১
কচুপাতা রঙের শাড়ীটা হাতে নিয়ে আবার ড্রয়ারে রেখে দিলাম । এটা পরলে নাকি আমাকে ভাল দেখায় , কিন্তু গাধাটা বলবে কি ? বহুদিন পর সাহস করে দেখা করবে বলছে । কিন্তু এত দিনে যেটা পারল না সেটা আজকে পারবে ? কাপুরুষ একটা । যখন শম্পা প্রথম বুঝতে পারল , ও আসলেই আমাকে একটা খোঁচা দিত । আমি বুঝেও না বুঝার ভাব নিতাম ।
বেচারা হঠাৎ করে আমার দিকে চাতক পাখির মত তাকাত , তখন ওর সাথে চোখচোখি করে লজ্জায় ফেলতাম । শম্পা একবার আমাকে ধরে জেরা শুরু করছিল ' কিরে সুমন আর তর মধ্যে কিছু চলছে নাকি রে ? ওর চোখ দেখলেই বলে দেওয়া যায় , বেটা স্বপ্ন দেখতেছে । ওর কল্পনার রানী কি তুই ? ' ' তখন হয়ত হেসে উড়িয়ে দিয়েছি , নিজের বেশী দাম দেখাতে গিয়ে হোক আর ওর পেট পাতলা বলে চেপে গেছি হয়তোবা -আসলে আমিও দুর্বল ছিলাম । ও যখন গভীর দৃষ্টিতে তাকাত , আর কথা বলার মাঝে খেই হারিয়ে ফেলত , তখন চাইতাম ওর হাত ধরে সূর্যাস্ত দেখতে । ফোনে কথা বলার সময় কি এমনিতে হাজারবার আকার ইঙ্গিতে বলেছি " ভালবাসি " - কিন্তু ও না বুঝার ভান করে অন্য দিকে চলে গেছে ।
কখনই জানতে পারি নি কেন এই দ্বৈতসত্তা ওর মধ্যে । আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য অদ্ভুত সব ছন্দহীন কবিতা লেখত , বন্ধুদের প্রশংসার পরও আমার দিকে তাকাত কিছু শোনার জন্য । কিন্তু আসল যায়গায় , বহুবার একসাথে দুজনে ছিলাম , এই ভালবাসার কথা উঠতেই দিত না । শেষে মরিয়া হয়ে ওইদিন আড্ডা দেওয়ার সময় জোরেই বললাম , " আম্মা বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে । " সাথে সাথে সেই বোকা হাসিটা দিল , আর আলটিমেটামটা দিয়ে অপমান হলাম আমি ।
আজকে আবার নিজেই ফোন করে ডাকল , এরকম ত কখনো আগে করেনি ও ? আবার ভিতরটা ধক করে উঠল । কি করবে হয়ত নিজেও জানে না । যে একটা কথার জন্য দুজন গত দুই বছর থেকে অপেক্ষা করে আছি , দুজনে দৃষ্টিতে সায় দিয়েছি অসংখ্য বার ,পারবে কি ও ?
২.
পুকুর পাড়ে এসে দেখলাম আগেই বসে আছে । ওকে অনেক নার্ভাস মনে হল । একটা খ্যাত টাইপের
নীল রঙের শার্ট পরে আসছে ।
নিচের দিকে তাকিয়ে কি যে আকাশ পাতাল ভাবছে । কাছে গিয়ে ধ্যান ভাঙ্গিয়ে বললাম " গোটা দুনিয়া থাকতে এখানে কেন ? কি এত দরকার ? "
খামাখা ভাবটা নিয়ে ঠিক করলাম না । বেচারার অবস্থা শুরুতেই কেরোসিন হয়ে গেছে । খালি বলল ," বস । "এরপর আবোল তাবোল কথা বলে দুজন বিশ মিনিট কাটিয়ে দিলাম ।
যখন দুইজনে প্রসঙ্গ না পেইয়ে চুপ হয়ে গেলাম , টের পেলাম , এতক্ষণ এই মুহুর্তর জন্য দুইজনই অপেক্ষা করে ছিলাম ।
" জানি না কিভাবে বলব । হয়ত অনেক আগেই বলা উচিত ছিল । যখন নীরস পলাশীর দেওয়াল থেকে বের হয়ে কার্জন হলের সামনে মুক্ত বাতাসের স্বাদ নেওয়ার জন্য চলে আসতাম , এরকম পড়ন্ত বিকালে তোমার সাথে দেখা হয়েছিল । সোহেলেদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম , আর তুমি বাড়ি যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করে উঠে চলে গেলে ।
প্রথম দেখাতেই হয়ত প্রেম না হোলেও , দিন দিন তোমাকে কিভাবে ভালবেসেছিলাম , নিজেও জানি না । এরপর তোমাকে নিয়ে অনেক কিছুই জিজ্ঞেসা করতাম , ওদেরও টের পেতে বেশী দিন লাগল না । তোমাকে দেখার জন্য ওদের কাছে চলে আসতাম । বুঝতাম তুমিও টের পাচ্ছো আমার ছলনা । ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হোক আর যেভাবেই হোক , তোমাদের ক্যাম্পাসে হানা দিতাম ।
সোহেলের উপর কড়া নির্দেশ ছিল তোমাকে আর আমাকে একসাথে রেখে বাকি সবগুলকে নিয়ে অন্য দিকে যেতে হবে । কিন্ত তোমার সামনে আসলেই সব কথা বন্ধ হয়ে যেত । তুমি খুচিয়ে দু একটা কথা অন্তত আমার কাছ থেকে বের করতে ; আমি তাও বলতে পারতাম না , কি বলতে কি ভাব - এটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সময়গুলো কাটিয়ে দিতাম । মন থেকে চিৎকার করে অনেক কিছুই বলতাম , কল্পনায় অনেক দূর চলে যেতাম , কিন্তু বাস্তবে পারতাম না । শুধু তোমার সাথে হাঁটার সময় মনে হত , যদি একবার ঘড়ির কাটাগুলোকে্ আটকে দিতে পারতাম ।
আমি বুঝতাম তুমিও আমাকে পছন্দ কর । পরে আমি তোমার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম । আমার হেয়ালিপনার ভাষা হয়ত তুমি কখনই বুঝতে পারনি । কিন্তু আজ তোমাকে সব বলব ।
ক্লাস ফাইভে থাকতে আমি মাঠে খেলতে খেলতে হঠাৎ করে পড়ে যাই ।
বুকে প্রচন্ড ব্যাথার চোটে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যায় । পরে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি । বাবা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন । চোখেমুখে পরাজয়ের ভাব । বাবাকে অনেক শক্ত বলে জানতাম , কিন্তু তখন দেখি বাবার চোখে পানি ।
পরে ডাক্তারের কাছ থেকে জানলাম , আমার হার্টে একটা ছোট ফুটা আছে । জন্ম থেকেই , কিন্তু আগে জানলে সারানো যেত হয়ত , কিন্তু এখন ঠিক করা হয়ত শম্ভব হবে না । এরপর দেশে , দেশের বাহিরে তিনবার অপারেশন হয়েছে আমার কোন লাভ হয়নি । বাড়িতে তখন বাবা-মার মুখটা দেখলে দুমড়ে-মুচড়ে যেত । তারা নিজেদের দোষী ভাবতেন , সবাই আমার দিকে অনুগ্রহের দৃষ্টিতে তাকাত ।
তখন সিদ্ধান্ত নিলাম , যাই হোক না কেন , জীবনে আর দশজনের মতই বাঁচবো । ভিতরের অবস্থাটা কাউকেই বুঝতে দেই নি, হাসি-খুশি মুখে জীবনকে নিজের মত সাজিয়েছি , এর মাঝে হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়ার মত এলে তুমি । এর আগে কখনই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব চুকাতে যাই নি , কিছু না পেলেও কষ্ট লাগত না । বিশ্বাস করো , জীবনে শুধু চেয়েছি শুধু তোমাকেই । ভুলে গিয়েছিলাম আমি কে , যে কঠিন সত্য মেনে নিয়ে ছোট থেকে বড় হয়েছি তাকে পাত্তা না দিয়ে তোমার পিছে ছুটছিলাম ।
আবার বাঁচার জন্য একটা বিশাল ইচ্ছা চেপে বসছিল বুকে । কিন্তু এত গল্প-উপন্যাস না যে বেঁচে উঠব নায়কের মত । আবার আগের বাস্তবতা মেনে নিয়ে সরে এসেছিলাম । তোমার ব্যাকুলতা আমি টের পেয়েছি । চেয়েছি যা ছিল সব নষ্ট করে দিতে , পারি নি ।
দুরে চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসেছি । আমি হয়তো আর পাঁচ বছর বাঁচবো । বাবা এই মাসে আবার আমাকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাচ্ছেন । ডাক্তার,আমি সবাই জানি আর কোন লাভ নেই , তারপরও , বাবার মনতো । শুধু চাই ভালো থেকো , এই অধমকে ভুলে যেও ।
যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও , অন্তত এই জীবনের জন্য । "
এইটুকু বলে থামল ও । আমার মাথা ঘুরছে , ওর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলাম না । শুধু চোখ দিয়ে অবিশ্রান্তভাবে পানি পড়ছিল । ইছা করছিল , কেউ এসে যেন এই নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে যাক ।
ওর ভালবাসার কাছে আজ সত্যি পরাজিত আমি , কখনও ওর মত সাহস হবে কি আমার ?
মাগরিবের আজান শুনে চারিদিকে তাকালাম । টলটলে পানিতে এখন শুধুই আমার ছায়া ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।