জন্মের পর ৪ বছর পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম, হয়ত সে কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, গ্রাম সবসময় ভালোই লাগে। ঢাকায় থাকি দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু প্রত্যেকবছরই ঈদের ২-৩দিন আগেই চট্টগ্রামে চলে যাই, শহরের বাসায় থাকি, ঈদের দিন সকালে গ্রামে যাই। কিন্তু এইবার যাওয়া হয় নাই।
ঢাকাতেই আছি, আর পুরোনো দিনের ঈদের স্মৃতিগুলো মনে করছি।
দীর্ঘদিন থেকে একটা নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছিলো, ঈদের দিন সকালে পরিবারের সবাই দলবেঁধে গ্রামের বাড়ী যাওয়া। দলবেঁধে বলতে বাবা, মা, আমরা তিন ভাই, দুইবোন, প্রথমদিকে একভাবী, পরে দুইভাবী অনেক বড় একটা গ্রুপ। কেউ কেউ ঢাকায় থাকতাম, তাই সবার একসাথে থাকা হতো না, ঈদ উপলক্ষ্যেই একত্রিত হওয়া যেত।
কিন্তু ঈদের দিন সকালবেলাটা ছিলো আমাদের জন্য মারাত্মক ভীতিকর। দেখা যেত চাঁনরাতে ভাইবোন সকলে কেনাকাটা, গল্পগুজব করতে করতে রাত ২টা-৩টা বেজে যেত।
সবাই সবাইকে বলতাম, ঘুমিয়ে যাও, সকালে উঠতে না পারলে আব্বা বকা দিবে। কিন্তু, কেউ ঘুমাতে যেতাম না, আড্ডাতেই যত মজা ছিলো।
আব্বা আম্মা ঘুম থেকে খুব ভোরে উঠে যেত, ফজরের নামাজের আগেই। আম্মা খাবার তৈরী করে নিতো, সকালের জন্য, গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আব্বা ঈদের জন্য সবার আগে তৈরী হয়ে যেত, কিন্তু আমরা অনেকেই তখনো ঘুমে।
আমাদের প্ল্যান থাকে, ঈদের নামাজ গ্রামের মসজিদে পড়ার। ঈদের নামাজ হয় সকাল ৯টায়, অতএব আমাদের অন্তত সকাল সাড়ে সাতটার আগেই বাসা থেকে রওনা হতে হবে। কিন্তু সাতটা বাজার পরও কারো কারো ঘুম ভাঙ্গে না। পরে তাড়াহুড়ো করে গোসল করার জন্য বাথরুমে লাইন দেওয়া, দরজা ধাক্কানো, একটু পর পর আব্বার বকা দেওয়া,'' এখনো তৈরী হও নাই? দেরী হলে তো ঈদের নামাজ পড়তে পারবো না। ''
তবে আব্বা সবাইকে বলতো, ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে ফজরের নামাজ পড়ে নেওয়ার জন্য।
ঈদের নামাজ হলো ওয়াজিব, আর ফজরের নামাজ হলো ফরজ। ফরজ নামাজ বাদ দিয়ে ওয়াজিব নামাজের জন্য দৌড়াদৌড়ি করা ঠিক নয়।
সাড়ে সাতটায় যাওয়ার প্ল্যান থাকলেও বাসা থেকে বের হতে হতে আটটা বেজে যেতো। মাঝে মাঝে রাস্তা ব্লক করে ঈদ জামাত হয়, এর কারণে গাড়ি অপেক্ষা করতে হয় কিংবা ঘুরে যেতে হয়। একবছর এই রকম ঝামেলাতে পড়ে গিয়ে পথে দেরী হয়ে গেল।
গ্রামের মসজিদে ঈদের নামাজ শুরু হতে আর ১৫ মিনিট মতো বাকী আছে, কিন্তু আমাদের যেতে লাগবে আরো প্রায় ৩০ মিনিট। যদি কোনো কারণে ঈদের নামাজ মিস হয়ে যায়, তবে আব্বার বকাটা কার উপর দিয়ে যাবে, সেটা নিয়ে সবাই আড়ালে হাসাহাসি করতাম। আব্বা অস্হির হয়ে ঘড়ি দেখতেন, আর ভাইবোন সবাইকে আরেক রাউন্ড করে বকা দিতেন। আমরা সকলেই দাবী করতাম, আমি তো রেডীই ছিলাম, মেজোভাইয়ের জন্য আজকে দেরী হয়ে গেছে। মেজো ভাই বলতো, আমি না, ছোট বোনের জন্য দেরী।
এভাবে সবাই পর্যায়ক্রমে সবাই নিজেকে বিপদমুক্ত রাখারচেষ্টা করতাম।
ঈদের নামাজ পড়ে মুরুব্বীদের কবর জেয়ারত করতে যেতাম, তারপর আশাপাশে আত্মীয়স্বজনদের বাড়ী ঘুরে আসতাম ভাইরা। ঈদের দিন দুপুরে আমাদের সবার একটা অলিখিত দাওয়াত থাকতো বড়বোনের বাড়ীতে। তবে বড়বোনের বাড়ীতে যাওয়াটা ছিলো ঈদের দিনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা। আমরা ভাই বোন ৫জন, চাচাতো ভাই, ভাইয়ের ছেলে, ফুফাতো ভাই, তাদের বাচ্চারা সহ প্রায় ১২-১৫জন দলবেঁধে হেটে হেটে যেতাম বড় আপার বাড়ীতে, প্রায় ৩ কিলোমিটার।
কিন্তু মাঝে নদী পার হতে হয়, হালদা নদী।
জোয়ার থাকলে কোনো সমস্যা হতো না, কিন্তু ভাটা থাকলে নৌকা করে নদী পাওয়া হওয়াটা বড়ই বিপদজনক, কারণ নৌকা পারাপার করার জন্য কোনো ঘাট নাই, একটাই নৌকা থাকে শুধু। মাঝি ব্যস্ত থাকলে মাঝির পিচ্ছি ছেলে নৌকা পার করায়। ভাটা থাকার কারণে কাদাতে মাখামাখি হয়েছিলাম অনেকবার। আর একবার জোয়ারের সময় নৌকাতে অতিরিক্ত মানুষ উঠে নৌকা উল্ঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।
এই সাইজের একটা নৌকাতে পিচ্ছি একজন মাঝি, ভরা জোয়ারে ১২-১৩ জন উঠলে নৌকার অবস্হা শোচনীয় হয়ে দাড়ায়।
বিকালের দিকে গ্রাম থেকে রওনা দেওয়ার পথে ফুফারবাড়ী, নানাবাড়ী, খালারবাড়ী সব একে একে ঘুরে ঘুরে শহরের বাসায় পৌঁছাতাম রাত প্রায় ১০-১১টা বেজে যেতো।
তবে সবচেয়ে মজা হয়েছিলো ২০০৩ কি ২০০৪ সালের দিকে। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সবাই খুব কাহিল, রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বাসায় এসে পৌঁছার পর দেখি বাসার চাবি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় বড় ২টা তালা লাগিয়ে গেলাম, কিন্তু কারো কাছেই চাবীটা খুজে পাওয়া গেলো না।
বড় হাতুড়ি এনে তালা ভাঙ্গার চেষ্টা চালানো হলো, কিন্তু সেটা ভাঙ্গলো না।
তালাচাবীওয়ালা ছাড়া ভরসা নাই, শেষে একআত্মীয়কে (যার মটরসাইকেল আছে) সাথে নিয়ে বড়ভাই বের হলো তালাচাবীওয়ালার সন্ধানে। আমরা সবাই বাইরে দাড়িয়েছিলাম প্রায় ২ ঘন্টা। রাত দুইটার দিকে এক তালাচাবীওয়ালাকে ঘুমথেকে ডেকে তুলে আনা হলো আগ্রাবাদ এলাকা থেকে, কন্ডিশন হলো, তাকে আবার পৌঁছিয়ে দিতে হবে (আন্দরকিল্লা এলাকা থেকে)।
আব্বা মারা গেছেন ৬ বছর আগে।
এরপর থেকে নিয়ম করে বাড়ী যাওয়াটা কমে আসছে ধীরে ধীরে, বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বিদেশে থাকে এখন, একভাইও পরিবার নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। আস্তে আস্তে সবাই দুরে চলে যাচ্ছি।
ঈদের দিনে বাসায় অলস বসে আছি। ছোট ছোট টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা মনে পড়ছে। তার কিছু লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করলাম নিজের ডায়েরী হিসাবে।
সবাইকে ধন্যবাদ। ঈদ মোবারক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।