দোলনা থেকে মানব শিশুর শিক্ষা লাভ শুরু হয়। তার বয়স চার থেকে পাঁচ বৎসর হলে শুরু হয় তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । পারিবারিক ঐতিহ্য , গ্রাম ও শহর ভেদে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভের বয়সের তারতম্য হয়ে থাকে । সম্পন্ন আখ চাষী ঘরের মেয়ে হাসুরা বেগম বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে বিদ্যালয়ে পাঠানো শুরু করে তার মা-বাবা। সাধারণতঃ শহরের তুলনায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা একটু বেশী বয়সে বিদ্যালয়ে যায়।
হাসুরার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এক এক শ্রেণী থেকে বার্ষিক পরীক্ষায উত্তীর্ণ হয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে হাসুরা। সেই সাথে বাড়তে থাকে তার বয়স। তার সমস্ত অবয়বে ফুটে উঠে তার বয়স বৃদ্ধির আলামত। নিজের মেধা গুণ ও সৌন্দর্য নিয়ে সে নিজেই একটা বিপত্তির মধ্যে পড়ে।
উঠতি বয়সী ছেলেরা তার ব্যাপারে একটু বেশী মনোযোগী হয়ে যায়। অনাকাঙ্খিত এই মনোযোগ হাসুরার কাছে বিরক্তিকরই মনে হয়। এক পর্যায়ে সে জহিরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। এই মেলামেশা তার মাতা-পিতা ও গ্রামের মাতব্বরদের দৃষ্টি এড়ায় নাই। গ্রামীণ সমাজে এরূপ মেলামেশা স্বাভাবিক আচরণের পরিপন্থি বলেই গণ্য করা হয়।
সমাজের দৃষ্টিতে এটা গর্হিত হলেও সিনেমা নাটকে তা সমাজ প্রগতির অগ্রযাত্রা বলেই চিত্রায়িত হয়ে আসছে। তাই হাসুরা ও জহির তাদের অভিসারকে জীবনের জয়যাত্রা বলেই মনে করে। এই চেতনা থেকেই তারা সামাজিক বিধি নিষেধ উপেক্ষা করতে কোন দ্বিধা করে না। তাবলে তার মা-বাবা অভিভাবক মন্ডলী ও সমাজের প্রধানেরা হাত গুটিয়ে নিষ্ক্রিীয় হয়ে বসে থাকে নাই। অতএব হাসুরার বিবাহের আয়োজন সম্পন্ন হয়।
সামাজিক পরিবেশে হাসুরার বিবাহ সম্পন্ন হয় রফিকের সাথে। সবাই আশা ও দোয়া করে চিনি কলের আখ কর্মকর্তা রফিকের সাথে হাসুরার দাম্পত্য-জীবন হবে সুখ ও শান্তিপূর্ণ। কথা আছে না মানুষ চায় এক , হয় আর এক। হাসুরার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। সাংসারিক স্বচ্ছলতা এবং স্বামী ও শ্বশুরক’লের আদর সোহাগের কমতি না থাকলেও হাসুরার মনে জহিরের স্মৃতি দোলা দিতে থাকে।
এদিকে বেকার জহির ব্যর্থ মনোরথ হয়ে চলে যায় চট্টগ্রামে বোনের বাসায়। সেখানে একটি কারখানায় চাকুরী নেয়। মোটামুটি স্বচ্ছলতা অর্জন করে ছুটিতে আসে লালপুরে। হাসুরার বৈবাহিক জীবনের এক বৎসর পেরিয়ে গেছে। বিদ্যোৎসাহী স্বামীর অনুপ্রেরণায় সে মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে।
জহিরের আগমনে হাসুরা পুরাতন স্মৃতিময় দিনে ফিরে যায় তার কল্পজগতে। সে ভাবে বীরত্ব দেখাবে। যে কথা সেই কাজ। মহাবিদ্যালয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয় হাসুরা , তারপর জহিরের হাত ধরে চলে যায় চট্টগ্রামে। সেখান থেকে তারা যায় লাঙলকোটে, সেখানে জহিরের মামা থাকে।
মামা-মামী ও বোন-ভগ্নিপতির সহায়তায় বিবাহ করে জহিরকে। হাসুরার অর্ন্তধান সারা লালপুরে ব্যাপক সারা জাগায়। কৌতুহলী মানুষের আলোচনার খোরাক হয়ে যায় এই ঘটনা। লালপুর থানায় ‘সাধারণ ডাইরী অর্ন্তভুক্ত’ করে রফিক। চলতে থাকে হাসুরার সন্ধান।
খবর পৌঁছে যায় জহিরের কানে। পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে সে হাসুরাকে নিয়ে ঘন ঘন অবস্থান বদল করতে থাকে। এরই মধ্যে লালপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় আদালত। বিজ্ঞ মুনসেফ-ম্যাজিষ্ট্রেট মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির কাজে হাত দেন। হাসুরাকে উদ্ধারের জন্য জারি করেন ‘তল্লাশী পরোয়ানা’।
পরোয়ানা জারির জন্য তিনি বিশেষ নজর দেন। লাঙলকোট থেকে হাসুরাকে উদ্ধার করে লালপুরে নিয়ে আসে পুলিশ। হাসুরা অন্তঃসত্ত্বা। রুজু হয় নিয়মিত মামলা।
দন্ডবিধির কুড়ি অনুচ্ছেদে বিবাহ সম্পর্কিত অপরাধ ও শাস্তির বিধান বর্ণিত হয়েছে।
কোন মহিলার স্বামী না হয়েও কোন পুরুষ যদি নিজেকে ঐ মহিলার স্বামী বলে তার আস্থা জন্মায় এবং ঐ মহিলা এই আস্থার কারণে ঐ পুরুষের সাথে দৈহিক মিলনে সম্মতি দেয় তাহলে উক্ত পুরুষের এই আচরণ দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। কোন বিবাহিত মহিলার স্বামীর জীবদ্দশায় তাকে বিবাহ করা উভয়ের ক্ষেত্রে দন্ডনীয় অপরাধ; তবে উক্ত মহিলার স্বামীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক কোন উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন আদালত কর্তৃক ইতিমধ্যে বাতিল ঘোষণা করা হয়ে থাকলে অথবা যদি কোন বিবাহিত মহিলার স্বামী একাদিক্রমে সাত বৎসর নিখোঁজ ও নিরুদ্দেশ থাকে এবং উক্ত স্বামী জীবিত আছে কিনা এ বিষয়ে কোন সন্ধান উক্ত সময়ের মধ্যে না পাওয়া যায় তাহলে উক্ত বিবাহিত মহিলার পরবর্তী বিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে না। কোন অবৈধ বিবাহ অনুষ্ঠানে অসৎভাবে বা প্রতারণামূলক উদ্দেশ্যে যোগদান করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন বিবাহিত মহিলাকে অন্য কোন পুরুষের কাছে অবৈধ দৈহিক মিলনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এই উদ্দেশ্যে কথা উক্ত মহিলার কাছে গোপন রাখা হয়, তাহলে এটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কথা হচ্ছিল হাসুরার মামলা নিয়ে।
তদন্তে প্রমাণিত হলো হাসুরার সাথে রফিকের বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল থাকা অবস্থায় তাকে জহির বিবাহ করেছে। বিজ্ঞ মুনসেফ-ম্যাজিষ্ট্রেট জহির ও হাসুরার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেন। তারা উভয়েই নিজেদেরকে নির্দোষ বলে দাবীপূর্বক বিচার প্রার্থনা করলো। আদালতে দুটি নিকাহনামার জাবেদা নকল দাখিল করলো প্রসিকিউশন পক্ষ। দালিলিক প্রমাণ খন্ডানোর উপায় নাই।
বিজ্ঞ মুনসেফ-ম্যাজিষ্ট্রেট তাদের উভয়কেই দোষী সাব্যস্থ করলেন এবং সাজা দিলেন। হাসুরা জামিনে মুক্ত ছিল। অন্তঃসত্ত্বা নারী বিবেচনায় তার জামিনের প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে সে সন্তান প্রসব করেছে। শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েই সে হাজির হয়েছে আদালতে।
তাকে দন্ডিত করার সময় সার্বিক মানবিক দিক বিবেচনা করে বিজ্ঞ মুনসেফ-ম্যাজিষ্ট্রেট নমনীয় ভ’মিকা গ্রহণ করলেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪২৬(২এ) ধারার প্রতি খেয়াল রেখে তিনি আসামী হাসুরাকে জরিমানাসহ এক বৎসরের কারাদন্ডে দন্তিত করলেন। জহিরকে দেওয়া হলো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, জরিমানাসহ পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড। রায় শুনে কাঠগড়ায় শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো হাসুরা চিৎকার করে দুবার বললো ‘না , স্যার’।
বিজ্ঞ এ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী
আপীল দায়ের সাপেক্ষে সাজাপ্রাপ্ত আসামী হাসুরার জমিনের আবেদন করলে তা মঞ্জুর করলেন বিজ্ঞ মুনসেফ ম্যাজিষ্ট্রেট।
আপীল আদালত উক্ত রায় ও দন্ডাদেশ বহাল রাখলেও হাসুরার ব্যাপারে গ্রহণ করে আরও নমনীয় ভ’মিকা। কারণ হাসুরা একজন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা। সাজা ভোগ শেষে হাসুরা মুক্ত হয়। রফিক তাকে তালাক দিতে অস্বীকার করে। হাসুরা হয় অনুতপ্ত।
রফিকের বিশ্বাস মানুষ ভুল করতে পারে , তাই বলে সে অস্পৃশ্য হয়ে যায় না। তার আত্মপলব্ধি ও অনুতপ্ত হবার সুযোগ আছে। এই আত্মপলব্ধি ও অনুতাপের ফলশ্রুতিতে মানুষ লাভ করে মহত্ব। তাই অনুতপ্ত হাসুরা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে একজন মহিয়সী নারী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এই পরম বিশ্বাস নিয়েই হাসুরাকে ঘরে নিয়ে যায় রফিক।
হাসুরার গর্ভজাত সন্তানকে তার নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিতে রফিক আপত্তি করে নাই। তারপরও ঐ সন্তানের লালন পালনের ভার গ্রহণ করে হাসুরার মা-বাবা। এতো কিছুর পরও উক্ত শিশুর পিতৃ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ জহির তো হাসুরার বৈধ স্বামী ছিলনা।
জহিরকে পূর্ণ মেয়াদে কারাদন্ড ভোগ করতে হয়, সেই সাথে দিতে হয় জরিমানা।
হাসুরার বিষয়ে তাকে পরামর্শ ও প্রশ্রয় দাতাদের অদূরদর্শীতা এবং ভুলের কারণে সৃষ্টি হয় একটি সামাজিক সংকট । যার গ্লানি ঐ নিষ্পাপ শিশুটকে বযে বেড়াতে হবে জীবন ভর , এমন কি জীবনের পরেও স্মৃতির বিস্তার সাপেক্ষে কয়েক পুরুষ ধরে।
লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।