কুয়াশার মত জীবন আমার... এই আছি তো এই নাই !! আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে অনেকগুলো উৎসুক চোখ পিয়ারপুর গ্রামের সদর রাস্ত্মায় ঘুরে ফিরে বেড়িয়েছিলো। তাদের আশা ছিলো তারা একজন পরাজিত মানুষের মুখ দেখতে পাবে। তারা শুধু সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি ঘোড়ার গাড়ি চলে যেতে দেখেছিলো জেলা বোর্ডের সদর রাস্ত্মা দিয়ে। গ্রামের মানুষগুলো জানা ছিলো গাড়িতে সওয়ারী কে? তবুর তারা গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলো। সুয়ারী কিডা গো...গাড়োয়ান শুধু শপাং করে তার হাতের চাবুকটা কষে মেরেছিলো ঘোড়ার পিঠে আর ঘোড়ার গাড়িটার গতি বেড়ে গিয়েছিলো।
রাস্ত্মার পাড়ে উবু হয়ে বসে থাকা লোকগুলো পিঠের উপর দিয়ে লালচে রঙের ধুলা উড়ে গিয়ে ছিলো বাতাসে। ধুলোর উড়ো উড়ির মধ্যে বসে থাকা লোকগুলোর আবছা চেহারার মধ্যে উত্তর না পাওয়ার কোন খেদ বা বেদনা ছিলো না। কারন তাদের উত্তরটা জানাই ছিলো। আজ নয় বছর পরে একই রাস্ত্মায় হাজারে হাজারে মানুষ হেটে যাচ্ছে ধুলোর কোন চিহ্ন নেই। শ্রাবণ মাসের এই বৃষ্টি এই রদ্রম্নরের খেলায় রাস্ত্মায় ধুলো জমার কোন অবকাশ নেই।
মাঝে মাঝে কাঁদাও জমেছে সে কারনে শববাহী মানুষগুলো তাদের হাঁটার ছন্দ হারিয়ে ফেলছে। পিয়ারপুর গ্রামের চৌধুরী সাহেবের শবযাত্রায় অংশ নেওয়া মানুষের চেহারায় এক ধরনের তৃপ্তির ছাপ। চৌধুরী সাহেবের মৃত্যুতে তারা ব্যাথিত হলেও এই ভেবে তারা তৃপ্ত যে নয় বছর আগে একজন পারজিত মানুষের চেহারা দেখা থেকে তারা বঞ্চিত হলেও আজ তারা এক সাথে অনেকগুলো পরাজিত মানুষের চেহারা দেখতে পাচ্ছে। পিয়ারপুর গ্রামের মানুষগুলো বুঝতে পারে না তারা বিজয়ি মানুষগুলোর পÿ নেবে না পরাজিত মানুষগুলোর পÿ নেবে। এরকম পরিস্থিতিতে তারা নয় বছর আগেও পড়েছিলো।
নয় বছর আগে যখন চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় বিবাহের খবরটা রটে গেলো তখন তাদের বুঝে উঠতে সময় লেগেছিলো। কারণ চৌধুরী সাহেব ২১ বছর বয়সি এক বনিতাকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছেন ? আশ পাশ চৌদ্দগ্রামে চৌধুরী সাহেবের যে নামডাক সে নামডাকে কি কালিমা লেপন হবে? উত্তরটা গ্রামের লোকদের মুখে যুগিয়ে গিয়েছিলো। চৌধুরী সাহেব যখন করিছে তখন ঠিকই আছে...চৌধুরী সাহেবের বাধা গানে বুদ আশপাশ চৌদ্দগ্রামের মানুষ। গ্রামের মানুষগুলোর কাছে এই সব গানের কথা ঐশিবাণীর মতোই মনে হয়। গ্রামের মানুষগুলোর মনে হয় তাদের এই নিরানন্দ জীবণে চৌধুরী সাহেব আনন্দের আধার।
যখন তাদের হাড়িতে ভাত চড়ে না দুর গ্রামের কাজ করতে গিয়ে রাত্রে চোখে ঘুম আসে না তখন চৌধুরী সাহেবের গান বেদনা নাশক মলমে মতো কাজ করে। চৌধুরী সাহেবের কথাই তারা বিমোহিত। চৌধুরীর সাহেবের মুখের কথাকে কলেমার মতো মনে করে। কখনও কখনও তাদের মনে হয় চৌধুরী সাহেব আসলে মানুষ না। চৌধুরী সাহেব বিয়ে করার তিন দিনের মাথায় চৌধুরী সাহেবের বাড়ির বাধা কামলা হিরম্ন পাগলাকে অঝরে কাঁদতে দেখে পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন হিরম্ন পাগলাকে ঘিরে ধরেছিলো...কিরে চৌধুরী সাহেবের বিয়েতে কেউ কাঁদে না তুই কাঁদিস ক্যা...তখন পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের গায়ে আগুনের ছেকা লাগে এবং তারা দেখে তাদের সামনে জলন্ত্ম আগুন এবং সেই আগুনের মধ্যে পুড়ছে হিরম্ন পাগলার হাতের নিড়ানি।
নিড়ানির কাঠের আছাড়ি পুড়ে ছাই আর লোহার নিড়ানিটা পুড়ে পুড়ে শুধু টকটকে লাল হচ্ছে। টকটকে এই লাল লোহাকে দেখে তাদের টকটকে লাল গোলাপের কথা মনে পড়ে। টকটকে লাল গোলাপের কথা যখন মনে পড়ে তখন তাদের চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। তখন হিরম্ন পাগলার বয়স কতোই বা হবে বড় জোর বারো কি তেরো। হিরম্ন পাগলার মা চৌধুরীর সাহেবের বাড়ির পুরাতন কাজের লোক।
বাপ মরা হিরম্ন সরাদিন চৌধুরী সাহেবের ঘরের বারান্দায় দুই পা মেলে বসে থাকে। দুই বেলা খাই সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফিরে আসে। হাজার কথার কোন উত্তর দেয় নাই। চৌধুরী সাহেব নিয়ম করে হাতল ওয়ালা চেয়ারে হিরম্নর পাশে বসে থাকে হিরম্নকে দেখে হিরম্নর সাথে কথা বলে। হিরম্ন চৌধুরী সাহেবের কথার কোন উত্তর দেয় না।
চৌধুরী সাহেব নিজেই হিরম্নকে প্রশ্ন করে নিজেই তার প্রশ্নের উত্তর দেয়। এভাবেই চলছিলো। এই নিয়মের বত্যয় ঘটে চৌধুরী সাহেব যখন প্রথম বিয়ে করেন তার তিন দিনের মাথায়। চৌধুরী সাহেব যখন নিয়ম মাফিক হিরম্নর সাথে তার কথপোকথন শেষ করে উঠে যান তখন চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী এসে চৌধুরী সাহেবের চেয়ারে বসে শরতের আকাশের দিকে তাকিয়ে হিরম্নকে বলেছিলোগত তিন রাত আমি ঘুমাতে পারিনি...পিয়ারপুরের লোকজনের মনে পড়ে চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর এই কথা শুনে হিরম্নর মনে হয়েছিলো সে এমন উদাসী গলায় কথা বলা কোন নারীকে এর আগে কখনও দেখেছি। হিরম্ন ঘুরে তাকিয়েছিলো চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর মুখের দিকে।
হিরম্ন আশা করেছিলো এই সময় হয়তো এই সুন্দর নারী তার দিকে ঘুরে তাকাবে। কিন্তু চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী তেমনি আকাশের দিকে তাকিয়েই বলেছিলো। আমাকে একটা গোলাপের গাছ যোগাড় করে এনে দিতে পারো...হিরম্ন সাথে সাথে লাফ দিয়ে দালান ঘরের বারান্দা থেকে নেমে গিয়েছিলো। এরপরে সারাদিনে চৌধুরী বাড়ির কেউ হিরম্নকে দেখতে পাই নি। পরদিন ভোরে চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী যখন ঘরের দরজা খুলে বের হন তখন তিনি দেখতে পান হিরম্ন একটি গোলাপের ডাল হাতে দাড়িয়ে আছে।
এর পরে চৌধুরী সাহেবের শোবার ঘর বিভিন্ন ফুলের গাছে ভরে গিয়েছিলো। দিনের বেলায় চৌধুরী সাহেবের ঘরের দরজা খুললে হিরম্ন পাগলা ঘরে ঢুকে ফুলের টবগুলো ছাদে নিয়ে যেতো সারাদিন ছাদে থাকার পরে সন্ধ্যে হলে আবার ঘরে ঢুকিয়ে ফেলতো। চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী যতদিন এই বাড়িতে ছিলো এই নিয়মের বত্যয় কেউ কখনো দেখেনি। চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী যখন একটি টবে গোলাপের ডালটি লাগান তখন বারান্দায় বসে থাকা হিরম্নর সাথে চৌধুরী সাহেবের কথপোকথন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো এবং ঘরের মধ্যে ফুলের টবের পাশে বসে থাকা চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর সাথে চৌধুরী সাহেবের কথপোকথন শুরম্ন হয়েছিলো। চৌধুরী সাহেরব সাথে হিরম্নর কথপোকথন সবাই শুনতে পেলেও চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর সাথে চৌধুরী সাহেবের কি কথপোকথন হয় সে কথা কেউ জানতে পারে না।
চৌধুরী সাহেবের সাথের হিরম্নর কথপোকথনে চৌধুরী সাহেবর নিজেই প্রশ্নকর্তা এবং নিজেউ উত্তর দাতা কিন্তু চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর সাথে চৌধুরী সাহেবের কথপোকথনের পদ্ধতিটা কেউ জানতে পারে না। এ সময় পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন দেখে হিরম্ন পাগলা আর চৌধুরী সাহেবের ঘরের বারান্দায় দুই পা মেলে বসে থাকে না। সারাদিন বিভিন্ন গ্রামের ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন ফুল গাছের সন্ধানে। এদিকে ফুলগাছে ভরে যায় চৌধুরী বাড়ির ছাদ। শোবার ঘর উঠোন।
এ সময়ে হিরম্ন পাগলার গাছের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলার অভ্যাস গড়ে ওঠে। গাছের সাথে হিরম্নর কি কথপোকথন হয় শত চেষ্টায় পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন জানতে পারে না। চৌধুরী পরিবারের অন্যান্য কাজের লোকজনের মাধ্যমে পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন জনেছিলো যখন গোলাপ গাছে টকটকে লাল গোলাপ ফুটতো তখন চৌধুরী সাহেব ঘর থেকে বের হতেন না। চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে লাল তাতের শাড়ি পরে প্রজাপতির মতো সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন। ফুলটা যখন ঝরে যেতো তখন চৌধুরী সাহেব ঘর থেকে বের হতেন।
সে দিন রাতে চৌধুরী সাহেবের কাচারী ঘরে গানের আসর বসতো। সারারাত ধরে চৌধুরী সাহেবের নতুন বাধা গান হতো। যখনই চৌধুরী বাড়ির ফুলের টবে লাল গোলাপ ফোটার খবর পাওয়া যেতো তখন থেকেই পিয়ারপুর সহ আশপাশ চৌদ্দগ্রামের লোকজন অপেÿা করতো চৌধুরী বাড়ির কাচারী ঘরের গানের আসরের। এ সময়েই চৌধুরী সাহেব পাশের গ্রামে কয়েকবিঘা জমি নিকে সেখানে নিজের হাতে গাছ লাগানো শুরম্ন করেন। আস্ত্মে আস্ত্মেই এখানে গড়ে ওঠে চৌধুরী সাহেবের বাগান বাড়ি।
চৌধুরী সাহেবের ভাব কথায় আর গানে যখন পুরো এলাকা বিমোহিত সে সময়েই চৌধুরী সাহেব ২১ বছর বয়সি বনিতাকে বিয়ে করেন। চৌধুরী সাহেব বিয়ে করার তিনদিনের মাথায় হিরম্ন পাগলা পুড়িয়ে ফেলে তার নিড়ানি। যে রাতে হিরম্ন পাগলা তার নিড়ানী পুড়িয়ে ফেলে সে রাতের ভোরে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্ত্মা দিয়ে সাদা কাপড়ে ঢাকা ঘোড়ার গাড়িতে করে একজন পরাজিত মানুষকে তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে দেখেছিলো। তারা জানতো ঘোড়ার গাড়ির সওয়ারী কে তবুও তারা গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলোসুয়ারী কিডা গো...গাড়োয়ান শুধু শপাং করে তার হাতের চাবুকটা কষে মেরেছিলো ঘোড়ার পিঠে আর ঘোড়ার গাড়িটার গতি বেড়েগিয়েছিলো। রাস্ত্মার পাড়ে উবু হয়ে বসে থাকা লোকগুলোর পিঠের উপর দিয়ে লালচে রঙের ধুলো উড়ে গিয়ে ছিলো বাতাসে।
আজ যখন চৌধুরী সাহেবের মরদেহ তার বাগান বাড়িতে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন পিছনের অনেক কিছুই তাদের সামনে চলে আসে। গত তিনদিন চৌধুরী সাহেবের মরদেহ পড়েছিলো চৌধুরী বাড়ির বড় দালানের বারান্দায়। চৌধুরী পরিবার সিদ্ধান্ত্ম নিতে পারছিলো না চৌধুরী সাহেবের দাফন কোথায় করা হবে। চৌধুরী সাহেবের লাশ কাধে নিয়ে হাটতে হাটতে পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের মনে পড়ে চৌধুরী সাহেব মরার পরে চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে বিলাপ করেছিলো...আমার মরার পরে আমার লাশ নিয়ে টানাটানি হবে..তুমি আমার লাশ নিয়ে টানাটানি করতে দিয়ো না...তুমি আমার লাশ আমার বাগান বাড়িতে দাফন করো..আমি আমার গাছের সাথে থাকবো..আমি আমার মাটির সাথে থাকবো...তখন পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের মনে হয়েছিলো এই খেলা নয় বছর আগেই শুরম্ন হয়েছিলো। চৌধুরী সাহেব তার মা তিন বোন দুই ভাই প্রথম স্ত্রীর তিন মেয়ে এবং এক ছেলের বাধাকে উপেÿা করে বাগান বাড়িতে বসবাস করা শুরম্ন করেছিলো; এবং চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী সাদা কাপড়ে ঢাকা ঘোড়ার গাড়িতে করে ডিস্টিক্ট বোর্ডের রাস্ত্মা দিয়ে চলে গিয়েছিলো; এবং ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান তাদের কথার উত্তর না দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরেছিলো।
পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন বুঝে উঠতে পারে না চৌধুরী সাহেব এ রকম এক বনিতাকে কেন বিয়ে করেছিলো। তখন তাদের মুখেই এর উত্তর যোগায়চৌধুরী সাহেব যখন করিছে তখন ঠিকই করিছে...চৌধুরী সাহেব যখন বাগান বাড়িতে বসবাস করা শুরম্ন করে তখন চৌধুরী সাহেবের বাগান বাড়িতে রাত্রে মদের আসর বসার কথা পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন শুনরে পায়। এ সময়েই পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন দেখে পিয়ারপুর বাজারের কয়েকজন ব্যাবসায়ী কেমন করে চৌধুরী সাহেবের কাছের মানুষ হয়ে যায়। চৌধুরী সাহেবের গান ক্যাসেটে রেকর্ড হয়। চৌধুরী সাহেবের গান ব্যাবসা করে।
চৌধুরী সাহেবের কথা রেকর্ড হয়। চৌধুরী সাহেবের কথা বিক্রি হয়। পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন একজোড়া ইলিশ মাছের সাথে চৌধুরী সাহেবের একটা ক্যাসেট কিনে হাট থেকে বাড়ি ফেরে। এ সময়ে পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন হিরম্নকে পুরোপুরি পাগল হয়ে যেতে দেখে। তারা দেখে হিরম্ন চৌধুরী সাহেবের বাগান বাড়ির একটি বড় গাছের ডালে উঠে বসে থাকে।
শতজন শত চেষ্টাও হিরম্নকে গাছ থেকে নামাতে পারে না। পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন যখন হিরম্নকে গাছ থেকে নেমে আসতে বলে তখন তারা হিরম্নর চিৎকার শোনে এবং তারা আশ্চর্য হয়। হিরম্ন গাছেত্তে নাইমে আই...তখন হিরম্ন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে...মওলা তুমি কাঁদো ক্যা...মওলা..ও মওলা..তুমি কাঁদো ক্যা..বলতে বলতে হিরম্ন মোটাসোটা গাছের ডাল জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদতে থাকে। এ সময়ই লোকজন জানতে পারে চৌধুরী সাহেব জোস্না রাতে নিজের হাতে লাগানো গাছগাছালির মধ্যে একা একা হাটেন। চৌধুরী সাহেব গাছ জড়িয়ে ধরেন।
গাছেকে আদর করেন। গাছের সাথে কথা বলেন। গাছের সাথে কথা বলা দেখে হিরম্ন পাগলা ডুকরে কেঁদে ওঠে। চৌধুরী সাহেবের সাথে চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর কি কথপোকথন হয় সেটা পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের জানা না থাকলেও দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে চৌধুরী সাহেবের কি কথপোকথন হয় সেটা পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের ঠিকই জানা হয়ে যায়। চৌধুরী সাহেবের বাগান বাড়ির মদের আড্ডায় কে কি কথা বলেছে চৌধুরী সাহেব তার উত্তরে কি বলেছেন এ কথায় ঘোরে পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের মুখ থেকে মুখে।
সে কারনেই চৌধুরী সাহেবের দাফনের ইচ্ছার কথা চৌধুরী পরিবরের মানুষদের জানা না থাকলেও পিয়ারপুর বাজারের কয়েকজন ব্যাবসায়ী এবং চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঠিকই যানা থাকে। তখন চৌধুরী পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ইচ্ছার সাথে চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর কথিত চৌধুরী সাহেবের শেষ ইচ্ছার দ্বন্দ শুরম্ন হয়। তখন পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের মনে হয় এই দ্বন্দ আসলে নয় বছর আগেই শরম্ন হয়েছে। যেদিন চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রী সাদা কাপড়ে মোড়া ঘোড়ার গাড়িতে করে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্ত্মা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। গ্রামের মানুষগুলোর জানা ছিলো গাড়িতে সওয়ারী কে? তবুর তারা গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলো।
সুয়ারী কিডা গো...গাড়োয়ান শুধু শপাং করে তার হাতের চাবুকটা কষে মেরেছিলো ঘোড়ার পিঠে আর ঘোড়ার গাড়িটার গতি বেড়েগিয়েছিলো। রাস্ত্মার পাড়ে উবু হয়ে বসে থাকা লোকগুলো পিঠের উপর দিয়ে লালচে রঙের ধুলা উড়ে গিয়েছিলো বাতাসে। পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের মনে হয়েছিলো চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে বিজয়ের বেশে তার বাগান বাড়িতে উঠেছিলো। এবং চৌধুরী সাহেবের জিবদ্দশায় চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে এই প্রতিযোগীতা জিইয়ে ছিলো। সে কারনেই হয়তো চৌধুরী সাহেবের বাগান বাড়িতে মদের আড্ডা বসতো এবং চৌধুরী সাহেব এই আড্ডায় বুধ হয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু তারা বুঝতে পারে না হিরম্ন কেন গাছ থেকে নামে না। তারা বুঝতে পারে না হিরম্ন ক্যানো চিৎকার করেমওলা কাঁদো ক্যা...পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন যখন চৌধুরী সাহেবের মরদেহ কাধে করে বাগান বাড়ির দিকে যাচ্ছে দাফনের জন্য তখন তাদের চোখে মুখে এক ধরনে তিপ্তির ঝলক দেখা দেয়। তারা আজ থেকে নয় বছর আগে একজন পরাজিত মানুষের মুখ দেখতে পারে নি। কিন্তু আজ তারা অনেকগুলো পরাজিত মানুষের মুখ দেখতে পাচ্ছে। যে মানুষগুলো চৌধুরী সাহেবের শেষ ইচ্ছার বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো।
আরেকবার তারা দেখছে বিজয়ীর বেশে চৌধুরী সাহেবের লাশ দাফন করতে যাচ্ছে চৌধুরী সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। চৌধুরী সাহেবের লাশ যখন দাফন হয়ে যায়। চৌধুরী সাহেবের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যখন এই পরাজয়ের গস্নানিতে মুখ লুকাচ্ছে। তখন পিয়ারপুর গ্রামের মানুষগুলো বুঝতে পারে না তারা আসলে কোন পÿ নেবে বিজয়ির দিকে যাবে না পরাজিতদের দিকে যাবে। সে সময় তারা ছুটে যায় চৌধুরী সাহেবের বাগান বাড়িতে চৌধুরী সাহেবের কবরের কাছে।
পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন যখন চৌধুরী সাহেবের কবরের কাছে যায় তখন তারা হিরম্ন পাগলাকে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে দেখতে পায়। তখন তারা পরম মমতায় হিরম্ন পাগলার পাশে গিয়ে বসে। পিয়ারপুর গ্রামের লোকজন যখন হিরম্ন পাগলার পাশে গিয়ে বসে তখন তারা দেখে হিরম্ন পাগলা চৌধুরী সাহেবের মতো কথা বলছে। হিরম্ন পাগলা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে। হিরম্ন পাগলা নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
গাছের সাথে তোমার এই প্রেম কতদিনের...জন্ম জন্মান্ত্মরের...তুমি কি জন্মান্ত্মরে বিশ্বাস করো...আমার মতো করে বিশ্বাস করি...কি রকম...আমি মরে গেলে কি হবে...আমাকে মাটি দেওয়া হবে..আমার এই দেহ তো মাটির সাথে মিশে যাবে..তারপরে কি হবে...আমি মাটির একটা উপদানে পরিণত হবে..তারপরে কি হবে..গাছগুলো সেই উপদান চুষে নেবে...বাহ! আচ্ছা এই গাছটার মধ্যে কোন মানুষ মিশে আছে...আমি আমার মতো করে সেই মানুষ চিন্ত্মা করে নেই...কেমন...এই গাছটার সাথে আজ থেকে তিনশ বছরের আগের একজন মানুষ মিশে..আমি যখন এই গাছটার পাশে বসি তখন মনে হয়..তিনশ বছর আগের কোন মানুষের বসে আছি...এ সময় পিয়ারপুর গ্রামের লোকজনের মনে হয় তারা হিরম্নর কথপোকথন শুনছে না তারা চৌধুরী সাহেবের সাথে চৌধুরী সাহেবের প্রথম স্ত্রীর কথপোকথন শুনছে। তাদের মনে হয় সে যে সময় চৌধুরী সাহেব চৌধুরী সহেবের প্রথম স্ত্রীর সাথে কথপোকথন শুরম্ন করেন সে সময় তিনি মানুষ..জীবণ..ধর্ম..বিশ্বাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরম্ন করেছিলেন। সে সময়ই তার মধ্যে বৃÿ প্রীতির জন্ম হয়েছিলো। তাদের মনে হয় চৌধুরী সাহেব তার জীবণের শেষ দিন পর্যন্ত্ম তার প্রথম স্ত্রীর অভাব অনুভব করেছেন। এ বিষয়টা তারা বুঝতে না পারেলেও হিরম্ন বুঝেছিলো।
তাদের যখন মনে পড়ে একটি বড়ো গাছের ডাল জাপটে ধরে হিরম্ন চিৎকার করছে...মওলা তুমি কাঁদো ক্যা...তখন তাদের মনে হয় আজ থেকে নয় বছর আগে সাদা কাপড়ে ঢাকা ঘোড়ার গাড়িতে ডিস্টিক্ট বোর্ডের রাস্ত্মা ধরে যে মানুষটি চলে গিয়েছিলো সে মানুষটিকে সেদিন পরাজিত মনে হলেও এখন তাদের মনে হয় সেই মানুষটি আসলে পরাজিত ছিলো না। ঠিক তখনই তাদের মনে হয় তারা গত নয় বছরে চৌধুরী সাহেবের নতুন কোন গান শোনেনি।
লেখক - রফিকুল ইসলাম পল্টু ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।