারা পরবর্তী প্রজন্মের নিকট হয়ে গেছেন অনেকটা অচেনা অজানা। সময়ের ব্যবধানে অনেকের নাম গেছে মুছে। তাঁদের উজ্জ্বল জীবনের গৌরবগাঁথা থেকে গেছে আমাদের অজানা।
অথচ সেইসব “হারামনিরাই” আমাদের পরিচয়ের মূল ভিত্তি, আমাদের গরবের ধন।
৩.
অতীতের গৌরবদীপ্ত কৃতি সন্তানদের নব প্রজন্মের নিকট উত্থাপনÑ সেইসঙ্গে আজকে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন তাঁদের জীবনগাঁথা জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্য থেকেই এ গ্রন্থ রচনা। জীবদ্দশায় কৃতি সন্তানদের নিয়ে লেখার একটি বিশেষ কারণও রয়েছে। অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন, একজন ব্যক্তির জীবনাবসানে জীবনের পূর্ণতা পায় হয়ত বা! তবে অনেকের সম্পর্কে সঠিক তথ্যটি জানা হয়ে পড়ে দুরূহ ব্যাপার! অনেক ক্ষেত্রে লিখিত তথ্য পাওয়া না গেলে নিকটজনদের দ্বারস্থ হতে হয়Ñ আর তখন অনুমান নির্ভরতা, ক্ষেত্রবিশেষে অতিরঞ্জন-সর্বোপরি তথ্য ঘাটতির বিষয়টিই সামনে আসে ঘুরে ফিরে। সঠিক ইতিহাস জানা কিংবা লেখা হয় না।
এই কঠিন বাস্তবতার নিরীখে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বেঁচে আছেন এমন কৃতি সন্তানদের’ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হই। সেইসঙ্গে দাবী করছি ইতোপূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কৃতি সন্তানদের নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও ময়মনসিংহের গুণীজন গ্রন্তে উপস্তাপিত এত বিস্তারিত তথ্য অন্য কোন গ্রন্থে উল্লেখ নেইÑ ব্যতিক্রম সেখানেই। আমার উদ্দেশ্য ও দাবীর যৌক্তিকতা কতটুকু তা বিবেচনার ভার আপনাদের ওপর রইলো।
৪.
‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন অভিধা’ প্রসঙ্গ টেনে দুটি কথা বলা জরুরী। অবশ্যই ‘গুণীজন’ শব্দটি আমাদের বোধগম্য।
তবে বিষয়টি নিঃসন্দেহে আপেক্ষিক। কাকে গুণী বলা যাবে কাকে বলা যাবে না তা নিরূপণের বিষয়টি একদিকে জটিল, অন্যদিকে তর্কসাপেক্ষ। গ্রন্থে গুণীজন শব্দটি ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা ও যৌক্তিকতার ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ কি তা উপস্থাপন করছি। সবাই স্বীকার করবেন, একজন মানুষ সমাজে, রাষ্ট্রে কিংবা আপন ভূবনে প্রতিষ্ঠা পান তার স্বকীয় গুণপনার জন্যই। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই এক সময় হয়ে ওঠেন নন্দিত।
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য স্পষ্ট আপন ভূবনে প্রতিষ্ঠিত, সমাজে গ্রহনযোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তিরাই ‘গুণীজন অভিধায়’ অভিষিক্ত হলেন ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন’ গ্রন্থে।
৫.
কোন অর্জনই সহজ নয় জানি! তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিশাল অঞ্চলের কৃতি সন্তানদের নিয়ে লেখার কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ। তথ্য, ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপন, এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার ক্ষেত্র তৈরি, পরস্পরকে আস্থায় আনাÑ সর্বোপরি প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন অবশ্যই সময় ও অর্থব্যয় সাপেক্ষ। সবকিছুই বিবেচনায় এনে ২০০১ সালের প্রথমার্ধে কাজটি শুরু করি। আত্মবিশ্বাসের জোরে এগোতে চাইলেও মাঝে মাঝে হতাশ হতে হয়েছে।
আগেই বলেছি, অনেকেই আস্থায় নিতে পারছিলেন না। কাজটি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব কি? তবে প্রত্যেকের সাথেই ব্যক্তিগত ও আন্তরিক যোগাযোগের মাধ্যমে একসময় কঠিন কাজটি অনেক সহজ হয়ে গেল। অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে এগোতে লাগলাম। নানাভাবে অনেকেই যোগাযোগ করেছে। সহযোগিতা পেয়েছি, পাচ্ছি।
কিছু কিছু অসহযোগিতা ও অসম্মানজনক আচরণও লক্ষ্য করেছি অবাক হয়ে। তবে শেষ পর্যন্ত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন-১’ (প্রথম খণ্ড), ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন-২’ (দ্বিতীয় খণ্ড) প্রকাশ ও পাঠকের হাতে পৌঁছে দেবার মাধ্যমে।
৬.
দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের পর যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তাদের সকলের জীবনালেখ্য ছাপতে হলে বইটির কলেবর হত এরকম আরো এক খণ্ডের সমান। এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা কাজ করেছে। তৃতীয় খন্ডের প্রকাশ নিশ্চিত করার জন্য আমাকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
৬৮ জনের তথ্য ও ছবি সংগ্রহ পরিপূর্ণভাবে হাতে পৌঁছানোর পর তৃতীয় খন্ডের সীমানা নির্ধারণ করে ফেলি। পরিসর বাড়লে, ব্যয় বাড়বে স্বাভাবিক। আর সেই কারণে যদি বইটি প্রকাশ করা সম্ভব না হয় তবে সব পরিশ্রম যাবে জলে। ইতোমধ্যেই একটা বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে এর পেছনে। আমার এই সীমাবদ্ধতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে প্রীত হব।
যাদের নিয়ে ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড প্রকাশিত হলÑ এর বাইরে অনেকেই রয়েছেন, তাদের নিয়ে আমাদের সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে।
৭.
প্রশ্ন উঠবেÑ ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন’ গ্রন্থে কি শুধু জীবিত ব্যক্তিরাই থাকবেন? নিশ্চয়ই নয়। তবে ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ডে শুধু জীবিত ব্যক্তিত্বরাই স্থান পেয়েছেন। কিন্তু যারা আমাদের অতীতের গর্ব, গুণীজন, তাঁদের জীবনালেখ্য নিয়েও রয়েছে, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন:স্মরণীয়-বরণীয়’ শিরোনামে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ।
৮.
‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন’ গ্রন্থটি কিছুটা ব্যতিক্রমের দাবীদার।
আমাদের দেশে এত অধিক সংখ্যায় গুণী ব্যক্তিত্ব নিয়ে এমন বর্ণিল গ্রন্থ রয়েছে বলে আমার জানা নেই। গ্রন্থে আমরা প্রত্যেকের একটি রঙিন ছবি এবং একাধিক সাদাকালো ছবি ছেপেছি। রঙিন ছবি ছাপার ব্যয়বহুল কাজটি করেছি একটি যুক্তিতে (তবে আবেগটাই সেখানে মূখ্য বলে মনে হবে অনেকের কাছে)। আমরা মনে করি যাদের জীবনটাই নানা দিক থেকে বর্ণাঢ্য তাঁদেরকে সাদা কালো ছবির ফ্রেমে ধরে রাখা নয়! আমরা চেয়েছি আবেগ-যৌক্তিকতার বাইরে ‘একটি ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা’ হোক গ্রন্থটি। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার ত্র“টি রাখিনি।
৯.
বইটির দাম নির্ধারণে অনেকখানি ছাড় দিতে হয়েছে আমাদের। একটি গ্রহণযোগ্য মূল্যে ব্যাপক পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে চেয়েছি আমরা। একটি সুন্দর উদ্যোগের বেদীমূলে আমাদের লাভালাভির বিষয়টি হলো উৎসর্গীকৃত।
১০.
শুরুতেই যে কথাটি বলার প্রয়োজন ছিল, সেটা বলছি সবার শেষে। বইটি করার ক্ষেত্রে কাছে ও দূরের অনেকেই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
তাদের নাম তালিকা এতই দীর্ঘ যে স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। তবে সবার প্রতি রইল আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
সহযোগী: সহযোগী হিসেবে প্রথমেই যার নাম বলতে হয় তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক-লেখক ফজলুল করিম। মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও গ্রন্থনার ক্ষেত্রে তার শ্রম ও নিষ্ঠা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। তাছাড়া সম্পাদনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সহযোগিতা করেন কবি বাবুল আরেফিন, শিক্ষিকা ও সংস্কৃতিকর্মী শামসুন নাহার হোসেন এবং তরুন লেখক ইভান অনিরুদ্ধÑ তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইল।
বর্ণ বিণ্যাসে মোঃ সাজ্জাদ হোসেন পিন্টু, গ্রাফিক ডিজাইনে কামাল হোসেন মোল্লা, প্র“ফ সংশোধনে মজনু শাহ ও বইটি ছাপার ক্ষেত্রে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান মেঘমালা- এর আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
স্ত্রী: লিপিকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাইÑ যিনি আন্তরিক উৎসাহ দিয়ে নেপথ্যের মানুষ হিসেবে পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে নিবিড় সহযোগিতা করেছেন।
একটি কৈফিয়ত: গ্রন্থে বর্ণানুক্রমিক সূচি সাজানো হয়েছে প্রত্যেকের নামের মূল অংশের আদ্যাক্ষর অনুসারে। পূর্বেই বলেছি, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহের গুণীজন’ গ্রন্থটি প্রকাশিত জীবিত ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য নিয়ে।
তবে, জীবনপঞ্জী সংগ্রহের পর, গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে যারা ইন্তেকাল করেছেন, নীতিগতভাবে আমরা তাদের জীবনালেখ্য অর্ন্তভূক্ত করেছি। উল্লেখ্য ৩য় খণ্ডে প্রয়াত এমন ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন নারী নেত্রী আইভী রহমান ও কবি আবু কায়সার।
প্রিয় পাঠক, গ্রন্তে বানান লেখার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীর ‘বানান অভিধান’ অনুসৃত হয়েছে। তারপরও বইটি অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্র“টির উর্ধ্বে নয়। অন্যদিকে জীবনালেখ্য গ্রন্থনা করতে গিয়ে অসাবধানতা বশত কোনো তথ্য বিভ্রাট হয়ে যেতে পারে।
বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি এবং ত্র“টিগুলো আমাদের অবহিত করলে অবশ্যই তা সংশোধন করে নেব পরবর্তী সংস্করণে।
তথ্যপঞ্জী সংগ্রহকাল: মার্চ ২০৪ থেকে মে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ
সাকী আনোয়ার
লেখক- প্রকাশক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।