দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই...
রক গার্ডেন ঘুরে একটু দূরে, পাশের গঙ্গামায়া পার্ক এর ঝরনা দেখতে গেলাম। সেটি আবার দুইভাগে বিভক্ত। এক পাশে এক কৃত্রিম জলাধারে সাদা রঙের এক বিশাল কৃত্রিম পদ্ম। সেটির পাশে ঝরনা। আর রাস্তা পার হলেই আরেকটি বিশাল ঝরনা, খানিকটা শিলং এর এলিফ্যান্টস ফলসের মত।
পানির বেগ বেশী নয়, তবে পাথরের বিন্যস্ততার জন্য পানি ছড়িয়ে পরে ফেনা আর ঢেউ তুলছে। তবে সেখানে ঢুকতে পারলাম না, রবিবার ছিল সম্ভবত। এই কারনে বন্ধ ছিল। আমাদের দুই দোস্ত দেয়াল টপকিয়ে ঢুকে পুলিশের দৌড়ানি খেল। আর একটুর জন্য লাঠির বাড়ি খায়নি।
পুলিশ আর তার যুদ্ধের প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি ক্যামেরায় বন্দি করেছি, তবে ব্লগে দিলাম না। পাছে আমাকে আবার মারতে আসে!
সাদা পদ্মের জায়গাটিও অপূর্ব। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা, একটি প্রাকৃতিক আর দুইটি কৃত্রিম ঝরনা। প্রাকৃতিক ঝরনা এত বড় না, তবে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে শেষের দিকে যখন খাদে পড়ছে, সে জায়গাটি অপূর্ব। অবশ্য আমরা বেশীর ভাগই নামিনি, কারন পিচ্ছিল পাথর, যথেষ্টই বিপদজনক।
তবে আমাদের এক বন্ধু এক কাহিনী করে এল। সাদা পদ্মটি ছিল ঠিক ওই জলাধারের মাঝে। আপাত দৃষ্টিতে সেটাকে সিমেন্টের তৈরী বলে মনে হচ্ছিল। সে দৌড়ে এসে পদ্মের একটি পাপড়িতে লাফ দিয়ে পড়ল। সাথে সাথে আওয়াজ হল, মড়াৎ মড়াৎ! আমরা তো ভয়ে শেষ।
কারন আমরা দূর থেকেই ফাটল দেখতে পাচ্ছি, এখন যদি পাপড়ি ভেঙ্গে পড়ে, আর দেখতে হবে না। জাতীয় সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগে জেল এ নিয়ে যাবে। কারন লেকের পানি স্পর্শ করতেও মানা, সেখানে তারিক দিয়েছে লাফ!আমরা চেরা চোখে দেখলাম আশে পাশে দর্শনার্থী ছাড়া কোন পুলিশ বা গার্ড নেই। আল্লাহ বাঁচালো, ফাটলই থাকলো, কিন্তু পাপড়ি পড়লো না। মাঝে মাঝে সখ হয়ে আবার একটু দার্জিলিং গিয়ে দেখতে, এখনও কি পাপড়িটা ওমনই আছে?
ম্যাড়ম্যাড়ে ঝরনা নাম্বার এক।
সেই পদ্ম
ম্যাড়ম্যাড়ে ঝরনা নাম্বার দুই।
পুরো পার্ক উপর থেকে।
দার্জিলিং এ দর্শনীয় ৩টা জায়গার মাঝে পড়ে ঘুম মনাস্টেরী, বাতাসিয়া লুপ আর গঙ্গামায়া পার্ক ও রক গার্ডেন; যেগুলোর কথা দ্বিতীয় পর্বে বলে ফেলেছি। প্রতিটি জায়গায়ই বেশ দূরে দূরে, তাই বিকেল গড়িয়ে যায় দেখতে দেখতে। এবার এপ্রিলে গিয়ে ৭টি জায়গায় কি কি দেখেছিলাম বলি।
প্রথমে গিয়েছিলাম শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু হিমালায়া জুলজিকাল পার্ক। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত চিড়িয়া খানা।
প্রথমত এটা সাগরপৃষ্ঠ থেকে ২১৩৩.৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত যার পিছনে গর্বিত কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয়ত এটা সাউথ এশিয়ার একমাত্র চিড়িয়া খানা যেখানে বিরল রেড পান্ডা এবং স্নো লেপার্ড আছে। চিড়িয়া খানায় কোন সাধারন পশু পাখি নেই, সবই বিলুপ্ত প্রায় আর বিরল প্রজাতির।
তাদের থাকার জন্য সেইরূপ ব্যবস্থা। যেমন দেখলাম সাইবেরিয়া থেকে আসা সাদা বাঘের জন্য বরফের ঘর, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে সেইভাবেই। কিন্তু তাই বলে আবার ঘর না, চারিদিকে গাছ পাথর এবং ছোট ছোট প্রানী দিয়ে সেটাকে ঠিকই তার আবাসিক জংগলের মতই করে রাখা। পাখির ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম কত যে রঙ বেরঙের পাখি। চিড়িয়া খানায় বেশী প্রানী নেই, কিন্তু যা আছে সবই দেখার মত।
রয়েল বেংগল টাইগার রয়েছে বেশ কয়েকটা। রেড পান্ডাকে দেখার জন্য অনেক সাধ্য সাধনা করতে হলো। মহা লাজুক প্রানী, তায় আবার চূড়ান্ত অলস। তার থাকার জায়গায় তাল গাছের মত লম্বা গাছ আছে, সে সেটার মাথায় মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে বেশীর ভাগ সময়ে। ১৯৫৮ সালে এই পার্ক্ টি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে নাম পদ্মজা নাইডু হয় ১৯৭৫ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সুপারিশে।
এর পর গেলাম তেনজিং নোরগে মাউন্টেইনিং ইন্সটিউটে। আমার জেনারেল নলেজের অবস্থা মুখের বলার না। তাই সেখানে গিয়ে খুবই অবাক হলাম, আমার ধারনাই ছিল না যে পাহাড়ে উঠার জন্য ৩ বছরের ডিগ্রী লাগে। আমরা যখন গেলাম, সেদিনই একটি ব্যাচের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে। সমাবর্তনের কালো টুপী আকাশে ছুড়ে তারা উল্লাস প্রকাশে ব্যস্ত।
ইন্সটিউটে দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘরে তেনজিং নোরগে আর স্যার এডমন্ড হিলারীর ব্যবহার্য সব জিনিশ। এখনো মনে আছে, তেনজিং নোরগের জুতা দেখে হেঁচকি উঠেছিল। যেকরম বিশাল সেইরকম ভারী। দুই হাত দিয়ে তোলাই আমার মনে হল মুশকিল, কি করে পড়ে এভারেস্টে উঠলো?? মিউজিয়ামটা ছোট কিন্তু ভালো, পুরো পরিবেশটাই কেমন যেন “চল চল চল, উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্ন উতলা ধরনী তল” জাতীয়। মনে হয় ধুর কিসের কি, পাহাড়েই যদি না উঠা শিখলাম, বরফে চাপাই যদি না পড়লাম, জীবন রেখে কি হবে? ১৯৫৩ সালে এভারেস্ট জয়ের পর পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “ হিমালয়ের সুর এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে।
এ যেন এক নতুন পথের দিশা, মহান ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে”। মূলত তার একক চেষ্টাতেই ১৯৫৪ সালে এই মহাবিদ্যালয় গড়ে উঠে এবং এখনো সুনাম রক্ষা করে যাচ্ছে প্রতিবছর অসংখ্য দুঃসাহসী অভিযাত্রী উপহার দিয়ে।
এরপর গিয়েছিলাম তেনজিং এন্ড গোমবু রকে। গাড়ি থেকে নামিনি, কারন দেখার কিছুই নেই। রাস্তার ধারে বিশাল এক পাথর, তার গায়ে অনেক গজাল জাতীয় জিনিশ লাগিয়ে সবাই পাহাড়ে উঠা অনুশীলন করছে।
এটাও নাকি ৭টা স্পটের একটা জায়গা। মনে মনে ভাবলাম, না হলেও তো দুইবার এইদিক দিয়ে ইতিমধ্যে যাতায়াত করে ফেলেছি!
পরের স্পট টা না গেলে দার্জিলিং গিয়েছি বলে বোধই হত না। হ্যাপী ভ্যালি টী গার্ডেন। চমৎকার যা বাগান। তবে সিলেটের সাথে বেশী একটা পার্থক্য নেই।
পার্থক্য একটাই, বাংলাদেশে ধূলার আধিক্যে মাঝে মাঝে চা পাতা ধূসর হয়ে যায়, ধূলা না থাকায় এখানে রাস্তার কাছের চা গাছ গুলিও সবুজ। ছোট ছোট প্যাকেটে করে চা পাতা বিক্রি হচ্ছে। সবার জন্য না নিলে কি করে হয়? গ্রীন টি প্রায় ২০ প্যাকেট নিলাম। অবশ্য দেশে এসে দেয়ার পর ফিডব্যাকে দেখলাম, ৫০ ভাগেরই দার্জিলিং এর চা পছন্দ হয়নি। তার চেয়ে নাকি আমাদের তাজা আর ফিনলে অনেক ভালো! এইখানেও দার্জিলিং এর ঐতিয্যবাহী পোশাক পাওয়া যাচ্ছে।
এক আব্বু আর আম্মু ছাড়া আমরা সবাই পড়লাম। এক আংকেল আন্টি তাদের বাচ্চা কাচ্চা দেশে রেখে এসেছেন, তারা রাজা এবং রানীর পোশাক পড়েছেন, কিন্তু ফ্যামিলি ফোটো হচ্ছে না। পরে আমাকে আর আমার বোনকে তারা রাজকুমারী হিসেবে ধার নিলেন আব্বু আম্মুর কাছ থেকে। তবে নাকের কারনে আমাকে পাহাড়ী দের দেখে আলাদা করাই মুশকিল। সেখানকার মেয়েরা মহা হাসাহাসি করলো, আমার মনে হলো দেশে গিয়ে যদি প্লাস্টিক সার্জারী না করাইছি তো আর জীবনে তোদের দেশে আসবো না, যা ভাগ!
আমাদের দুই আংকেলের দার্জিলিং বশে মল্লযুদ্ধ।
হ্যাপি ভ্যালীর পিছনে পাহাড়ের একেবারে তলদেশে একটা জাগ্রত মন্দির আছে। মানে, জাগ্রত দেবতা নাকি আছে। অনেক খানি নামতে হয়, ভাঙ্গা সিঁড়ি আছে অবশ্য। কেউ নামলো না, আমরা মাত্র ৩/৪ জন নামলাম। গিয়ে দেখলাম ছোট্ট শ্যাওলা পড়া এক মন্দির, ভয়াল দর্শন এক পুরোহিত জবা ফুলের মালা পড়ে পূজা করছে দেবী কালির মূর্তিকে।
আমরা গেলে বিরক্ত দৃষ্টি দিলো। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে মাথা নাড়লো যে পত্রপাঠ আমরা চম্পট দিলাম।
এর পর গেলাম রেসের ময়দানে। আগে নাকি রাজারা রেস খেলতেন, এখন অন্য খেলা হয় কিনা জানি না। সবই কেমন ভাঙ্গা চোরা।
এটাও নাকি স্পট। কি ব্যবসায়িক বুদ্ধি!
সেখান থেকে গেলাম দালি মনাস্টারী যার কথা আগেই বলেছি। ৭ নং স্পটের অবস্থা আরো ম্যাও। দার্জিলিং থেকে ১০কিমি দূরে সিঞ্চল লেক। দূর থেকে সিঞ্চল লেক দেখালো।
পুরো দার্জিলিং এর পানি সেখান থেকে সরবরাহ করা হয়। পিকনিক স্পটের মতো। ঝাউ বাংলোর রহস্যতে ক্যাবলা যে বলেছিল, “এই বুঝি লেক? ছ্যা!”—এর চেয়ে ভালো ভাবে আর মনোভাব প্রকাশ করা সম্ভব না। ছবির সাথে একেবারেই মিল নেই। তবে হয়ত কাছে গেলে ভালো লাগত, কে জানে।
আবার আগের অংশে ফিরে যাই। রক গার্ডেন থেকে আমরা হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা করে ফেললুম। ফ্রেশ হয়ে আবার গেলুম ম্যালে। টুক টাক শপিং করলাম। শপিং মানে সোয়েটার আরকি।
ছাতা গুলিও মন্দ না। আর চকোলেট। তবে এবার আর বেশী রাত করলাম না, কারন পরের দিন আমাদের দীর্ঘ যাত্রা অপেক্ষা করছে। এদিকে ঢাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। নেপাল ভ্রমন কাহিনীর শুরুতে বলেছিলাম যে আমরা ৩৮ জন অটো নিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে পালিয়েছিলাম।
এদিকে আমাদের আরো প্রায় ২০ জন বন্ধু পালিয়েছিলো ইন্ডিয়াতে। লেকচার ক্লাসে ৫৮ জনের ঘাটতি চোখে পড়ার মত। স্যাররা ধরে ফেললেন যে আমরা কোথাও গিয়েছি। শাস্তি দেবার জন্য মেডিসিন ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা ফেললেন ১০ই নভেম্বর। কারন এই পরীক্ষা ফেইল করি সমস্যা নেই, কিন্তু কারণ দর্শানো ছাড়া যদি উপস্থিত না থাকে, প্রফের সেন্ট আপে একেবারে খবর করে দেবে।
আমরা সেইমতই প্রস্তুতি নিলাম দার্জিলিং এ। পরের দিন ভোরে যাত্রা করে কোথাও কোন বিরতি না দিয়ে মোটামোটি বিকেলের মাঝে বর্ডার ক্রস করে ফেললাম। সন্ধার দিকে ঢাকায় রওয়া হয়ে ভোর সাতটায় এসে পৌঁছলাম সরাসরি কলেজে। সকাল ১০টায় আমরা সবাই পরীক্ষা হলে। স্যাররা ঢুকে খানিক অবাক, পুরো গ্যালারী ভরা কেমন করে? সারা রাত ঘুম নাই, পরীক্ষার খাতায় যে কি লিখলাম কে জানে।
তবে বানিয়ে বানিয়ে যে লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা লিখেছিলাম, সেটা মনে আছে। রেজাল্ট হবার পর দেখা গেল ২ মার্কের জন্য ফেল করেছি, অতঃপর স্যাররা কি মনে করে গ্রেস দেয়াতে আমরা মোটামোটি সবাই উতরে গেলাম। আহ, কি সব দিন ছিল! মাঝে মাঝে মনে হয় কোন ভাবে টাইম মেশিন জোগাড় করে পিছিয়ে যাই। Bryan Adams ঠিকই গেয়েছেন, those were the best days of my life! Back in the winter of 2009।
দার্জিলিং জমজমাট! (প্রথম পর্ব)
দার্জিলিং জমজমাট! (দ্বিতীয় পর্ব)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।