আওদ শব্দ থেকে ঈদের উৎপত্তি। ঈদ অর্থ আনন্দ, খুশি, ফুর্তি, আমোদ, উৎসব ইত্যাদি। ফিতর অর্থ রোজা ভঙ্গ করা, স্বভাবজাত বা স্বাভাবিক। ঈদুল ফিতর অর্থ কঠোর সিয়াম সাধনার মুদ্দৎ উতরিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবার খুশি।
ঈদুল ফিতরের দিন গরিব-মিসকিন ও অভাবী লোকদের মধ্যে শরিয়তের নির্ধারিত যে অর্থ বা খাদ্যবস্তু বিতরণ করা হয় তাকে বলে সদাকাতুল ফিতর।
সদাকাতুল ফিতর আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর ওয়াজিব। সদাকাতুল ফিতরকে রোজার কাফফা বলা হয়। পক্ষান্তরে ঈদের দিনে অভাবী ব্যক্তিরাও যাতে অনাহারে থাকার কারণে ঈদের খুশি থেকে একেবারে বঞ্চিত না হয় তার জন্যই এ ব্যবস্থা।
ঈদ মুসলিম জাতির একটি বার্ষিক সম্মেলন ও উৎসবের দিন। বিশ্বের প্রত্যেকটি জাতিরই আনন্দ-উৎসবের জন্য বছরে কিছু দিনক্ষণ নির্ধারিত থাকে।
তেমনি মুসলমানদের আনন্দোৎসবের জন্য বছরে দু’টি দিন নির্ধারিত রয়েছে। একটি হলো ঈদুল ফিতর ও আরেকটি ঈদুল আজহার দিন। রমজানের সিয়াম সাধনার পরে যে ঈদ তার নাম ঈদুল ফিতর। আর জিলহজ মাসে হজ উপলক্ষে যে ঈদউৎসব পালন করা হয় তাকে বলে ঈদুল আজহা।
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব : এ ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব।
যারা ঈদের নামাজ আদায় করে না তারা অবশ্যই গুনাহগার হবে।
ঈদ আসে বিশ্ব মুসলিমের দ্বারপ্রান্তে বার্ষিক আনন্দের মহাবার্তা নিয়ে, আসে সীমাহীন প্রেম-প্রীতি বিলাবার সুযোগ নিয়ে, বিগত দিনের সকল ব্যথা বেদনা ভুলিয়ে দিতে, কল্যাণ ও শান্তির সওগাত নিয়ে।
বছরে দু’দিন ঈদের নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য যে মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ইসলামী সমাজ কায়েমের প্রেরণা। সমাজকে কলুষ কালিমা মুক্ত করার জজবা, মানবতা ও মনুষ্যত্ব বিকাশের এক বিশেষ অনুশীলন।
ঈদুল ফিতরের ফজিলত : ঈদুল ফিতরের দিনের বহুত ফজিলত রয়েছে।
যারা ঈদের দিন যথারীতি ঈদগাহে গিয়ে যথানিয়মে ঈদের নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহ তাদের দুআ কবুল করেন এবং তাদের অফুরন্ত পুরস্কার দানে ধন্য করেন। হাদিসে এসেছে, যারা ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ঈদের ময়দানে একত্র হয়, আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন যারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে আজ এখানে সমবেত হয়েছে তাদের কী প্রতিদান দেয়া উচিত? ফেরেশতারা বলেন, পুণ্যময় কাজের পুরোপুরি পারিশ্রমিক দেয়াই উচিত। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইজ্জতের শপথ করে বলেন, অবশ্যই তিনি তারে প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা ঈদের নামাজ সমাপনকারী তাঁর নেক বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি এবং তোমাদের কৃত অতীত পাপকে সওয়াবে পরিণত করে দিলাম’ এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নামাজ সমাপনকারীগণ ঈদের মাঠ থেকে এমন অবস্থায় স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলো যেন নিষ্পাপ শিশু। ’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি পুনণ্য লাভের আশায় দু’ ঈদের রাত জেগে ইবাদত করে সেদিন (কিয়ামতের দিন) তার অন্তর এতটুকু ভীত-সন্ত্রস্ত হবে না যেদিন অন্যদের অন্তর ভীত-বিহ্বল অবস্থায় মৃতবৎ হয়ে পড়বে।
’
ঈদুল ফিতর নামাজের সময় : ঈদুল ফিতরের নামাজ সূর্যোদয়ের পর থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে দু’ রাকাত ওয়াজিব নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করতে হয়। গাফেলতির কারণে সময়মত উপস্থিত না হতে পারলে নামাজ ধরা যায় না। এ নামাজে কাজা নেই আবার একাও আদায় করা যায় না। ফলে গাফেল ব্যক্তিকে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
ঈদুল ফিতরের দিনে করণীয় :
প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে প্রাকৃতিক কাজ সেরে মিসওয়াকসহ অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করা। পরে গোসল করা। গায়ে সুগন্ধি ব্যবহার করা। চোখে সুরমা লাগানো। পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা।
এরপর যথাশীঘ্র ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া। সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের ব্যবস্থা করা। ইয়াতিম মিসকিন ও গরিব দুঃখীকে পানাহার করানো। ঈদগাহে যাবার পূর্বে মিষ্টান্ন গ্রহণ করা। ঈদগাহে যাবার পূর্বে সদাকায়ে ফিতর আদায় করা।
ঈদগাহে যে পথে যাবে ফিরে আসার সময় সে পথে না এসে অন্য পথে আসবে। যথাসম্ভব হেঁটে ঈদগাহে যেতে হবে। ঈদের নামাজ মসজিদে নয় ঈদগাহে আদায় করতে হবে। তবে ওজরবশত মসজিদে আদায় করা যাবে। ঈদগাহে যাবার পথে পাঠ করতে হবে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
ঈদে সার্বজনীন আনন্দোৎসব : সে কারণে রাসূলে কারীম (সা.) মহিলাদের ঈদগাহে উপস্তিত করতেন।
উম্মে আতিকা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) দুই ঈদের সময় ময়দানে নাবালিকা, পূর্ণবয়স্কা, সাংসারিক ও হায়েজসম্পন্ন মহিলাদেরকেও উপস্থিত করতেন। তবে হায়েজসম্পন্ন মহিলারা নামাজ থেকে দূরে অবস্থান করতেন। কিন্তু যখন খুতবা দেয়া হতো তখন তারা তাতে শিক্ষা লাভের জন্য পুরোপুরি অংশগ্রহণ করতেন।
একজন মহিলা জিজ্ঞেস করল, মহিলাদের বাইরে যাবার জন্য যে মুখাবরণের (চাদর) প্রয়োজন তা যদি না থাকে, তখন কি করতে হবে হে আল্লাহর রাসূল! জবাবে রাসূল (সা.) বললেন, তার অপর বোন যেন তাকে নিজের মুখাবরণ ধারস্বরূপে দেয় (তিরমিজি)।
হজরত আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) দুই ঈদের নামাজের ময়দানে যাবার জন্য তাঁর কন্যা ও অন্য মহিলাদের আদেশ করতেন (মসনাদে আহমাদ)।
ঈদের নামাজে আজান ও একামত নেই : হজরত ইবনে আক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (সা.) আজান ইকামত ছাড়াই ঈদের নামাজ পড়েছেন। তিনি এ সময় দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন এবং দুই খুতবার মাঝে আসন গ্রহণ করে পার্থক্য সূচিত করতেন।
(মুসনাদে বাজ্জার)।
ঈদের নামাজের খুতবা : জুময়ার নামাজের খুতবা আগে আর ঈদের নামাজের খুতবা পড়ে। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদের ময়দানে গিয়ে সর্বপ্রথম ঈদের নামাজ পড়াতেন, নামাজ পড়ানো শেষ হলে লোকদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। তখন লোকেরা তাদের কাতারেই বসে থাকতেন। এ সময় নবী (সা.) লোকদের ওয়াজ নসিহত করতেন ইসলামের বিধি-বিধান, শরিয়াতের আদেশ-নিষেধ ইত্যাদি শোনাতেন।
যদি কোথাও সৈন্য বাহিনী পাঠাবার প্রয়োজন হতো তাহলে তিনি খুতবার পর সৈন্য বাহিনী গঠন করে একজনের নেতৃত্বে অভিযানে পাঠাতেন। আবার কোনো বিশেষ ব্যাপারে নির্দেশ জারির প্রয়োজন মনে করলে তাও করতেন।
ঈদের দিনে যেসব আনন্দ-ফুর্তি করা জায়েজ আছে : হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু বকর (রা.) আমার কাছে আসলেন। এ সময় আমার কাছে দু’টি আনসার সম্প্রদায়ের মেয়ে গান (কাওয়ালি) গাচ্ছিল।
আনসারগণ বুআস যুদ্ধের সময় এ গানটি গেয়েছিল আয়েশা (রা) বললেন, তারা অবশ্য গায়িকা ছিল না। আর বকর (রা.) বললেন, একি! স্বয়ং রাসূল (সা.) এর ঘরে বাদ্য? আর এটা ছিল ঈদের দিনের ঘটনা, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির জন্য আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা রয়েছে। আর এটা হচ্ছে আমাদের আনন্দোৎসবের দিন। (মুসলিম ১৯৩৮)।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।
আবু বকর (রা.) আইয়্যামে তাশরিফের দিনে আয়েশার (রা.) নিকট গিয়ে দেখেন যে, তাঁর কাছে দু’টি বালিকা গান করছে এবং দফ বাজাচ্ছে। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে আছেন। আবু বকর এটা দেখে বালিকা দু’জনকে খুব শাসালেন বা ধমক দিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) চেহারা থেকে চাদর সরিয়ে বললেন, হে আবু বকর এদের ছেড়ে দাও। এ হলো ঈদের দিন! আয়েশা (রা.) আরো বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখেছি যখন আমি আবিসিনিয়ার যুবকদের ক্রীড়া নৈপুণ্যের দৃশ্য অবলোকন করছিলাম।
তিনি তার চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে দিচ্ছেন, তখন আমি ছিলাম বালিকামাত্র। অতএব তোমরা অল্প বয়স্কা বালিকাদের শখের মূল্যায়ন কর। অল্প বয়স্কা বালিকারা অনেকক্ষণ আনন্দফুর্তিতে মেতে থাকে। (মুসলিম)।
আয়েশা (রা.) বলেন, কিছু আবিসিনীয় লোক মদিনায় পৌঁছে ঈদের দিন মসজিদে নববীতে (অস্ত্র নিয়ে) খেলা করছিল।
নবী (সা.) আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর কাঁধের ওপর মাথা রেখে তাদের খেলা দেখতে লাগলাম। অনেকক্ষণ এ দৃশ্য ভোগ করলাম। অবশেষে নিজেই তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। (মুসলিম ।
হাদিসের আলোকে বোঝা যায় যে, নির্দোষ, খেলাধুলা, অস্ত্র চালনা শিক্ষা এবং যুদ্ধে উৎসাহিত করার মত সঙ্গীত গাওয়া যায়। আল্লাহ ও রাসূলের প্রশংসাসংবলিত গান গাওয়া ও কবিতা পাঠ বরং সওয়াবের কাজ। তবে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে দফ ছাড়া অন্য কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের বিবরণ : ঈদুল ফিতরের দিন যথাসময়ে ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে ইমামের ইমামতিতে ছয় তাকবিরের সাথে দু’রাকাত ঈদুল ফিতরের ওয়াজিব নামাজ আদায় করতে হয়। মুখে নিয়তের বাক্যগুলো উচ্চারণ করা মোটেই জরুরি নয়।
ইমাম নামাজে দাঁড়িয়ে তাকবিরে তাহরিমা বলার সাথে সাথে ইমামের পেছনে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম বলে দাঁড়িয়ে তাকবিরে তাহরিমা (আল্লাহ আকবার) বলে সঙ্গে সঙ্গে হাত বেঁধে সানা পড়তে হয়।
এরপর ইমাম তিন তাকবির বলবেন এবং দু’ তাকবিরে দু’হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে ছেড়ে দেবেন। তিন তাকবিরে হাত নাভীর ওপরে বাঁধতে হবে। মুক্তাদিররা ইমামের অনুসরণ করবেন।
এরপর ইমাম উচ্চৈঃস্বরে সূরাতুল ফাতিহা পাঠ করার পর অন্য একটি সূরা বা সূরার অংশ তিলাওয়াত করবেন।
তারপর অন্য নামাজের মতো রুকু-সিজদা শেষ করে দ্বিতীয় রাকাতের জন্য উঠে দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা পাঠ এবং কিরাত মিলানোর পর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে অতিরিক্ত তিন তাকবির আগর রাকাতের মতোই আদায় করে রুকু-সিজদা করার পর অন্য নামাজের মতোই নামাজ সমাপণ করতে হবে।
মুক্তাদিরা কিরাত না পড়ে ইমামের কিরাত শ্রবণ করবেন। অন্য ব্যাপারে ইমামকে অনুসরণ করতে হবে।
যদিও ঈদ অর্থ আনন্দ বা খুশি।
কিন্তু মুসলিম বিশ্ব আজ যেভাবে বিপর্যস্ত তাতে আগামী ঈদ তাদের কাছে কতটুকু অর্থবহ হয়ে দেখা দেবে তা বলা কঠিন। আর কিছু না করতে পারলেও ঐ বিপন্ন মুসলমানদের জান-মাল ইজ্জত হিফাজতের জন্য আসুন আমরা প্রাণ মহান আল্লাহর দরবারে দুআ করি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।