সকালে আমাকে দেখেই বন্ধু উড়াল পঙ্খী (যার পূর্বের নাম মো: সায়েদুর রহমান) বিরক্ত গলায় বলল --'তুই এই ভোর বেলা আমাকে কবিতা শুনাতে আসছিস ?' আমি বললাম --'হ্যা দোস্ত । কারণ আছে । কাল সারারাত ধরে এই কবিতা লিখেছি । সারা শরীরে উত্তেজনা । আমার ধারণা এই রকম ভাল কবিতা 'খেলারাম খেলে যা' খ্যাত সৈয়দ শামসুল হকও কখনও লেখে নাই ।
শামসুর রহমান দু একটা লিখলেও লিখতে পারে, তাও সিওর না। পড়ে দেখ । '
উড়াল পঙ্খী হাই তুলতে তুলতে উদাস গলায় বলল --'এ্ইসব পড়ার ধৈর্য আমার নাই । তাছাড়া কবিতা জিনিসটা আমাকে কখনও আকর্ষণ করে না । কেন করে না তাও ঠিক জানি না ।
'
আমি বললাম --'কিন্তু দোস্ত --আমার কবিতা একদম অন্যরকম । '
'যেই রকম্ই হোক । শোন তোকে একটা ঘটনা বলি । আমার দাদা যখন মারা গেল তখন আমি এইটে পড়ি -- বাসার সবাই চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে । কিন্তু আমার চোখ খটখটা শুকনা ।
দেখলাম আমার যে চাচা দাদা মারা যাবার পর গ্রামের বাড়ির জমিজামা বিক্রি করার জন্য বেশি উৎসাহী তিনি সবচেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন । আমাকে দেখে তিনি বিরক্ত গলায় বললেন দাদা মারা গেছে তোমার চোখে পানি নাই কেন? আমি বললাম--পানি আসতেছে না চাচা । তিনি বললেন--এইটা কেমন কথা । দাদা তো তোমাকে কম আদর করেন নাই । আচ্ছা যাই হোক, শুন তুমি এখন থেকে কবিতার বই পড়বা ।
পল্লীকবি জসীসউদ্দিনের 'এইখানে তোর দাদির করব ডালিম গাছের তলে' দিয়ে শুরু কর -- কবিতা পড়লে তোমরা দিলটা নরম হবে, তখন চোখের কোনায় আপনা আপনি পানি আসবে। '
আমি বললাম --'এখন আপনা আপনি পানি আসে ?'
'নাহ -- কবিতা টবিতা আমারে দিয়ে হবে না । ঘরে গ্লিসারিন এনে রাখছি । কেউ মারা গেলে কাজে দেয়। আমার ধারণা আমার পূর্ব পুরুষেরা এক সময় প্রচুর কান্নাকাটি করেছে ।
এই কারণে এখন আর আমার চোখে পানি আসতেছে না । '
আমি চিন্তিত কন্ঠে বললাম 'কিন্তু এখন আমার কি উপায় ? কবিতা কাকে দেখাবো ?'
'উপায় মানে ? বাংলাদেশে কবির অভাব আছে নাকি ! শাহবাগের আজিজ মার্কেটে সন্ধ্যার পর কবিদের মেলা বসে । এর ভেতর একজন আছে বিদগ্ধ কবি । তার কাছে যা । তোর কবিতা পড়ে সে যা বলে ধরে নে সেটাই ফাইনাল ।
'
'বিদগ্ধ কবি মানে ?'
'বিদগ্ধ মানে বিশেষ ভাবে দগ্ধ । কয়লা পুড়ে যেখন হীরা হয় তেমন যেসব কবির অন্তরটা পুড়ে পুড়ে এখন হীরা হয়েছে তাদেরকে বিদগ্ধ টাইটেল দেয়া হয় । যতদূর শুনেছি তাকে বিদগ্ধ টাইটেল দেয়া হয়েছে । '
'বলিস কি !'
'তোর কবিতার বিষয়বস্তু কি? প্রেম?'
'হ্যা --প্রেমই বলা যায় । '
'বলা যায় মানে?'
'মানে হলো ছেলেটা মেয়েটাকে সামনা সামনি প্রেম নিবেদন করতে পারছে না ।
তাই প্রেমের কবিতা লিখে গোপনে তার কাছে ভালোবাসার বার্তা জানায় । আমার কবিতার শিরোনাম হলো একগুচ্ছ প্রেমের ঢিলা কবিতা । '
'ঢিলা কবিতার বিষয়টা ক্লিয়ার বুঝলাম না । প্রেমের আবার টাইট - ঢিলা আছে নাকি? '
'আরে বেকুব --এই ঢিলা সেই ঢিলা না । ছেলেটার তো সাহস ছিল না যে মেয়েটার কাছে গিয়ে কবিতা নিয়ে দাড়ায় ।
তাই সে কবিতাগুলা একটা ইটার সাথে বেধে ঢিলা মেরে জানালা দিয়ে মেয়েটার বেডরুমে পাঠাত । তাই কবিতার নাম ঢিলা কবিতা । '
'ও আচ্ছা । যাই হোক । এইসব কবিতা টবিতা আমি বুঝি না ।
ও ভাল কথা --ওনার কাছে যাবার সময় কিন্তু বাংলা নিয়া যাইস । '
'বাংলা মানে?'
'বাংলা কি বুঝ না চান্দু ?'
'বাংলা -- ও আচ্ছা বাংলা । বুচ্ছি । '
'জিনিস ছাড়া ওনারা কোন কথা বলেন না । '
'কিন্তু --এই জিনিস আমি পাব কোথায়?'
'আমাদের বাসার নিচে যে দারোয়ান আছে সে ব্যবস্থা করে দিবে ।
গিয়া বলবি আমার একটা এরশাদ লাগবে । '
'এরশাদ লাগবে !'
'হ্যা । এ্ইটা হইল কোড নেইম । অবশ্য মওদুদও বলতে পারিস । তবে এরশাদটাই ভাল হবে ।
কবিতার বিষয় তো । '
উড়াল পঙ্খীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সন্ধ্যার পর পরই আজিজ মার্কেটে উপস্থিত হলাম । ভীড় সামলে আস্তে আস্তে হাঁটতে হচ্ছে । জোরে হাঁটলে ঝুলির ভেতর এরশাদ টু টাং শব্দ করে । বেশি শব্দ হলে আবার আরেক সমস্যা ।
পুলিশ ব্যাগ সার্চ টার্চ করতে চাইতে পারে । ঝুলিতে এরশাদ সহকারে ধরা পড়লে বিরাট কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ।
আনন্দের বিষয় বিদগ্ধ কবিকে জায়গা মতোই পাওয়া গেল । সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে গোল হয়ে মেঝেতে বসেছেন । মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথার চুল পনিটেল করা, দেখলেই একটা শ্রদ্ধার ভাব এসে যায় ।
বিদগ্ধ কবি বললেন --'ঢাকা শহরে কাক আর কবির সংখ্যা প্রায় সমান । দুই একটা কাক কবি এদিক সেদিক হইতে পারে । '
চ্যাঙরা মতো এক সাগরেগ লাফ দিয়ে দাড়িয়ে বলল 'ঢাকা শহরে কাক পাইলেন কই -- আমি তো শুধু কবি দেখি । '
বিদগ্ধ কবি বিরক্ত কন্ঠে বললেন 'আমি রেজিস্ট্রি কবির কথা বলতেছি ফরিদ। তুমি কি অলরেডি খাইয়া আসছ নাকি ? বস ।
'
চ্যাঙড়া্ লোকটা ধমক খেয়ে চুপসে গেল । বিগদ্ধ কবি বলল--'কবি হিসেবে রেজিস্ট্রি আছে?'
আমি বললাম--'জ্বি না । তবে আজই রেজিস্ট্রি করব। জিনিস নিয়ে আসছি । ' আমি ঝুলি থেকে জিনিসটা বের করে দিলাম ।
জিনিস দেখে কবির ভেতর কোন ভাবান্তর দেখা গেল না ।
চ্যাঙড়া্ সাগরেদ ফরিদ বলল --'রেজিস্ট্রি করতে তো দুইটা লাগে । আচ্ছা যাক আপনি ছাত্র মানুষ, হাফ টিকিট । '
কবি বলল--'দেখি কি কবিতা । ' আমি কবিতার খাতা এগিয়ে দিলাম ।
একগুচ্ছ প্রেমের ঢিলা কবিতা শিরোনাম দেখেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল । আমি তাড়াতাড়ি ঢিলা কবিতার বিষয়টা ব্যাখ্যা করলাম । বিদগ্ধ কবি বললেন --' প্রেমের বার্তা জানাতে জানালায় ঢিল--এইসব প্রিমিটিভ চিন্তা ভাবনা থেকে বাংলার কবি সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে । বর্তমানে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে । এইসব ঢিলা-ঢিলির কারবার অনেক আগেই মিউজিয়ামে চলে গেছে ।
প্রেমের বার্তা দেয়ার এখন অনেক সিস্টেম আছে । মোবাইল আছে, এসএমএস আছে, ইন্টারনেরট আছে । '
আমি মুখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে রইলাম । মোবাইল-ইন্টারনেটের বিষয়টা মাথায় আসে নাই । আসা উচিৎ ছিল ।
তাহলে এই ভরা মজলিশে এভাবে অপমানিত হতে হতো না ।
বিদগ্ধ কবি বললেন --'কোন ইংরেজ বন্ধু আছে?'
'ইংরেজ বন্ধু ? জ্বি না । '
কবি সবার দিকে তাকিয়ে বলল --'এইখানে কারও ইংরেজ বন্ধু আছে?'
একজন হাত তুলল । বিদগ্ধ কবি আমার দিকে তাকিয়ে বলল--'খাতাটা তাকে দাও । সে তার ইংজের বন্ধুকে দিবে ।
'
আমি কিছু বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে আছি । বিদগ্ধ কবি বলল --'আমাদের তো লাগে না, আমরা পাছা ধৌত করি । ইংরেজরা পুছে । কাগজের কোয়ালিটি ভাল । এইটা তার পুছার কাজে লাগবে ।
'
এ কথায় কেউ হাসল না । সবাই চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ফরিদ নামের সেই চ্যাঙড়া লোকটা শুধু বলল --'ভাইজানের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে গেছে । আবার নতুন করে রেজিস্ট্রি করতে হবে । '
বড় ধরনের অপমানজনক কথাবার্তা ।
চোখে পানি চলে এসেছে । সবাই একটা অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে আমার হাতে গোপন কোন নথি পত্র । এখন আমি সেই নথি ইংরেজ বন্ধুওয়ালা সেই ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করব । আমি কবিতার খাতাটা রেখে নীরবে বাসায় চলে আসলাম ।
এরপর অনেক দিন হয়ে গেল । কবিতা লেখার চেষ্টা আর করা হয়নি । কাউকে ব্লগ কিংবা পত্র পত্রিকায় কবিতা লিখতে দেখলে খুব ঈর্ষা হয় । মনে হয় আহ ! আমিও যদি ওরকম লিখতে পারতাম । একমিনিট--ফোন বাজছে ।
উড়াল পঙ্খী । এখনই তার ওখানে যেতে হবে । কি নাকি সব জটিল আলোচনা আছে । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।