আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না! সফিক এহসান
(৮ অক্টোবর ২০০৮ইং
বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রাগে আমি এখন রিতিমত কাঁপছি। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এতো রাতে এখন বাস পেলেই হয়। বাসের কাউন্টার সব বন্ধ হয়ে গেছে।
বৃষ্টির দিন বলেই হয়তো চা পানের দোকানগুলোও সব তাড়াতাড়ি বন্ধ। কোথাও যে একটু দাঁড়াবো, সেই উপায়ও নেই। হঠাৎ হঠাৎ দু’ একটা ট্যাক্সি-সি.এন.জি. চলে যাচ্ছে। কিন্তু বাসের কোন দেখা নেই। ইচ্ছে করলে সি.এন.জিতে যাওয়া যায়।
কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। ভাড়া কোন ব্যাপার না আজকে। বরং পকেটে এতোগুলো টাকা বলেই সি.এন.জিতে যাওয়া রিস্ক হয়ে যাবে। টাকাগুলোর কথা মনে হতেই রাগটা একটু কমলো। প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত বুলালাম।
মানিব্যাগটা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। একশ’ টাকার একটা বান্ডিল। মানিব্যাগ যে শেষ পর্যন্ত এক বান্ডিল টাকা এঁটে যায় সেটাই জানা ছিল না। বোকার মত আজ আবার জিনস্ পড়ে আসায় সাইড পকেটেও টাকা রাখতে পারছি না। টাকার চাপে মানিব্যাগ ফেটে না গেলেই হল।
সেটা হলেও এক রকম মন্দ হতো না। অন্ততঃ জীবনে গর্ব করে বলার মত একটা ব্যাপার হতো।
কিন্তু আপাতত সেকারণে বেশি খুশি হতে পারছি না। বারবারই মজুমদার সাহেবের ওপড় রাগ লাগছিল। কেন বাবা, ৫০০ টাকার নোটে টাকাগুলো দিলে কি হতো! বাংলাছবির নায়িকার বাবাদের মত এক বান্ডিল টাকা টেবিলের ওপর ছুড়ে দেবার দরকার কী? তাও আবার সরাসরি দিলে কোন কথা ছিল না।
ঘুষ দেবে তারও আবার কত স্টাইল! বাসায় ডিনারের দাওয়াত। খাওয়ার পর আবার ড্রিঙ্কস্! আমি অবশ্য ড্রিঙ্কস্ করি নি। মনে মনে ভাবছিলাম কতক্ষণে টাকাটা দেবে, তাড়াতাড়ি বাসায় যাব। রিমি নিশ্চয়ই এতোক্ষণে খুব চিন্তা করছে! ওর আবার মোবাইলও নেই যে ফোনে বলব চিন্তা না করতে। তা ব্যাটার সেদিকে নজর নেই।
সে রিতিমত ড্রিঙ্কস্ ট্রিঙ্কস্ করে বিরাট রাজনৈতিক আলাপ জুড়ে দিল! শেষ পর্যন্ত লজ্জ্বা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম- আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। বলেছিলাম তাই রক্ষা, নইলে হয়তো আজ সারা রাত বসে আধা মাতাল লোকটার বকবকানি শুনতে হতো।
শেষ পর্যন্ত যে টাকাটা পেয়েছি এটাই বড় কথা। এটাকে ঠিক ঘুষ বলা যায় না। আমি তো আর জোর করে এটা নিইনি।
মজুমদার সাহেবের সমস্যাও এমন কিছু ছিল না। এরচেয়ে অনেক বড় বড় ঘাপলা থাকা সত্যেও অনেকে বিল পেয়ে যায়। তা আমার সামান্য সহযোগিতায় যদি একটা লোকের পকেটে সরকারের কিছু বাড়তি টাকা চলে যায়, আর তাতে যদি সে খুশি হয়ে আমাকে কিছু টাকা দেয়ই- তাহলে তা ঘুষ হবে কেন? তাছাড়া এটাতো অল্প কিছু টাকা। রোডস্ এন্ড হাইওয়ে তে চাকরি করে লোকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে বাড়ি গাড়ি করে ফেলেছে। আর আমিতো তেমন কিছু করিনি।
রিমির অনেকদিন ধরে একটা টিভির শখ। ঢাকা শরে বোধহয় এমন কোন ভদ্রলোকের বাড়ি পাওয়া যাবে না যাদের বাসায় একটা রঙ্গিন টিভি নেই। তাই এই দশ হাজার টাকা নেয়াটা কোন পাপের মধ্যে পড়ে না। সম্ভব হলেএকটা মোবাইল! কত আর নিবে? দের-দুই হাজারের মধ্যে কত সুন্দর সুন্দর মোবাইল পাওয়া যায় আজকাল! অথচ- ওর তাও নেই!
আমি নিজের বিবেককেই এসব কথা বুঝাচ্ছিলাম। এমন সময় মাঝ বয়েসি একটা লোক এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল: কয়টা বাজে, ভাই?
আমি একটু সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম: প্রায় বারোটা।
লোকটা আনমনে বলল: এতো রাতে আর বাস পামু কিনা কে জানে? এর মধ্যে আবার গুড়িগুড়ি বৃষ্টি!
আমি লোকটার কথায় কোন উত্তর দিলাম না। এ ধরনের লোকদের বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই। দিনকাল খারাপ, তাছাড়া পকেটে এতোগুলো টাকা! আমি আড়চোখে লোকটার দিকে তাকালাম- পরনে হাফ হাতা শার্ট, ময়লা একটা প্যান্ট, পায়ে পুরনো একজোড়া চামড়ার সেন্ডেল। কার মনে কী আছে কে জানে? একটা বাসও আসছে না!
লোকটা আবার বলল: ভাইজান যাইবেন কই?
আমি আমতা আমতা করে বললাম: উত্তরা।
: আমি যাব খিলক্ষেত।
ভাইজানের কাছে কি লাইটার হবে? সিগারেট ধরাইতাম।
আমি বিপদ টের পেলাম। লোকটার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে ঘনিষ্ট হতে চাচ্ছে। লক্ষণ খুব খারাপ, প্রশ্রয় দেয়া একদমইঠিক হবে না। আমি স্পষ্ট করে বললাম: আমার কাছে কোন লাইটার নেই।
আমি সিগারেট খাই না।
: ও আচ্ছা। ভাই আপনি কী করেন?
আমি এবার চমকে উঠে লোকটার মুখের তিকে তাকালাম। লোকটার চোখেমুখে স্বভাবিক জিজ্ঞাসু ভঙ্গি। হয়তো আমার এতো চমকানোর কিছু নেই।
একটা লোক স্বাভাবিক কৌতুহল বশতঃ প্রশ্ন করতেই পারে। এতো রাতে বাসের জন্য অপেক্ষামান দু’জন পথচারী সময় কাটানোর জন্য কথাবার্তা বলবে- সিগারেট খাবে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু পকেটে এতোগুলো টাকা আছে বলেই হয়তো আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। বার বার মনে হচ্ছে, লোকটার কোন মতলব আছে।
সন্দেহের সুরে জবাব দিরাম: এই, ছোট খাট একটা চাকরী করি।
কেন?
লোকটার চেহারায় হঠাৎ হাসি ফুটে উঠলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল: ছোটখাট চাকরি করেন অথচ এতোগুলা টাকা পকেটে নিয়া ঘুরতাছেন? টাকা পয়সা একটু সাবধানে রাখবেন, দিনকাল খুব খারাপ!
আমি বিষ্ফোরিত চোখে দেখলাম লোকটার হাতে আমার টাকার বান্ডিলে ফুলে থাকা মানিব্যাগটা। লোকটা সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল: গুনে দেখেন সব ঠিক আছে কিনা। মানিব্যাগে কেউ এতো টাকা রাখে?
আমি মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে বোকার মত দাড়িয়ে রইলাম। কি করব বুঝতে পারছি না।
আমতা আমতা করে বললাম: আ-আপনি...
লোকটা বলল: এক সময় পেশদার ছিলাম। এখন শখে মারি। তবে এখন কারও পকেট মারলে আবার ফিরায়ে দেই। আর মজার ব্যাপার কি জানেন- আগে যখন পেটের দায়ে পকেট মারতাম তখন বহুবার ধরা পড়েছি। কিন্তু এখন আর পড়ি না! নিয়ত গুনে বরকত... হা হা হা।
আমি তখনও বোকার মত চেয়ে আছি। মাঝরাতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে ল্যাম্পপোষ্টের নিচে রহস্যময় আলোতে অচেনা একটা লোক, যে নাকি এক সময়কার পেশাদার পকেটমার- সব কিছুই এই মুহূর্তে স্বপ্নের মত লাগছে। নাকি দুঃস্বপ্ন!
লোকটা আমার ভ্যাবাচেকা ভাবটা বেশ উপভোগ করল। বোধহয় আগেও অনেককে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলেছে। তারপর পকেট থেকে সস্তা সিগারেট বের করে ধরালো।
নিজের ম্যাচ দিয়েই ধরালো! বেশ আয়েশ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল: ভাই সাহেবের নাম কী?
আমি আমতা আমতা করে বললাম: পাভেল। পাভেল রহমান।
লোকটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল: আমি শাজাহান। বাবা মা রাখছিল। অনেক আশা করে রাখছিলো মনেহয়।
হয়তো ভাবছিল- ছেলে বড় হয়ে রাজা-বাদশা জাতীয় কিছু হবে। কিন্তু ছেলে হইছে পকেটমার!
আমি ততক্ষণে ধাতস্ত হয়েছি। মানিব্যাগটা পকেটে রেখে হাত মেলালাম। তারপর বললাম: পকেটমার হয়েছিলেন কেন?
লোকটা সহজভাবে হেসে বলল: এই প্রশ্নটা করবেন জানতাম। সবাই করে।
আরও একটা প্রশ্ন করবেন একটু পরে। পকেট মারা ছাইড়া দিলাম কেন? দু’টোরই উত্তর দিতাছি। তার আগে চলেন কোথাও বসি। বৃষ্টিটা বাড়বে মনে হয়, ভিজা যাইতাছি! আপনি বোধহয় এইদিকে নতুন আসছেন, নয়তো জানতেন- এখানে সারা রাত দাঁড়ায়ে থাকলেও কোন বাস পাবেন না। একটু সামনেই একটা যাত্রি ছাউনি আছে, ওখানে গেলে বাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আমি কিছুটা অনিশ্চয়তার সাথে লোকটার সাথে হাঁটতে লাগলাম। লোকটাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। আবার বিশ্বাস না করেও কোন উপায় নেই। উনি তো আমার টাকাগুলো নিয়েই গিয়েছিল। অন্যকোন উদ্দেশ্য থাকলে ফেরত না দিয়ে চলে গেলেই পারতো।
একটুখানি এগিয়ে মোড় ঘুরতেই একটা ছাউনি চোখে পড়ল। আমরা দু’জনেই বসে পড়লাম।
শাজাহান সিগারেট শেষ করে বলল: আমি গ্রামের ছেলে। কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম ঢাকায় আসি। ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ ছিল না।
সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় হঠাৎ একদিন বাবা মারা গেল। আমার লেখাপড়া তখন প্রায় বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। গ্রামে অনেক কষ্টে চেয়ে চিন্তে মা আর ছোটবোনের সংসার চলে। ইন্টার পরীক্ষার আগে চার মাসের ভাড়া বাকি পড়ায় মেস থেকে আমাকে বাইর করে দেয়ার নোটিস দিল। সামনে পরীক্ষা, পরীক্ষার ফিস দেওয়ার টাকা নাই, তার ওপড় মেস ভাড়া।
দিনে একবেলা খাই, তাও কোন কোন দিন জোটে না- এমন অবস্থা। সে অবস্থায় জীবনে প্রথম পকেট মারি। খুব কাঁচা হাতের কাজ। সাথে সাথে ধরা পড়লাম। অনেক মারধর করে পাবলিক আমাকে থানায় নিয়ে গেল।
পুলিশ আমার অবস্থা দেখে কেস নিল না। হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। প্রায় দশ-বার দিন প্রচন্ড জ্বরে ভুগে সুস্থ হয়ে নিজেকে আবিস্কার করলাম হাসপাতালের বারান্দায়। আমার জিনিসপত্র সব মেস ম্যানেজার ভাড়া বাবদ কেটে রেখে দিছে। জীবনের কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলাম- পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর! এখানে কেউ কারো নয়।
সেই হাসপাতালের বারান্দায় বসেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পকেটমার হব। অনেক বড় পকেটমার! এইচ.এস.সি টা আর দেয়া হল না। শুরু করলাম সেই হাসপাতাল থেকেই। হাসপাতালের এক দাড়োয়ানের পকেট মেরে পাইলাম দুইশ’ এগার টাকা। জীবনের প্রথম রোজগার! পকেট মারাটাকে পেশা বানাইয়া ফেললাম।
প্রথম প্রথম তেমন কিছু জানতাম না। এসবেরও যে ওস্তাদ আছে, দিক্ষা নিতে হয়, ঢাকা শহরে কয়টা দল, কী তাদের নীতি-রিতি; কিছুই জানতাম না। প্রথম প্রথম প্রতি দশটায় একটা ধরা পরতাম। কোন কোন বার প্রচুর মার খাইছি। কোন কোনটায় পালিয়ে বাচছি।
এমনকি একটু পাকা হয়ে যাওয়ার পর একবার যার পকেট মারছি উল্টো তারেই পকেটমার বলে পাবলিকের মার খাওয়াছি! তারপর পরিচয় হল মোকছেদ ওস্তাদের সাথে। বিরাট কামেল লোক! মহান একজন মানুষ। ওনার সাথে পরিচয়টাও এক ঘটনা- গাবতলী থেকে বাসে উঠছি। দেখি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সুফি সুফি চেহারার একলোক সিট ধরে দাঁড়ায়ে আছে। বেশ উদাস উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো।
প্রচন্ড ভিড়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা। আমার আবার সেদিন রোজগার একেবারে নাই। দিলাম পকেটে হাত ঢুকাইয়া। মিরপুরে এসে নাইমা পড়লাম। পরিচিত এক চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে মেরে দেয়া মানিব্যাগটা খুলে দেখি মাত্র ২ টাকা! সাথে একটা চিরকুট; তাতে লেখা- “খুব হতাশ হইছেন ভাইজান?”
ঠিক তখনই আমার পাশে একটা লোক চায়ের অর্ডার দিতে দিতে বসল।
আমার পিঠে একটা হাত রেখে বলল: দুই টাকার জন্যে নিজের সাতান্ন টাকা খুয়াইলা মিয়া?
আমি চমকে উঠে তাকাইয়া দেখি সেই সুফি সুফি চেহারার লোকটা। ঘন গোফের নিচে দুষ্টুমির হাসি হেসে আমার দিকে তাকাইয়া আছে। হাতে আমার নিজের মানিব্যাগ। আমার মানিব্যাগটা হাতে দিতে দিতে বলল: ছয় টাকা কম আছে। তোমার আর আমার ভাড়াটা কন্টেক্টারকে দিলাম তো।
তুমি তো মিয়া ভাড়া না দিয়াই নাইমা গেলা! কন্টাক্টাররে কোন দিন ঠকাইবা না। ব্যবসায় বরকত থাকে না।
আমি ভ্যাবাচেকা খাইয়া তাকাইয়া রইলাম। ঠিক একটু আগে যেমন আপনি আমার দিকে চাইয়াছিলেন।
লোকটা আমার হাত থেকে তার মানিব্যাগটা নিয়া পকেটে রাখতে রাখতে বলল: আমার নাম মোকছেদ।
সবাই মোকছেদ ওস্তাদ কয়। তা এই লাইনে কয়দিন মিয়া?
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। মোকছেদ ওস্তাদ আমার পিঠে চাপড় দিয়ে বলল: বুঝছি- কোন ওস্তাদ নাই! ওস্তাদের দিক্ষা ছাড়া কি এই কাম হয়? আমার সাগরেদ হইয়া যাও- তোমারে আমার পছন্দ হইছে। কেউ চাইলেই মোকছেদ ওস্তাদের সাগরেদ হইতে পারে না। মোকছেদ ওস্তাদ নিজে সাগরেদ বানায়!
উনি আমাকে শিষ্য বানাইয়া অনেক তালিম দিয়েছিলেন।
ওনার তালিম নেবার পর আর কোনদিন ধরা পড়ি নাই। পড়লেও মার খাই নাই। ভালই চলছিল জীবন। সারাদিন পকেট মেরে রাতে ভরপেট খাইয়া ঘুম! গ্রামে টাকা পাঠাই। সেই টাকায় ছোটবোনের বিয়ে হল।
এ পর্যন্ত বলে শাজাহান থামল। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিল। আমি ঘোর লাগা চোখে শুনছিলাম। শাজাহান চুপ হয়ে যাবার পর বললাম: ছেড়ে দিলেন কেন?
শাজাহান বিষন্ন স্বরে বলল: শরীরের ভেতর কোথায় যেন বিবেক নামক একটা জিনিস লুকাইয়া ছিল। সেদিন সারাদিনে তেমন কোন রোজগার হয় নাই।
সন্ধ্যার দিকে দাড়িওয়ালা, পায়জামা পাঞ্জাবি পড়া এক হুজুররে পাইলাম। পাঞ্জাবির সাইড পকেটে অনেকগুলো টাকা নিয়ে চিল্লায় না তাবলিকে যেন যাইতাছে। লোকাল বাসে ভিড়ের মধ্যে গাট্টি-বচ্কা নিয়ে অনেক কষ্টে উঠতাছিল। আমি আস্তে করে পকেটে হাত দিছি। সাত বছরের পাঁকা হাত।
এরমধ্যে আবার মোকছেদ ওস্তাদের তালিম নিছি সাড়ে চার বছর! কোনদিন ধরা পড়ি নাই তার পর থেকে। অথচ সেই হুজুর টাইপের লোকটা খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল। কী শক্তি লোকটার! আমার হাত যেন অসাড় হয়ে গেল। ধরা জীবনে অনেক পড়েছি, কিন্তু এতো ভয় কোনদিন পাইনি। অসহায় চোখে লোকটার চোখের দিকে তাকালাম।
কি যেন ভাবলো লোকটা। তারপর দু’চোখে রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে আমার হাতটা অবজ্ঞা ভরে ছেড়ে দিয়ে বলল: যাহ্ পকেট মারের বাচ্চা- তোকে ছেড়ে দিলাম!
তারপর দৌড়ে বাসে উঠে চলে গেল। ধরা জীবনে কম পড়িনি। মার-অপমানও কম পাইনি। কিন্তু লোকটার চোখে যে ঘৃণা দেখেছি তা আর কোন দিন পাই নাই।
এরচেয়ে লোকটা যদি গণধোলাই দিয়ে আধমরা করেও ফেলতো, বোধহয় এতো খারাপ লাগতো না! তিন দিন কাজে বের হইনি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হইতো এক জোড়া চোখ প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে বলছে- যাহ্ পকেট মারের বাচ্চা- তোকে ছেড়ে দিলাম!
প্রচন্ড কষ্ট লাগতো তখন। আমার বাবা তো পকেটমার না। অনেক গরিব ছিল কিন্তু পকেটমার না। আমার বাবা কেন আমার জন্য গালি শুনবে?
সেদিনই পকেট মারা ছেড়ে দিলাম।
জমানো টাকা দিয়ে একটা রিক্সা-ভ্যানের গ্যারেজ দিয়ে বসলাম। এখনও সেই ব্যবসাতেই আছি। মাঝে মাঝে শখ করে পকেট মারি। লোকজনকে সতর্ক করে দেই। জীবন আমার সাথে যে নিষ্ঠুরতা দেখাইছে তাতে একজনের ঘৃণা ভরা চোখ দেখে আমার এতো দিনের পুরোনো পেশা ছেড়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না।
কিন্তু কি যে ছিল সেই চোখে, সেই কথায়- তা কেবল আমিই জানি। অথচ সমাজে কত বড় বড় অপরাধী বাস করে। কত বড় বড় মানুষেরা বড় বড় জায়গায় বসে দুর্নীতি করে, ঘুষ খায়, টেবিলে বইসা পকেট মারে, মানুষের গলা কাটে। তারা যদি জানতো মানুষের কত ঘৃণা তাদের প্রতি তাইলে মনে হয় সবাই আমার মত ওসব ছাইড়া দিয়া যত কষ্টেই হোক সৎ পথে চলার চেষ্টা করত।
একটা লোকাল বাস এয়ারপোর্ট-উত্তরা-টঙ্গী বলতে বলতে আসছে।
শাজাহান বলল: যান ভাই- এটাই লাস্ট ট্রিপ, আর বাস পাবেন না। সাবধানে যাবেন, টাকা পয়সা খুব সাবধানে রাখতে হয়।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু বাসের দিকে না গিয়ে হাঁটতে লাগলাম মজুমদার সাহেবের বাড়ির দিকে। টাকাগুলো তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসা দরকার।
এই টাকায় অনেক ঘৃণা লেগে আছে। এগুলো নিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে না। রিমি-আর আমার ঘরে অনেক কিছু না থাকলেও একটুখানি ভালবাসা আছে। এগুলো নিয়ে গিয়ে সেই ভালবাসাটুকু নষ্ট করা ঠিক হবে না। পেছনে না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম শাজাহান আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
এই সমাজে শাজাহানদের ভিষণ দরকার!
----------০---------- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।