www.digitalsomoy.com.bd
ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের নাম আমাদের সবার পরিচিত। তিনি একাধারে চিলেন বিপ্লবি,কবি, লেখক, গীতিকার..এবং আইনজীবি। গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছাড়াও পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অধ্যাপক গোলাম আজমসহ অন্যদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার শহীদ জননী প্রয়াত জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরও তিনি সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
১৯৪২ সালে তিনি প্রথম জেলে যান মাত্র ১৩ বছর বয়সে। নোয়াখালির ছাগলনাইয়ার এক সরকারি অফিসের উপর থেকে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে মুসলিম লীগের পতাকা লাগানোর অপরাধে সে সময় তাঁকে জেলে যেতে হয়। ভাল ছাত্র এবং অল্প বয়সের কারনে সে যাত্রায় চাড়া পান তিনি।
তাঁর বাবাও ছিলেন ব্রটিশবিরোধি আন্দোলনের সাথে জড়িত।
১৯৫৬ সালে যখন তাঁর বাবা মারা যায় তখনও তিনি ছিলেন জেলে।
কেবল ভাষাসৈনিক বললে তাঁর পরিচয়কে খণ্ডিত করা হয়। ভাষাসৈনিক হিসেবে গৌরবের পরিচয়বাহী এ মানুষটি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েই তাঁর দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেননি, পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন। এখানেই তাঁর মহত্ত্ব, এখানেই তাঁর সামাজিক প্রতিশ্রুতি পালনে নিষ্ঠার প্রমাণ। এ কারণেই তিনি সবার নমস্য হয়ে উঠেছেন।
গাজীউল হকের সৌভাগ্য যে, ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাই তিনি পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পেরেছিলেন। উর্দু চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার প্রেরণা পেয়েছিলেন অন্তরের তাগিদ থেকে। ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র তো ছিল হাজার হাজার। সবাই তো আর ১৪৪ ধারা ভাঙার সাহস করেননি।
যে কজন সেই সাহস প্রকাশ করেছেন তাঁদের একজনের নাম গাজীউল হক। উর্দুর বিরুদ্ধে 'না' বলার নেতৃত্বতো আর সবাই দেননি। তা দিয়েছিলেন বলেই তিনি আজ সকলের শ্রদ্ধার পাত্র।
কেবল ৫২ নয়, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪-এর সামপ্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকজুড়ে সৈরাচারবিরোধি আন্দোলন- সব ক্ষেত্রেই গাজীউল হকের ছিল উলে¬খযোগ্য ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা কে না জানে, সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
লড়াকু সৈনিক হিসেবে তাঁর অংশগ্রহণ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও তিনি সম্মানিত। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ মানুষটিকে আমাদের সময়ে দেখতে পেয়েছি, এটি পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করি।
পেশাগত জীবন তিনি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ছিলেন। তিনি সাধারন মানুষের জন্য নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মামালা লড়তেন।
কেউ টাকার অভাবে মামালা লড়তে না পারলে তিনি এগিয়ে যেতেন...
রাজনীতিতে তিনি জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন তিনি।
এছাড়া গাজীউল হক প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান ছিলেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, জেলের কবিতা (১৯৫৯), এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১), এগিয়ে চলো (১৯৭১), বাংলাদেশ আনচেইন্ড (১৯৭১), মোহাম্মদ সুলতান (১৯৯৪), মিডিয়া ল'জ এন্ড রেগুলেশন ইন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন (১৯৯৬)।
সর্বশেষ গত বছরের ৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪ তম সমাবর্তনে তাকে এবং আরেক ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনকে সন্মানসূচক ''ডক্টর অব লজ' ডিগ্রি দেওয়া হয়।
এছাড়াও গাজীউল হক তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন৷ এগুলো-
১৯৭৭ সালে পান পাবনা থিয়েটার পুরস্কার৷
১৯৭৯ সালে বগুড়া জিলা স্কুলের ১৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে 'বন্ধন'-এর পক্ষ থেকে ভাষাসৈনিক গাজীউল হককে ক্রেষ্ট উপহার দেওয়া হয়৷
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি 'সড়ক'-এর পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধাঘ্য জানানো হয়৷
১৯৮৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি 'কমিটি ফর ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ- নিউইর্য়ক' তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়৷
১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য 'বাংলাদেশ জাতীয় ব্যক্তিত্ব গবেষণা কেন্দ্র' তাঁকে রাষ্ট্রভাষা পুরস্কার পদক ও সম্মান স্মারক প্রদান করে৷
১৯৯৭ সালে অন্নদা শংকর রায় কলকাতার পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে৷
১৯৯৭ সালে বছর 'বগুড়া প্রেস ক্লাব' ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা দেয়৷ তাঁকেও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়৷
১৯৯৭ সালে 'চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার' ( বইমেলা ) থেকে ৭ মার্চ তিনি ভাষাসৈনিক পদক পান৷
১৯৯৭ সালে বগুড়ার ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু পরিষদ সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁকে অর্পণ নামে একটি ক্রেষ্ট উপহার দেয়৷
১৯৯৯ সালের ২৬ নভেম্বর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে জীবনব্যাপী নিষ্ঠা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন৷ তিনি সিপাপ জাতীয় স্বর্ণপদক পান৷
১৯৯৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি 'আমরা সূর্যমুখী'র পক্ষ থেকে তাঁর ৭১তম জন্মদিনে নাগরিক সম্মাননা দেওয়া হয়৷ 'কারক নাট্য সম্প্রদায়'-এর ১২ বছর পূর্তিতেও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়৷
২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকার জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাঁকে সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন জানায়৷
এছাড়া ২০০০ সালে ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে সিলেট ভাষাসৈনিক সংবর্ধনা পরিষদ তাঁকে ভাষাসৈনিক সংবর্ধনা দেয়৷ এবছরই তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন এর উপদেষ্টা হিসেবে বিশেষ সম্মাননা স্মারক পান৷ ১২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদও তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে৷ ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিস-এর পক্ষ থেকে মাতৃভাষা পদক পান৷ 'দি ইনস্টিটিউট অব চার্টাড এ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ' তাঁকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ ক্রেষ্ট উপহার দেয়৷
২০০০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের জন্য 'আমরা সূর্যমুখী'র পক্ষ থেকে তাঁকে ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে নাগরিক সম্মাননা দেয়৷ 'মাতৃভাষা সৈনিক পরিষদ'এর পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করা হয়৷
২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার' তাঁকে 'একুশে পদক' পুরস্কারে ভূষিত করেন৷
২০০০ সালের ১০ জুলাই পান 'বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন' পুরস্কার ৷
২০০১ সালে ফেনী সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে 'ফেনীর কৃতি সন্তান' হিসেবে গুণীজন সংবর্ধনা দেওয়া হয়৷ ২০০১ সালেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূল কমিটির পক্ষ থেকে 'জাহানারা ইমাম পদক' পান৷
২০০২ সালে 'সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট' 'ভাষা আন্দোলনের-সুবর্ণ জয়ন্তী' উপলক্ষে তাঁকে একটি ক্রেষ্ট উপহার দেয়৷ এ বছর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে৷
২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে 'বঙ্গবন্ধু পদক' পান৷
২০০৪ সালে 'বাংলাদেশ জাতীয় ব্যক্তিত্ব গবেষণা কেন্দ্র'-এর ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে 'বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন-২০০৪'৷
২০০৪ সালে পান 'শের-ই-বাংলা জাতীয় পুরস্কার' ৷
২০০৫ সালে শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য 'মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার' পান৷
২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন-এর ৭ম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তাঁকে ক্রেষ্ট উপহার দেয়৷
আমাদের দেশের এবং জনগনের অকৃত্তিম বন্ধু, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এ প্রাণপুরুষকে একুশে পদক দিয়ে সরকার তাঁর ঋণ শোধের কিছুটা চেষ্টা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান দেখিয়েছে। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এবং ভাষা আন্দোলনের সব সৈনিককে এরকম সম্মান জানালে আমরা খুশি হবো।
উনার প্রতি রইলো অনেক অনেক শ্রদ্ধা...
রইলো অনেক ভালবাসা...এবং কখোনো ভুলে যাব না এমন ওয়াদা।
যতদিন বাংলার মাটিতে স্বাধীনতাপ্রেমি শেষ ব্যাক্তিটি রইবে ততদিন আমরা তোমাদের ভুলব না...
নোয়াখালী ওয়েব ‘আলোকিত মানুষ’ পর্ব থেকে প্রকাশিত, ২০ অক্টোবর ২০০৯।
http://www.noakhaliweb.com.bd
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।