ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায় পৌরাণিক কাহিনিতে বলে, সুন্দ উপসুন্দ দুই ভাই প্রবল প্রতাপশালী দৈত্য ছিল। এদের মত ধার্মিক সে যুগে আর কেউ ছিল না। কিন্তু দুই ভাই ছিল ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ত্রিভুবন জয় করবে, এই তাঁদের আশা। তাই বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে এরা শুরু করল কঠিন তপস্যা।
সহস্র বছর পর, সে তপস্যার গুণে তাঁদের সামনে এলেন ব্রহ্মা। বলো মুনি, কি বর চাও। দুজনে বর চাইল, প্রভু, আমাদের অমর করে দিন। ব্রহ্মা মাথা চুলকালেন। এরা একেতে রাক্ষস, দুয়েতে ত্রিভুবন দখলের চিন্তা মাথায় রাখে।
অমর করে দিলেই তো হয়েছে। স্বর্গ-মর্ত্য-নরক জ্বালিয়ে খাবে। কিছুক্ষণ চিন্তার পর ব্রহ্মা নতুন আইডিয়া পেলেন। শব্দের প্যাঁচগোচ মেরে বললেন, যাও বৎস, অন্য কেউ তোমাদের মারতে পারবে না।
দুই ভাই তো দারুণ খুশি হয়ে ড্যাং ড্যাং করে ত্রিভুবন জ্বালিয়ে খেতে লাগল।
এই ইন্দ্রলোকে গিয়ে র্যাগ দেয়, এই আবার স্বর্গের সুধা আর নরকের আগুন মিশিয়ে কেমিস্ট্রি এক্সপেরিমেন্ট করে। দেবতা হেডকোয়ার্টারের তিন প্রধান অতিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বিচার দিলেন। হেই বাবা, হচ্ছে কি এসব? আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি? নতুন নতুন রাক্কস বসে তপস্যা করবে, তাতেই তুমি ওদের ভাল ভাল বর দেবে? আমাদের হাইট অফ রেসপেক্ট বলেও তো একটা কথা আছে! তাত্তারি পিতিবিধান কর, নইলে আমরাও চললুম বিন্ধ্য পর্বতে চড়তে।
ব্রহ্মা পুক করে পানের পিক ফেললেন। রোসো, বাবারা, রোসো।
বাবার থানে এয়েচো, একটু ঠাণ্ডা-গরম কিছু খাও। ওরে, কে কোথায় আছিস, ওদের তিনটে চেয়ার দে। সেই কখখন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েচে!
তিন মহাপদ্ম বছর কেটে গেল। না এল চেয়ার, না এল ঠাণ্ডা গরম। তিন দেবতা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
ব্রহ্মাকে একটু বিব্রত দেখায়। আসলে হয়েচে কি, কাজের লোকের খুব অভাব, বুঝলে বাবারা? কলিকাল কিনা। তা ভাল কোন অপ্সরা পেলে পাঠিয়ে দিও, হ্যাঁ? মানে... তিন দেবতার রোষ কস বুলবুলি মার্কা চোখ দেখে ব্রহ্মা আরেকবার ঢোক গিললেন।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, পিতিবিধান। তা খুব সোজা কিন্তু।
ত্রিভুবনের সমস্ত ভাল ভাল বস্তু দিয়ে বানাও এক নারীকে, আর তাঁকে পাঠিয়ে দাও ওই দুই বজ্জাতের কাছে। ব্যাস, কম্ম কাবার!
বলা শেষ হয়েছে কি হয়নি, সাথে সাথে দাঁত কসকস করতে করতে টিকি মাথায় বেদব্যাস ইয়াব্বড় এক কলম নিয়ে হাজির। তবে রে শালো, আমার কম্ম কাবার? আমার? আজ তোর মন্থনদ্বারে কলম ঢুকিয়ে ক্যাবারে ড্যান্স শেখাব। আয় শালো আয়। এই বলে ব্রহ্মা-বেদব্যাস চুলোচুলি-টিকিটাকা-হুটোপাটি খেতে লাগলেন।
কোথায় লাগে শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই! অবস্থা দেখে দেবতা তিনজনই কেটে পড়লেন। কোথায়? টু দ্য গবেষণাগার!
গবেষণাগারে তিনজনে বিশ্বের যত ভাল ভাল জিনিস আছে তাই এনে জড় করতে লাগলেন। আধ-ঘণ্টা পরে দেখা গেল, বাকি দুজনে এনেছেন ফুল-ফল-পাখি-সবুজ গাছ ইত্যাদি ইত্যাদি, আর কার্তিক যত বাংলা-ইংরেজি-ফরাসি মদ, মহাদেবের গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা সব এনে জড় করেছেন। ইন্দ্র নাক ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওরে নচ্ছার! ই কি এনেছিস?' কার্তিক হিক্কা তুলে বললেন, আজ্ঞে, মালঃ। ইন্দ্র এবার হুঙ্কার ছেড়ে কার্তিকের মাথায় গাট্টা মেরে বসলেন।
কার্তিক মাথা ধরে হাইমাই করে উঠলেন। আরে বাবা, মাল, মাল। সনাতন ভাষা বোঝ না, টোল ফাঁকি দিয়েছিলে নাকি? নারীর মাঝে নেশা ঢুকাতে হবে না? তাই তো নিয়ে এলাম।
ইন্দ্র এবার আশেপাশে তাকালেন। কাঁচামাল সব এসেছে।
এখন কারিগরের অপেক্ষা। তিনি ময়দানব-কে ডাকলেন। অ্যাই ব্যাটা দৈত্য, যা মর্ত্যে যা। কবি কালিদাসকে ডেকে নিয়ে আয়।
কালিদাস তখন লুঙ্গি পরে কানে তিসির তেল লাগিয়ে বারিধারার অমানুষদের ব্যঙ্গ করে কাব্য লিখছিলেন।
ধনবান যক্ষগণ বাস করে যথা
বারিধারা নগরি নাম পাইবে হেথা।
পুরীর বাইরে এক পাইবে উদ্যান
লুঙ্গি পরে মহাদেব তথা রত-ধ্যান।
রিক্সাঅলার আঁখি হতে অশ্রুধারা ক্ষরে
সৌধ কিরীটিনী পুরি তাহে স্নান করে। ।
হঠাৎ ময়দানব তার সামনে উপস্থিত।
পণ্ডিত, চলো। ইন্দ্র ডাকে তোমায়। ময়দানবের হঠাৎ আবির্ভাবে কালিদাসের লুঙ্গি ঢিলা হয়ে গেছিল। ভাল করে লুঙ্গি পরতে পরতে কালিদাস বিড়বিড়িয়ে বকতে লাগলেন। যাচ্ছি বাপ যাচ্ছি।
নক তো করতে পারিস কখনো! মানুষের প্রাইভেসি বলেও তো একটা কথা আছে।
তারপর ময়দানব হুস করে কালিদাসকে ইন্দ্রের সামনে হাজির করলেন। ইন্দ্র কবিকে সব বুঝিয়ে বললেন। বললেন, তুমি তো কবি মানুষ। কিভাবে মালটা বানাই বলো দিকিনি।
কালিদাস বললেন, তবে শোনো-
হীরকদশনা তন্বী পক্ক বিম্বাধরা
শ্যামা মধ্যক্ষামা নিম্ননাভি মনোহরা।
চকিত হরিণী প্রায় চঞ্চল নয়না
নিবিড় নিতম্ব ভরে মন্থর গমনা।
স্তনভারে আছে দেহ স্তোক নম্র হয়ে
বিধিআদ্য সৃষ্টি তিনি যুবতী বিষয়ে।
অঙ্গের বলনী তব, শ্যামা লতিকায়
চঞ্চল অপাঙ্গ ভঙ্গী কুরঙ্গী দেখায়।
কপোলের প্রভা শশী কিরণে প্রকাশ
কলাপী কলাপে হেরে তব কেশপাশ।
তটিনীর মৃদুতরে তরঙ্গ উচ্ছ্বাস
তাহাতে নিরখে তব ভুরুর বিলাস।
ইন্দ্র মনোযোগ দিয়ে পাঁচ-ছ লাইন শুনলেন, তারপর প্রবলবেগে মাথা নাড়াতে লাগলেন। বুঝি না, বুঝি না। গ্রিক দেবতা পাইসো আমারে? বাংলায় কও। কালিদাস বললেন, হুজুর, এইটাই বাংলা।
ইন্দ্রকে বিভ্রান্ত দেখায়। বাংলা মানে? বাংলা এরম হয় নাকি। ধুত, তুমি আমার কানে কানে চলিত ভাষায় কও।
কালিদাস বললেন। শুনতে শুনতে ইন্দ্রের কান এবং অন্যান্য অঙ্গাদি গরম-লাল হয়ে ওঠে।
তিনি সবজান্তার হাসি হাসেন। কালিদাসের পিঠে থাবড়া মেরে বলেন, তা বদ আছ তুমি কবি, অ্যাঁ? শালা পিম্প কোথাকার! অ্যাই ময়দানব, ব্যাটা মন্ত্রযোগে সবই তো শুনলি, এবার কাজ শুরু করে দে। আমি দেখি কোন অপ্সরা খুঁজে পাই কিনা। কালিদাস শুনে চোখ বড় বড় করে ইন্দ্রের দিকে তাকান। ইন্দ্র ফিচলে হাসি দিয়ে বলেন, আহা, খারাপ ভাব কেন? বাবা ব্রহ্মার ফরমায়েশ।
অন্য কিছু না তো!
দুদিনের মধ্যে ময়দানব হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে কুঁতে কুঁতে এক অপরূপা নারী তৈরি করে ফেলল। শেষ করেই কবির হাতে বাটাল দিয়ে বলল, কবি তুমি এগুলো ধর। আমি চললাম। কালিদাস অবাক হয়ে বললেন, কেন কি হল? ময়দানব কোমরে হাত রেখে বলল, আরে বয়সকালে এত কুঁতাকুঁতি সহ্য হয় নাকি? কি আর হবে, পাইলস হয়ে গেছে। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।
এদিকে ইন্দ্র ও বাকি দেবতারাও তেজ ক্ষয় করে এসে পড়েছেন। কালিদাস বললেন, হে নারী, তিল তিল করে তোমায় গড়া হয়েছে বলে তোমার নাম দিলাম তিলোত্তমা। যাও সুন্দ-উপসুন্দের কাছে। দুই বজ্জাতকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে এস। তিলোত্তমা যো হুকুম বলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তখন দুই ভায়ে চৌরাশি নরককুণ্ডের আগুনে গ্রিলড মাটন খাচ্ছিল। তিলোত্তমা তার 'শ্যামা মধ্যক্ষামা নিম্ননাভি মনোহরা' প্রদর্শন করতে করতে দুই ভায়ের সামনে হাজির হল। দেখে উভয়ের লোলগ্রন্থি সক্রিয় হয়ে উঠল। দুজনেই লাফিয়ে গিয়ে তিলোত্তমার দুই হাত চেপে টানাটানি শুরু করে দিল। তিলোত্তমা কৃত্রিম বিরক্তি দেখিয়ে বলল, আরে আরে করে কি করে কি! থাম থাম।
আমি তো দুজনের বউ হতে পারব না। এক কাজ কর, কাল অমরাবতী স্টেডিয়ামে দুজনে কুস্তি কর। যে জিতবে, আমি তারই বগলে দাবা খেলব, অর্থাৎ বগলদাবা হব। এই বলে তিলোত্তমা 'নিবিড় নিতম্ব ভরে মন্থর গমনা' উক্তির সার্থকতা বজায় রাখতে রাখতে চলে গেল। সেদিকে চেয়ে নরকের সকল বাসিন্দাসহ সুন্দ উপসুন্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পরের দিন। স্থান অমরাবতী স্টেডিয়াম। সুন্দ উপসুন্দ গায়ে তেল মেখে, হাট থেকে কেনা সদ্য পাটভাঙা লুঙ্গি পরে উপস্থিত। তিলোত্তমা তার সখি অপ্সরাদের আর চাকর গেলমানদের নিয়ে বসেছে গ্যালারিতে। ক্যামেরা তার মুখের ওপর ধরা হল, তিলোত্তমা দুই জনকে দুই হাতে ফ্লাইং কিস দিল।
ব্যাস, দুই ভাইই রণোম্মুখ। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। সে কি নৃশংস যুদ্ধ! সুন্দ উপসুন্দের চুল টানে তো উপসুন্দ সুন্দের কাছা খুলে দেয়। ধারাভাষ্যকার হিসেবে নারদ মুনি চৌধুরী সাহেবের মত জ্বালাময়ী কমেন্ট করা শুরু করল, হিয়ার টুডে, হোঅট আ নিপল-বাইটিং ম্যাচ উই হ্যাভ! ক্ষণে ক্ষণে এদের মারামারি দেখে পুরো গ্যালারি শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। গোটা আড়াই মহাকাল পর, বিধ্বস্ত-মৃতপ্রায় হয়ে দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে।
পড়েই ব্রহ্মাকে গালাগালি। সেই গালির তেজে ব্রহ্মা একটু খোঁড়াতে খোঁড়াতে দেখা দিলেন। বেদব্যাস আবার তার কথা রেখেছিল কিনা!
বলো, বৎসগণ, এত গালাগাল দিচ্চ কেন? দুই ভাই তো খেপেই লাল। ব্যাটা মিথ্যুক, বলেছিলি আমরা অমর; তা এখন মরছি কেন?
ব্রহ্মা খুক খুক করে হাসলেন। বোকার দল, আমি বলেছিলাম 'অন্য' কেউ তোমাদের মারতে পারবে না।
কিন্তু এটা তো বলিনি তোমরা একে অপরকে মারতে পারবে না! এখন লাও ঠ্যালা।
এই শুনে শক খেয়ে সুন্দ উপসুন্দ ধুপ করে মরে গেল।
আমাদের দেশে যে সুন্দ উপসুন্দের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, কেন যেন মনে হচ্ছে শেষটা পৌরাণিক কাহিনীর মতই হবে। সৃষ্টিকর্তা দেশটাকে রক্ষা করুন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।