কোথায় আজ হারালে তুমি, আগে তোমায় কেন বুঝিনি আমি !
আজই শেষ দিন- পলক মনে মনে বলল। একঘেয়ে পরিশ্রম আর কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে ঘামঝরা খাটুনির আজই ইতি। সন্ধেয় ছাদে উঠবে সবাই । আজ চাঁদ দেখা গেলেই কাল ঈদ। ফ্যাক্টরি গতকালই তাদের বোনাস দিয়ে দিয়েছে।
গত রাতেই বৌয়ের জন্য একটা লাল শাড়ি কিনেছে পলক। কখন সন্ধে হবে, চাঁদ উঠবে, কখন বৌয়ের হাতে শাড়িটা তুলে দেবে- এই কল্পনায় বিভোর হয়ে আছে সে। বৌয়ের তৃপ্তিমাখা হাসিমুখ ঈদের চাঁদের চেয়েও যে দামী !
কাজে আজ মন বসছে না পলকের। অতীতে কথা রোমন্থন করছে কেবল। মনে পড়ছে তার গ্রাম সেনহাটির কথা, যেদিন ও প্রথম দেখে জান্নাতকে।
ভাললাগা কখন ভালবাসা হয়ে গেছে টেরই পায়নি ওরা। গ্রামের মানুষও ছি ছি করতে দেরি করেনি।
‘ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে তুই মুসলিম মেয়ে বিয়ে করতে চাস? এর চেয়ে তোর মৃত্যুর খবর শোনাও ভাল ছিল!’ পলকের বাবা-কাকার এক কথা।
এ সবই এখন অতীত... মনে মনে হাসল পলক। জান্নাতের জন্য কি না করেছে সে।
! ব্রাহ্মণ সমাজের সালিসে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয় তাকে। হন্যে হয়ে ঘুরছিল ভাগ্যের অন্বেষণে । অবশেষে ভাগ্যগুণে সাভারের এই ফ্যাক্টরিতে নির্মাণশ্রমিকের কাজ পেয়ে গেল। ধর্মান্তরিত হল । হাতে কিছু টাকা জমিয়ে ফিরে গেল সেনহাটিতে।
রাতের আঁধারে জান্নাতে নিয়ে গ্রামছাড়া হল। বিয়ে করল।
সেই ফ্যাক্টরির কাছেই ছোট বাসা নিল তারা। দুজনের ছোট্ট সংসার। প্রাচুর্য নেই তো কি হয়েছে, সুখ তো আছে !
**
এখন ভরদুপুর।
মাথা কেমন করছে পলকের। আজ গরমও পড়েছে ভীষণ। নির্মানাধীন ভবনের চারতলায় ঢালাইয়ের কাজ চলছে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ছাদের কিনারে এসে পড়েছে পলক, খেয়ালই করেনি। কাদাপানি মাখা পিচ্ছিল মেঝেতে পা হড়কে গেল তার।
তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। শক্ত কংক্রীটে মাথা ঠুকে গেল তার। জ্ঞান হারাবার আগে জান্নাতের মুখটাই কেবল ভেসে উঠল মনের পর্দায়।
**
মাগরিবের নামাজ পড়েই জান্নাত পাড়ার ছেলেদের হৈ চৈ শুনতে পেল। কাল ঈদ।
কিন্তু তার স্বামী ঘরে ফিরছে না কেন? অজানা আশংকায় বুক কাঁপে তার। রাত গভীর হয়, পলক ঘরে ফেরে না। কি করবে ভেবে পায় না জান্নাত। কোন ফ্যক্টরীতে কাজ করে পলক? নিরক্ষর জান্নাতের তা জানা নেই !
**
সহকর্মীরা ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায় পলককে। বড় ডাক্তার ঈদের ছুটিতে আছেন।
ICU খালি নেই। তাই ইমার্জেন্সি রোগীর ঠাঁই হয় হাসপাতালের মেঝেতে।
রাত ঠিক কয়টায় মারা গেল পলক, কেউ জানল না।
**
ফ্যাক্টরির লিস্ট ঘেঁটে দেখা গেল পলকের ঠিকানা লেখা সেনহাটি। সেই গ্রামেই নিয়ে যাওয়া হল তাকে।
ব্রাহ্মণবাড়িতে তার লাশ দেখে কেউ কাঁদল না। বরং কেউ কেউ বলল, ভগবান পাপের শাস্তি দিয়েছেন।
পলকের সহকর্মীরা লাশ দাফনের ব্যবস্থা নিতেই ঘটল বিপত্তি । সমাজ বলল, ‘এ যে হিন্দুর লাশ ! একে কবর দেয়া যাবে না !’
আজ ঈদ। চিতায় পুড়ছে পলক।
বাস্তবতার রূঢ় কশাঘাতে হার মেনেছে মানবতা। সেই সাথে পরাজিত ভালবাসা।
জান্নাতকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো আজও সে প্রিয়তম স্বামীর অপেক্ষায়...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।