আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দার্জিলিং ভ্রমণ/ পর্ব-০৩

পর্ব-০১ পর্ব-০২ সকালে উঠে আকাশের অবস্থা দেখে আমরা ঠিক করলাম কাঞ্চনজংঘা দেখতে না পারি, টাইগার হিল যা নাকি দার্জিলিং এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা, সেটা দেখব। আমরা পুরোপুরি check out করলাম দার্জিলিং এর হোটেল থেকে। ইচ্ছা সারাদিন ঘুরে শিলিগুড়িতে ফেরত যাওয়া, রাতটা শুধু শুধু দার্জিলিং এ না থাকা। এছাড়া শিলিগুড়িতে আমার বউ সহ অন্য ভাবীরাও একটু শপিং করতে চায়। গেলাম টাইগার হিলে।

বেলা তখন ১১.৩০ টারও বেশি। ভয়াবহ কুয়াশার কারনে যাত্রাপথে এক হাত দূরের কোন বস্তুও দেখতে পেলাম না। আশেপাশে কিছুই দেখা যায়না, শুধু মেঘ, আরও ছিল বৃষ্টি আর বাতাস, ভয় লাগে। তাই ওখানে আর বেশিক্ষণ থাকলাম না। কারন এত খারাপ আবহাওয়াতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

তাই আমরা তিন পরিবার মিলে ঠিক করলাম আমরা টুকটাক আশেপাশের কিছু এলাকা দেখে সোজা মিরিখ এ যাব। ওটা আরেকটা tourist place, যা দার্জিলিং থেকে বেশ কাছেই। মিরিখ ঘুরে সোজা নেমে যাব শিলিগুড়ি তে। টাইগার হিলে ওদের বিশাল বিশাল সব টাওয়ার ( সম্ভবত মোবাইলের)। এত বাতাস আর বৃষ্টি যে শুধু বেস টার ছবি তুলতে পারলাম এবারে আমরা পেলাম একটা টাটা সুমো ( এটাতে করেই টাইগার হিলেও গিয়েছিলাম), চালকটাকেও একটু বেয়াড়া মনে হল।

সে নাকি ইন্ডিয়ান আর্মি তে ছিল। জাতিতে গোর্খা। সে বলল, “ সে হিন্দি জানে আর ইংরেজী”। দার্জিলিং এ কিন্তু এই আরেকটা ব্যাপার, চালক বাংলা বুঝতে পারলে কিন্তু সে আপনাদের গাইড এর কাজ করবে। যাই হোক এই চালক এর ভাব সাব ভাল লাগল না।

সে বাংগালীদের পছন্দ করে না খুব একটা। সে বলল, “ তুম হিন্দি নেহি আতা?” বুঝেন অবস্থা। আমার বউ আর আর অন্য ভাবীরা অবশ্য হিন্দিতে কম যায়না। তবুও.....................আমরা ছেলেরা সব ইংরেজি। যাই হোক কিছুদূর গিয়ে সে বলে সব scenic place এ সে যাবেনা, কারণ এরপর আমাদের শিলিগুড়িতে দিয়ে এসে তার ফিরতে নাকি অনেক রাত হয়ে যাবে।

আমরা প্রতিবাদ করলে একটা পর্যায়ে সে জিপ থামিয়ে আমাদের হিন্দিতে বলে ,” তোমাদের মাল নামাও, আমি যাবনা, অন্য জিপ নাও”। আমার বউ আর অন্য ভাবিরা হিন্দিতে তাকে বকা দিতে গেলেই আমরা সবাই মেয়েদের থামালাম, কারণ এটা বিদেশ। পরে ওকে বুঝালাম, দেখ আমরা অনেক বিপদে পড়ে যাব...ইত্যাদি। যাই হোক পরে সে একটা জায়গা বাদে অন্য সবগুলোতে নিতে রাজি হল। এজন্য ই আমি প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, অনেকে মিলেই আসলে দার্জিলিং এ বেড়ানো উচিৎ, কারণ শুধু আমরা দুইজন থাকলে এ ধরণের অবস্থাতে কিন্তু এত সহজে সামাল দিতে পারতাম না।

আসলে যাত্রাপথেই আপনারা এরকম দুই একটি পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে নিবেন। আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেলস্টেশন দেখলাম দার্জিলিং এর। সেই বৃটিশ আমলে র, রেল্গাড়িও সেই পুরণো আমলের। ৮-৯ হাজার ফুট উপরে কিভাবে এইসব রেলগাড়ি উঠাইছে জানিনা। শুধু তাই বলি কেন, এত উঁচু পাহাড়ের উপরে আমরা মারুতি-সুজুকি গাড়ির সো-রুম দেখে কি কম অবাক হলাম।

আর রাস্তাগুলো সেই বৃটিশ আমলে করা, এখনও তেমনি রয়েছে, এত বৃষ্টি, তারপরও কত সুন্দর রয়েছে! এছাড়া দেখলাম, একটা যাদুঘর ( ভিতরে ঢুকি নাই), বাতাসিয়া লুপ ( যেখানে ট্রেন ১৮০ ডিগ্রী টার্ণ নেয়) –এটা অবশ্য কাছে গিয়ে দেখি নাই, প্রতিকুল পরিবেশ আর ফিরে যাওয়ার তাড়াও ছিল একটা কারণ। দার্জিলিং থেকে ফিরে যাবার সময় অবশ্যই মিরিখ হয়ে ফিরবেন। নেট এ বা অন্য মানুষের কাছে মিরিখের অনেক বর্ণনা শুনেছি, কিন্ত আমাদের কাছে সবচেয়ে ভাল মনে হয়েছে মিরিখের পথে যাত্রা। একপাশে পাহাড় আর আরেক পাশে গভীর গিরিখাদ, বড় বড় গাছ.....দারুণ। মিরিখ যাওয়ার পথে একপাশে পাহাড়, বাম পাশে গভীর খাদ...গাছগুলো দেখে মনে হয় কেউ এগুলো লাগিয়েছে আর এর পরিচর্যা করে।

মিরিখ কিছুটা নীচের দিকে বলে আমাদের গাড়ি নামতে শুরু করলো। প্রায় আধা ঘণ্টা নামার পর আমরা দেখতে পেলাম অপার্থিব দৃশাবলী। চারিদিকে সবুজ পাহাড়, মাঝখান দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা চলে গেছে। কখনো সূর্যের আলোয় পাহাড়গুলোকে সোনালী মনে হয় আবার যখন একটু মেঘ থাকে তখন পাহাড়গুলো অন্য এক রূপে আবির্ভূত হয়। মিরিখ যাওয়ার পথে নিচের ছবি, কখনো দেখবেন মেঘ থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, আবার ক খ নো ঝকঝকে রোদ এ চকচক করছে।

এই বর্ণনাটা একটু বিশদ ভাবে দিতেই হবে। অপার্থিব সৌন্দর্য কেন বললাম। আমরা তো অনেক উপরে। একটা সময় দেখলাম, অনেক নিচে একটা জায়গা যা খুব অন্ধকার, আরেক ঠিক তার পাশের জায়গাটা সোনার মত চকচক করছে। বুঝতে পারলাম না প্রথমে, পরে বুঝলাম অন্ধকার জায়গাটা হল ঘন মেঘের কারণে, আর চকচকে জায়গাটা হল পরিষ্কার সূর্যের কারণে।

আর আমরা দুটোই দেখছি উপর থেকে একি সময় এ। আল্লাহ্‌ পাকের সৃষ্টির কি অপার সৌন্দর্য তা বুঝতে পারবেন যে কেউ এ ধরণের দৃশ্য দেখলে। আমরা সবাই বললাম, “ সুবহানআল্লাহ্‌”। মিরিখ যাওয়ার পথে ডান পাশে আপনি নেপাল দেখতে পাবেন। ড্রাইভার এই বর্ণনাগুলো দিচ্ছিল।

সেটাও একটা দারুণ দৃশ্য। যাই হোক এর কিছুক্ষণ আগে আমাদের গাড়ির হর্ণ নষ্ট হয়ে গেলে। এই পাহাড়ি রাস্তায় এটা যে কি বিপজ্জনক সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কারণ প্রতি পদে পদে বাঁক, আর বিপরীত থেকে আসা গাড়ি তো আছে......ড্রাইভার বলল, এটা একবারে মিরিখে গিয়ে ঠিক করাতে হবে ( যদিও মিরিখেও আমরা ঠিক করতে পারি নাই) । যাওয়ার পথে একটা মিলিটারি ট্রাক দেখলাম।

আমাদের ড্রাইভার পুরা চিৎকার করে সেটাকে সাইড দিতে বলছে ( যেহেতু হর্ণ নষ্ট)। মিলিটারি ট্রাকটি সাইড দিয়ে দিল। ওদের ওখানে ট্যুরিস্ট দের এতই সমাদর। হঠাৎ দেখি দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান। অপূর্ব এই জায়গা টার সৌন্দর্য না দেখলে বুঝবেন না।

আমরা গাড়ি থামিয়ে কিছু ছবি তুললাম। আলোয় পাহাড় যে কতো সুন্দর হতে পারে তা বলে বোঝাতে পারব না। আমরা আস্তে আস্তে আরও নামতে লাগলাম। শুরু হলও মিরিখ এর রাস্তা। পুরো ছবির মতো দৃশ্য।

চা বাগান। বিশ্বখ্যাত দার্জিলিং টি ( Darjeeling Tea) হয় এসব বাগানেই। সারি সারি গাছ, আপনার দেখলে মনে হবে যে প্ল্যান করে কেউ লাগিয়েছে। চারদিকে সবুজ এর ভেতর দিয়ে আপনি চলছেন। পুরো রাস্তাই ছবি চলার মতো।

আপনি চাইলেই আপনার কমপিউটার এর wall paper বানাতে পারেন পুরো রাস্তার যে কোন দৃশ্যকে। আমরাও গাড়ি থামিয়ে বেশ কিছু photo তুললাম। এরপর পৌছালাম মিরিখ লেকে। টলটলে পানির লেক... boating ও করা যায়। লেকের অন্যপাশে বিশাল বিশাল গাছের সারি।

অনেকটা আমাদের জিয়া উদ্যান এর মতো। ঘোড়ার উপর উঠে খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরলাম ( শুধু আমি) তারপর একটু chips আর coke নিয়ে বসলাম। তখন প্রায় সাড়ে চারটার টার মতো বাজে। খিদায় পেট চো চো করছে। আমাদের ড্রাইভার বলল যে পাশেই বলে পাঞ্জাবীদের একটা খাবার হোটেল আছে।

দাম একটু বেশি কিন্তু খাওয়া অনেক মজা। আমরা দেরি না করে রাজি হয়ে গেলাম। মাত্র ৫ মিনিটের রাস্তা যেতেই পৌছায় গেলাম সেই হোটেল এ। বেশ বড় হোটেল, চকচকে ঝকঝকে করে সাজানো। একজন বিশাল সাইজ এর বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক মাথায় পাগড়ি বেঁধে চুপচাপ Cashier এর seat এ বোসে আছে।

আমরা নান রুটি, পালং পনির, vegetable আর daal এর order দিলাম। অমৃত ছিল ওদের আইটেম গুলো। এখানে একটা কথা বলা যায় যে পুরো ট্যুর এ আমরা কোন খাওয়ার কষ্ট তো পাই নি বরং এত মজা করে যে নিরামিষ আর মাছের item রান্না করা যায় তাই শিখে আসছি। মিরিখের টলটলে পানির লেক, মাটি থেকে যা কয়েক হাজার ফুট উপরে লেক এর ওপারে বন, খেয়াল করুন ধোয়ার মতো মেঘ দেখা যাচ্ছে মিরিখে কয়েকটা বৌদ্ধ মন্দির আছে, এরকম কিছু লোক দেখলাম, আর লোকগুলোর ভাবসাব একটু কেমন যেন, আপত্তি করতে পারে...... তাই ছবি তুললাম খুব কায়দা করে। গোটা দার্জিলিং লেখা পড়ার জন্য খুব ভাল।

মিরিখে স্কুল থেকে ফিরছে একদল ছেলে মেয়ে। আরেকটা ব্যাপার বলি। আমি আর আমার বউ যে মেনু খেতাম, ঐ পরিবার দুটো কিন্তু তা খেত না। এখানে আমরা আবার যার যার তার তার ছিলাম, কিন্তু কারো ভাংতি না থাকলে আবার দিচ্ছি। পারস্প রিক খুব সৌহার্দ্য ছিল আমাদের মধ্যে।

যাই হোক খাওয়া পর্ব শেষ আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। এবার যাত্রা মাটির পথে । ওমা কোথায় কি। ভেবেছিলাম সমতলে এসে গিয়েছি, না এরপরেও পাহাড় পেলাম। একটা নদী কিভাবে পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে সমতলে আসে তাও দেখলাম বামে তাকিয়ে।

কাছেই কিন্তু সিকিম আর ভূটান। যাই হোক এবারে যাচ্ছি সেই শিলিগুড়ি তে। শিলিগুড়ির বর্ণনা ছোট। সেটা ইন্‌শাল্লাহ্‌ আগামি পর্বে। ওখানে গিয়ে কোন ধরণের হোটেলে থাকবেন আর কোথায় কি মার্কেট করবেন, সেটার বর্ণনা থাকবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।