আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুর সঙ্গে হুমায়ূন আহমদের লড়াইয়ের দিনগুলো নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী লেখিকা পূরবী বসুর একটি লেখা(নতুনদেশ পত্রিকা থেকে))

........ (নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমদের মৃত্যুর পর তার মৃত্যু নিয়ে নানাধরনের কথা হয়েছে,অনেক অভিযোগ অনুযোগ উঠেছে। হয়েছে বিতর্কও। মিডিয়াতে নানা ধরনের খবর বেরিয়েছে যার প্রায় সবই নামহীন সোর্স থেকে,বলা চলে ফার্ষ্টহ্যান্ড সোর্স থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই জানার সুযোগ হয়নি পাঠকদের। হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা চলাকালে শেষ সময় পর্যন্ত পাশে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক পূরবী বসু। হুমায়ূনের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, ফাষ্টহ্যান্ড সোর্স।

পূরবী বসু ঢাকার দৈনিক সংবাদের জন্য লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদের শেষ মুহূর্তগুলোর কিছু স্মৃতিকথা। নতুনদেশ ডটকমের পাঠকদের জন্য পূরবী বসুর লেখাটি তুলে ধরা হলো। আমরা নিশ্চিত পূরবী বসুর এই লেখায় হুমায়ূনের মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনেক প্রশ্নের, অনেক বিতর্কের উত্তর খুজেঁ পাওযা যাবে। -বি.স.) আগে তেমন জানাশোনা না থাকলেও আমেরিকায় তার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালে হুমায়ূন ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘটনাচক্রেই আমাদের পরিবারের যথেষ্ট সখ্য গড়ে উঠেছিল, আর এই বন্ধুতার প্রায় সবটাই তার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমার এই ব্যাপারে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা ও তার চিকিৎসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত দুই হাসপাতালের দু`জন সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে আমার যোগাযোগ/ আলোচনার ওপর ভিত্তি করে কিছু কথা লিখছি, কিছু তথ্য পরিবেশন করছি।

হুমায়ূনের ক্যান্সার সার্জারি টিমের প্রধান ডাক্তারকে (ডাক্তার জর্জ মিলার) বারে বারে আমি প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি, হুমায়ূনের পরিবার বা হাসপাতালের পক্ষ থেকে এমন কিছু করার ছিল কিনা যা করা হয়নি, করতে পারিনি, করিনি অথবা সময়মতো করা হয়নি। কিংবা, এমন কিছু করা হয়েছিল কিনা যা করা ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে, অথবা যার জন্যে কোন ক্ষতি হয়েছে? জবাবে ডাক্তার জর্জ মিলার প্রতিবার পরিষ্কার করে জোর দিয়ে বলেছেন, লিখেছেন (এমন কি মাত্র চারদিন আগেও আমার লিখিত প্রশ্নের জবাবে টেক্সট মেসেজ করে জোর দিয়ে বলেছেন, তার জন্যে যা করা সম্ভব ছিল তার সবই করা হয়েছে। করণীয় কোন কিছু থেকেই বিরত থাকা হয়নি। ) এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, হুমায়ূন ও তার স্ত্রী শাওন উভয়েই ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ক্যান্সার ও তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমাকে সরাসরি যোগাযোগ ও আলোচনা করার অনুমতি এবং অধিকার দিয়েছিল বলেই সেটা করতে পেরেছি আমি, তা নইলে এদেশে ডাক্তার বা হাসপাতালের তরফ থেকে রোগীর পরিবারের বাইরের কাউকে রোগীর শারীরিক অবস্থা বা চিকিৎসা সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া হয় না। প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিধান লঙ্ঘনের সম্ভাবনাতে সবাই বড় সতর্ক এদেশে।

আমাকে এ বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সম্ভবত এ কারণে যে, আমি নিজে ডাক্তার না হলেও বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানে, বিশেষ করে ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে কারণে হয়তো এত অনায়াসে আমাকে এ দায়িত্ব তারা দিতে পেরেছিল, সেটা হলো, চিকিৎসাক্ষেত্রে আমার বিবেচনার ওপর হুমায়ূন ও তার ঘনিষ্ঠজনের একরকম আস্থা জন্মেছিল। গত বছর (২০১১ সালে) সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে সিঙ্গাপুরে রুটিন শারীরিক পরীক্ষা করতে গিয়ে আকস্মিকভাবেই ধরা পড়ে হুমায়ূনের কোলনে (বৃহদান্ত্রে) ক্যান্সার। আর তাও চতুর্থ স্টেজে। সাধারণত রোগীর শরীরে ক্যান্সারের অবস্থা নির্ণয়ে এ স্টেজগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়।

কতগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে ক্যান্সারের ব্যাপকত্ব ও বিস্তৃতি অনুসারে সাধারণত এ স্টেজগুলোকে এক থেকে চার পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়। স্টেজ ফোর ক্যান্সার মানে সবচেয়ে পরিণত বা Advanced Stage-ক্যান্সার। স্টেজ ফোর-এ কর্কট কোষগুলো মূল জায়গা ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। কোলন ক্যান্সারে চার নম্বর স্টেজ থেকে আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা খুবই কম, (শতকরা ৭% এর মতো)। সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররাই দুঃসংবাদটি দিয়ে হুমায়ূনকে জানিয়েছিলেন কোলন থেকে তার ক্যান্সার লিভারের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।

এ অবস্থায় সম্ভবপর চিকিৎসার মধ্যে ছিল কেমোথেরাপি অথবা কিছু কেমোথেরাপি আর সার্জারি। কিন্তু অসুখের নামটা শুনেই হুমায়ূন মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জায়গায় যাবেন এবং সেটা সিঙ্গাপুর নয়। আমেরিকা। সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন তিনি সপরিবারে। স্ত্রী শাওন ইন্টারনেট ও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার এ বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্যে সবচাইতে বিখ্যাত হাসপাতাল।

সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ুন আমেরিকায় সেস্নান ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এত নামকরা ও পুরনো প্রতিষ্ঠান বলেই হয়তো চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে এখানে চিকিৎসা শুরু করে দেয়া সম্ভব হয় না। অপেক্ষা করতে হয়। সে যাই হোক, হুমায়ূনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকাশক ও প্রতিবেশি আলমগীর রহমানের (আলমগীর আমাদের-ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্তত চার দশক ধরে) কাছে কাকতালীয়ভাবে সংবাদটা জানতে পেরে আমি হুমায়ূনের জন্যে তার নিউইয়র্কে পেঁৗছার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেস্নান ক্যাটারিংয়ে ডাক্তার দেখাবার জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করি। এ ব্যাপারে আমার সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর রিভলিন আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন।

এছাড়া আশি আর নব্বইয়ের দশকে প্রায় এক যুগ ধরে আমি সেস্নান ক্যাটারিংয়ে গবেষণার কাজ করেছি বলে সেখানে এক আধটু জানাশোনা তখনো অবশিষ্ট ছিল। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ রাতে সপরিবারে হুমায়ূন নিউইয়র্কে পেঁৗছান আর সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ দুপুর একটায় তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক হয় সেস্নান ক্যাটারিংয়ে। সেদিন সব কাগজপত্র, প্লেট দেখে, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার স্থির করেন প্রথম কিস্তিতে ছয়টি কেমো নিতে হবে। হুমায়ূনের ক্যান্সারের তখন যে অবস্থা (স্টেজ চতুর্থ), তাতে তখন আর সার্জারি করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের কাগজে এ সার্জারি না করার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক সংবাদ ভেবে লিখে ফেলে, `অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই।

অপারেশন ছাড়াই হুমায়ূন আহ?মেদ সুস্থ হয়ে উঠবেন। ` ডাক্তার স্টিভেন ভিচ বললেন, প্রথম ছয়টি কেমো দেয়ার পর CT scanmnসহ আবার সমস্তরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পরবর্তী কর্মপদ্ধতি স্থির করা হবে। মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ের আন্তর্জাতিক শাখার প্রধান ডাক্তার স্টিভেন ভিচ নিজেই হলেন হুমায়ূনের ডাক্তার। বললেন, আপাতত যে ৬টি কেমো দেয়া হবে তার প্রতিটির ভেতর ৩টি করে ক্যান্সারের ওষুধ থাকবে। লক্ষ্য করলাম, সেস্নান কেটারিং গত পঁচিশ বছরে অনেক বদলে গেছে।

বড়ো ও (আকৃতিতে) হয়েছে অনেকটাই। বিশেষ করে, এখনকার নিয়মে যারা বিদেশি এবং বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্য বীমাবিহীন বিদেশি, তাদের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় সবটা অর্থই আগে থেকে ক্যাশিয়ারে জমা দিতে হবে, তারপরই চিকিৎসা শুরু হবে। এটার কারণ, অনেক বিদেশি রোগী নাকি ধারে চিকিৎসা নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করেই নিজ দেশে ফিরে গেছে। তারা জানান, নতুন পলিসি অনুযায়ী হুমায়ূনের কেমোথেরাপির প্রথম কোর্সের (৬টি কেমোর) যাবতীয় অর্থ আগাম পরিশোধ করলে তবেই চিকিৎসা শুরু হবে। সে তো একসঙ্গে বিস্তর টাকার ব্যাপার।

অত টাকার ব্যবস্থা রাতারাতি করা প্রায় অসম্ভব। অথচ চিকিৎসা আর দেরি না করে এক্ষুণি শুরু করা দরকার। এ অবস্থায় ডক্টর ভিচসহ আরও দু`একজনের সঙ্গে কথা বলে কিস্তিতে টাকাটা দেয়ার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হই। সেস্নানে কেমো দেয়ার ধরনটি ছিল এরকম। কেমো নেয়ার দিন সকালে হাসপাতালে গেলে প্রথমে রোগীর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হবে।

দেখার জন্যে, কেমো নেয়ার জন্যে তার স্বাস্থ্য উপযুক্ত কিনা। তার হিমোগ্লোবিন, লাল, সাদা ও অন্য (প্লেটিলেট) রক্তকণার পরিমাণ, ধাতব পদার্থ ইত্যাদি সব ঠিক আছে কিনা দেখা হবে। তার পরে ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করবেন, কথা বলবেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন। ইতোমধ্যে ফার্মেসিতে তার ইন্ট্রাভেনাস কেমো দেয়ার জন্যে ককটেইল তৈরি হতে থাকবে। অর্থাৎ ক্যান্সার-কোষগুলো মেরে ফেলার জন্যে যে তিনটি কড়া ওষুধ শরীরে যাবে তা শরীরের ভালো জীবকোষগুলোকেও যাতে ধ্বংস বা ক্ষতি না করে সে জন্যে ওই ওষুধের সঙ্গে ভিটামিন, মিনারেল, স্টেরয়েড ছাড়াও বিভিন্ন দ্রব্য মেশানো হয় যার জন্যে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইদানিং আগেকার দিনের তুলনায় অনেক কম হয়।

কয়েক ঘণ্টা ধরে সেই ওষুধ-ককটেল শরীরে দেয়ার পরে বাকি ওষুধটা একটি বোতলের মতো ধাতব পাত্রে ভরে রোগীর পেটের ওপর একটা ব্যাগে বেঁধে দেয়া হয়। একটা সরু নল দিয়ে সেই বোতল থেকে ওষুধ এসে রোগীর বুকের চামড়ার ভেতরে semi-permanent--ভাবে বসানো সবফর-ঢ়ড়ৎঃ ুএর ভেতর দিয়ে দুদিন ধরে ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করবে কিন্তু তার জন্যে এ দুদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। ঘরে গিয়ে দুদিন পরে এসে খালি ক্যানিস্টার তা খুলিয়ে আসতে হয় কেবল। এভাবে প্রতি দু`সপ্তাহ পর পর তিন দিন ধরে কেমো চলতে থাকে। কিন্তু কেবল প্রথম দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আউটপেশেন্ট বিভাগে থাকতে হয়।

বাকি কেমো চলে বাড়িতেই। ডাক্তার ভিচ ও সেস্নান ক্যাটারিংয়ের সমাজকর্মীদের সঙ্গে এ চিকিৎসার খরচের ব্যয়ের ব্যাপারে কথা বলে কিছু করে উঠতে পারিনি। গত ২৫ বছরে অনেক বদলে গেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। অত্যন্ত বেশি ব্যবসায়ী মনোভাব গড়ে উঠেছে এখানে_ ওটাই যে বর্তমানে সেস্নান ক্যাটারিংয়ের সংস্কৃতি, মনে হলো আমার। আন্তর্জাতিক ভবনে প্রতিটি আন্তর্জাতিক রোগীর জন্য রয়েছে একজন করে বিশেষ সমন্বয়কারী।

আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের বেলায় সমন্বয়কারী হিসেবে পড়লেন, এমন একজন মধ্যপ্রাচ্যের নারী, যার আগাগোড়া ব্যবহারে এটিই ফুটে উঠছিল যে, `বাবু যত বলে, মোসাহেব দলে বলে তার শতগুণ। ` আমার যুক্তি ছিল, হাসপাতাল যা বিল করে, কোন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই তার পুরোটা কখনো দেয় না। তারা তাদের হিসেব মতো একটা ন্যায্য ও নির্দিষ্টমূল্য স্থির করে দেয় প্রতিটি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজ বা সেবার জন্যে। প্রত্যেকটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই যেহেতু স্বতন্ত্র ও স্বাধীন, তাদের সবার `ন্যায্য মূল্য`ও-এক নয়। আর কোন বিশেষ হাসপাতাল যদি কোন একটি বিশেষ ইন্স্যুরেন্স গ্রহণ করে থাকে (সব হাসপাতাল সব ইন্স্যুরেন্স নেয় না), তাহলে সেই হাসপাতাল ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নির্ধারিত ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য।

তারপর পলিসি অনুযায়ী রোগী তার পরিশোধ মেটায়। যেমন, যদি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি `ন্যায্যমূল্যের` ৮০% দেয়, রোগীকে দিতে হয় বাকি ২০%। আর তখন মূল বিল থেকে ন্যায্যমূল্যের অংশটা হাসপাতাল বাদ দিয়ে দেয়। আমার যুক্তি ছিল, ইন্স্যুরেন্স থাকলে যদি তারা চিকিৎসার জন্যে আংশিক মূল্য নিয়ে বাকিটা ছেড়ে দিতে পারে, তাহলে যে ব্যক্তির ইন্স্যুরেন্স নেই, যে ক্যান্সার চিকিৎসার মতো বিশাল খরচ নিজে বহন করছে, তার জন্যে কোন প্রকার ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা থাকবে না কেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এ নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ের ব্যাপারে কিছু করতে সক্ষম হলাম না।

ইতোমধ্যে সব দেখেশুনে পরে অবশ্য আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম, কোলন ক্যান্সারের জন্যে যে কেমো হুমায়ূন নিচ্ছে এখানে, তার সঙ্গে এদেশের অন্য হাসপাতালের কোলন ক্যান্সারের কেমোর কোন বস্তুগত বা গুণগত পার্থক্য নেই। ডক্টর ভিচ প্রথম থেকেই হুমায়ূনকে খুব পছন্দ করেন এবং হুমায়ূন-ও ভিচ বলতে অজ্ঞান। ড. ভিচ আমাদের প্রথম দিনেই বলেছেন, এখন যে চিকিৎসা চলছে তা একেবারেই স্ট্যান্ডার্ড কেমোথেরাপি যা বেশকিছু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে অন্তত এ বিশেষ চিকিৎসাটির ক্ষেত্রে সেস্নান কেটারিংয়ের মতো প্রাইভেট এবং খরচসাপেক্ষ হাসপাতালে এসে নিজের বিত্তের এক বিশাল অংশ খুইয়ে রুটিন চিকিৎসা নেয়ার মানে হয় না। তিনি বলেছিলেন, শুধু এখানকার সিটি হাসপাতালে কেন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, এমন কি হয়তো ঢাকায় বসেও একই চিকিৎসা পেতে পারেন হুমায়ূন।

ইতোমধ্যে শাওন সিটি হাসপাতালে কর্মরত এক বাঙালি ডাক্তার দম্পতি কাছে খোঁজখবর নিয়ে দেখে সিটি হাসপাতালগুলোতে ফোর্থ স্টেজ কোলন ক্যান্সারের জন্য কেমোতে একই ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু তবু আমাদের দ্বিধা কাটে না। হুমায়ূন রাজি হলেও শাওনের মনে ভয়, যদি চিকিৎসার মান একই রকম না হয়! ওদিকে শাওনের মা এখান থেকে ও শাওনের বাবা ঢাকা থেকে ক্রমাগত বলছেন সেস্নান ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যদি চিকিৎসার ব্যাপারে কোন রকম ছাড় দিতে হয়, সেটা করার কথা যেন চিন্তাতেও না রাখে তারা। যাই হোক, সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে আমি ডেনভার, কলরেডোতেও খোঁজ করি। নিউইয়র্কের সিটি হাসপাতালের মতো না হলেও সেস্নানের চাইতে অনেক কম খরচ এখানেও।

আমি তখন ডাক্তার ভিচকে গিয়ে দুটো কথা বলি। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন হুমায়ূনের অত্যন্ত প্রিয়জন-তার সুহৃদ, ঢাকায় তার পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি, হুমায়ূনের বইয়ের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। ব্যবসা, বাড়িঘর, পরিবার সব ছেড়ে দীর্ঘদিন তিনি এখানে পড়ে আছেন কেবল হুমায়ূনের চিকিৎসার তদারকি করতে। তাছাড়া মাযহারকে হুমায়ূন খুবই স্নেহ করে। অনেক ব্যাপারে তার ওপর নির্ভর করে।

সেই গৃহে আমাদের অবস্থানের সময় আমি দেখেছি, অন্যের জন্যে কী সাংঘাতিক করতে পারে এই মাজহার। খাবারের ব্যাপারে হুমায়ূন খুবই খুঁতখুঁতে। এক খাবার দুবেলা খাবে না, বাসি কিছু তো খাবেই না। তার ওপর কেমোথেয়াপী নিলে এমনিতেই খাদ্যে রুচি চলে যায়। গত নয়-দশ মাসে আমরা অন্তত যা বলে, সেটা কিনতে তখনই বাজারে ছোটে মাজহার।

শুধু তাই নয়, অনেক দিনই নিজের হাতে রান্না করে মাজহার, হুমায়ূন যেমন করে রাঁধলে পছন্দ করে ঠিক সেভাবেই রাঁধে। প্রায় বিকেলেই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্যুপ বানিয়ে আনে তাজা তরিতরকারি দিয়ে হুমায়ূনের জন্যে। কখনো ফল কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে আসে প্লেটে। বাড়ির এ অনাত্মীয় লোকটিকে বরাবর দেখেছি সম্পূর্ণ পরিবারটিকে আগলে রাখতে। কে বলবে ওকে দেখে সে ঢাকায় এত বড় ব্যবসায়ী! যে কথা বলছিলাম।

সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে, নিজেরা নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে আমরা আবার ডাক্তার ভিচের সঙ্গে বসি একদিন। তিনি আমাদের সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন যে সিটি হাসপাতালে একই চিকিৎসা চলবে হুমায়ূনের। কথা দেন সিটি হাসপাতালের জন্যে একটি ফাইল তৈরি করে দেবেন। সেখানে তার চলতি চিকিৎসার বিষয়ে সবকিছু লিখে দেবেন, মানে এখানে কিভাবে কোন ওষুধ কত ডোজে কত দ্রুততার সঙ্গে দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি। আমি তখন তাকে অনুরোধ করলাম এটা কি আদৌ সম্ভব যে তিনি তার ওষুধের ককটেইলের একটা রেসিপি দিয়ে দেবেন আমাদের কাছে বা সিটি হাসপাতালে যেখানে রন্ধন পদ্ধতির মতো করে লেখা থাকবে প্রতিটি adjvuant দ্রব্যের নাম, পরিমাণ, মেশাবার পদ্ধতি, কতক্ষণ ধরে মেশানো হয়, সবকিছু, পরম্পরাসহ।

ডক্টর ভিচ রাজি হলেন, সেটাও নিজের হাতে লিখে দেবেন তিনি। এরপর তার সঙ্গে কথা হলো, তার পরামর্শমতো, তার তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা চলবে কিন্তু খরচ কমাবার জন্যে কেমোটা নেয়া হবে সিটি হাসপাতালে। এছাড়া কিছুদিন পর পর রোগীর অবস্থা নিরুপণে যে স্ক্রিনিং চলবে, জানার জন্যে কতটা উন্নতি হলো, কতটা ছোট বা শুকিয়ে এলো টিউমারের আকৃতি, টিউমার মার্কারের পরিমাণ কতখানি কমল ইত্যাদি সব তথ্য আমরা ডাক্তার ভিচকে জানাব, দেখাব সব কাগজপত্র, প্লেট। তিনি রাজি হলেন। সেই থেকে আমি হুমায়ূনের ব্যাপারে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছি।

ডাক্তার ভিচের সঙ্গে আমার ই-মেইলে শেষ দুটি যোগাযোগ হয়েছে ১৭ আর ১৯ জুলাই (হুমায়ূনের মৃত্যুর দিন)। ইতোমধ্যে সেস্নান ক্যাটারিং হাসপাতালে ৫টি কেমো নেয়া হয়ে গেছে। এরপরে হুমায়ূনের সিটি হাসপাতালে (বেলভিউ হাসপাতালে) চিকিৎসার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেন নিউইয়র্কের মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। সেস্নান কেটারিংয়ের এক একটা কেমোতে যেখানে সাড়ে সতেরো হাজার ডলার লাগত, সেখানে বলতে গেলে সামান্য খরচে বা বিনা খরচে তার একই কেমো চলতে থাকে বেলভিউতে। বরং বেলভিউতে Avastin নামে আরও একটি নতুন ওষুধ যোগ করা হলো যেটা মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ে দেয়া হতো না।

Avastin সাধারণত এ পর্যায়ের অধিকাংশ কোলন ক্যান্সার রোগীদের দেয়া হয় অন্য তিনটি Oxaliplatin, Levo covenin, 5 FU) ওষুধের সঙ্গে, যে তিনটি সেস্নান কেটারিংয়ে দেয়া হচ্ছিল। Avastin কেন এতদিন দেয়া হয়নি বেলভিউ হাসপাতালের অঙ্কোলজিস্টের প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার ভিচের বক্তব্য ছিল, দুই কারণে সেটা করা হয়নি। ১) যখন হুমায়ূন প্রথম চিকিৎসা শুরু করেন এখানে, তার কোলনের টিউমারের যা অবস্থা ছিল, আকৃতি ও রক্তক্ষরণের পরিপ্রেক্ষিতে, যে তিনি ইচ্ছে করেই আধংঃরহ দেননি, কেননা, তাতে বিস্নডিং বেশি হতে পারত। ২) আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, তিনি ভেবে দেখেছেন Avastin (যা টিউমর কোষে রক্ত সাপ্লাই বন্ধ করে টিউমারকে বড় হতে বাধা দেয়)। তার ককটেইলে যোগ করলে ফলাফল ঊনিশ বিশের বেশি কিছু পার্থক্য হতো না।

এজন্যে পকেট থেকে এত খরচের পর আরেকটি খুব দামি ওষুধ যোগ করে খরচ বাড়াতে বিবেকের কাছে সায় পাননি তিনি। বেলভিউর অল্প বয়সী অত্যন্ত সতর্ক নারী ডাক্তারটি তখন এ প্রৌঢ় অভিজ্ঞ ডাক্তার ভিচকে জিজ্ঞেস করলেন, ৫টি কেমোর পরে যেহেতু তার টিউমারের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো, রক্তক্ষরণও আর নেই, টিউমার মার্কারের পরিমাণও কমে এসেছে, সেক্ষেত্রে এখন Avastin যোগ করলে কেমন হয়? ডাক্তার ভিচ তাকে Avastin যোগ করার পরামর্শ দিলেন। এভাবে হুমায়ূন আহমেদের সেস্নান কেটারিংয়ের চিকিৎসাই বেলভিউ হাসপাতালে (সিটির অধীনে হলেও বেলভিউ হাসপাতাল গুণগত দিক দিয়ে খুবই নাম করা হাসপাতাল। শুধু সিটির অধীনে নয়, বেলভিউ হাসপাতাল খ্যাতনামা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত) হতে থাকে। পার্থক্য শুধু বেলভিউতে ঘরে কেমো নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।

এখানে কেমো নেয়ার প্রথমদিন আউটপেশেন্ট হিসেবে এবং পরবর্তী দুদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কেমো নিতে হয়। এটা একদিক দিয়ে ভালো কেননা, কেমো নেয়ার সময়েও সর্বক্ষণ ডাক্তারদের নজরের ভেতর থাকে হুমায়ূন। বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত দু`একজন বাঙালি স্বাস্থ্যকর্মী হুমায়ূনকে রোগী হিসেবে পেয়ে মহাআনন্দিত এবং তাদের একজন, রন্? সাধ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রিয় লেখকের জন্যে। যেমন, কেমো নেয়ার সময়ে semi private room এর বদলে শুনেছি private room এর ব্যবস্থা করেন তারাই যাতে ইছে করলে শাওন এসে থাকতে পারে রাতে। মাঝখানে কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দু` দু`বার সাদা রক্তকণা এবং প্লেটিলেটের পরিমাণ অনেকটা কমে যায় হুমায়ূনের।

এ রকমটি ঘটা খুবই স্বাভাবিক কেমোথেরাপির রোগীদের। এরকম একবার হয়েছিল সেস্নানে চিকিৎসার সময়েও। তখন নির্ধারিত কেমোর দিন পেছাতে হয়। প্রয়োজনে রক্তকণার সংখ্যা বাড়াবার জন্যে bone-marrow কে চাঙ্গা করতে একরকম উত্তেজক ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। তাতে হুমায়ূনের বেশক`দিন ধরে হাতে পায়ে খুব ব্যথা, সামান্য জ্বর ও বিভিন্ন রকম শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য হতো।

কেমো নেয়া, রক্ত পরীক্ষা করা ও স্ক্রিনিংয়ের জন্যে হাসপাতালে ঘন ঘনই যেতে হতো হুমায়ূনকে। বেলভিউ হাসপাতাল ম্যানহাটানের দক্ষিণ পূর্বদিকে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছে। আর হুমায়ূনের ভাড়া করা বাসা জামাইকা, কুইন্সে। অনেকটাই পথ। প্রথমদিকে বিশ্বজিতের স্ত্রী রুমা সাহাই প্রধানত নিয়ে যেত হুমায়ূন-শাওনকে হাসপাতালে।

পরের দিকে জ্যোতি (জ্যোতি প্রকাশ দত্ত) নিউইয়র্কে থাকাকালীন অবস্থায় (মার্চ থেকে জুন) প্রায়ই নিয়ে যেত হুমায়ূনকে। জ্যোতির সঙ্গ খুব উপভোগ করত হুমায়ূন। অপেক্ষা করে বসে থাকতো কখন সে আসবে। রুমা ও জ্যোতি ছাড়াও কখনো কখনো হুমায়ূনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন হুমায়ূনের বাল্যবন্ধু ফান্সু ম-ল, নুরুদ্দীন সাহেব ও রুবেল। আটটি কেমো শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় পুরো স্ক্রিনিং হলো।

আমরা ফলাফল নিয়ে সেস্নান কেটারিংয়ে ডক্টর ভিচের কাছে গেলাম। শাওন, মাজহার, জ্যোতি ও আমি ছিলাম সেখানে। মনে মনে আশা ছিল। কেননা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে হুমায়ূনের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো হয়েছে, ওর ওজন বেড়েছে, আগের তুলনায় খাবারও খাচ্ছে নিয়মিত। এতদিনে লিভারের টিউমারগুলো হয়তো যথেষ্ট সংকোচিত হয়েছে।

হয়তো সে এখন অস্ত্রোপচারের জন্যে উপযুক্ত হবে। কিন্তু তারপরেও মনে সন্দেহ ছিল বলে আমরা রোগীকে সঙ্গে নিয়ে যাইনি। হুমায়ূন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ। এসব ব্যাপারে একেবারে ছেলে মানুষের মতো। ভয় ছিল, কোন কিছু নেতিবাচক শুনলেই না বলে বসে, `তাহলে আমি চললাম দেশে।

` ডাক্তার ভিচ দেখেশুনে বললেন, (পরে তাদের সার্জারি বিভাগের সঙ্গেও কথা বলে একই মন্তব্য করেছিলেন) হুমায়ূনের অনেক উন্নতি হলেও লিভারের টিউমার এখনো সেই পর্যায়ে আসেনি, যখন Local Emboli“ation করা যাবে। সেস্নান কেটারিংয়ে প্রচলিতই যুগান্তকারী টেকনিকের কথা বলেছিলেন ডাক্তার রিভলিন (আমার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান) ও ডাক্তার ভিচ। যাদের টিউমার প্রাইমারি জায়গাথেকে শুরু করে এখন ছড়িয়ে গেছে অন্যত্র, যেমন, লিভারে (liver metastatis)। এ পদ্ধতি তখন ব্যবহার করা হয়। ইদানিং আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।

এ পদ্ধতি অনুযায়ী লিভারের যেখানে যেখানে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সেখানে গিয়ে ওই বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোকে স্থানীয়ভাবে এক ধরনের বিশেষ টেকনিকে পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে ওদের নির্মূল করতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় কেমো দিতে না হয়। ফলে পুরো লিভার বা সমস্ত শরীরের জীবকোষগুলো মাত্রাতিরক্ত কেমোর প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আর সম্ভাবনা থাকে না। এরপর বেলভিউতে আরও ৪টা কিমো দেয়া হলো। ১২টা কিমোর ধাক্কা সামলানো কম কঠিন কাজ নয়। হুমায়ূন মনের জোরে একরকম সহজভাবেই তা পার করে দিল।

এদিকে শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও শাওনের মা এবং কখনো কখনো ওর ছোটবোন এসে ওকে সাহায্য করে, মনে জোর দেয়। দুটো অতি শিশু সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কের মতো বৃহৎ শহরে তা না হলে ওদের খুব অসুবিধে হতো। ১২টা কিমো দেয়ার পর নতুন করে আবার স্ক্রিনিং হওয়ার পর বেলভিউ-নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজের সার্জন ডাক্তার মিলারের সঙ্গে হুমায়ূন ও তার পরিবারের দীর্ঘ মিটিং হয়। আমি তখন ডেনভারে। প্রতিদিনই টেলিফোনে খবর পাই হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থার।

সার্জারির ব্যাপারে অঙ্কোলজি বিভাগ থেকেই উদ্যোগ নেয়া হয়। ৩০ এপ্রিলে প্রাথমিক কথা হওয়ার পরে আবার দ্বিতীয় দফায় বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ১২ জুন ভোরে হুমায়ূনের সার্জারি হবে কোলন ও লিভারে দুই জায়গাতে একই দিনে। কোলনে হবে প্রথাগত সার্জারি। অর্থাৎ বৃহদান্ত্রের যে অংশে ক্যান্সার রয়েছে সেই অংশটুকু কেটে ফেলে দিয়ে আবার সুস্থ বৃহদান্ত্রের দুই মাথা যোগ করে সেলাই করে দেয়া হবে। আর লিভারে প্রথম local emboli“ation technique ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে।

যদি সেটা সম্ভবপর না হয় অথবা কোন জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে লিভার থেকে প্রথাগতভাবে মানে পুরনো স্টাইলে টিউমার কেটে ফেলে দেয়া হবে। দুটোর জন্যই সম্মতিপত্র রেখে দিলেন তারা। সংবাদটি শুনে আমরা সকলেই খুশি। সার্জারি-ই একমাত্র আশা যদি হুমায়ূনকে নিরাময় করে তোলা যায়। কেননা দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিমোথেরাপি আর আগের মতো কাজ করছিল না।

সত্যি বলতে গেলে আটিটি ও বারোটি কিমোর ভেতর লিভারে খুব যে দৃশ্যনীয় উন্নতি ঘটেছে তা নয়। ১২ জুন হুমায়ূনের সার্জারি হবে, বেলভিউ থেকেই সুসংবাদটি দিল আমায় শাওন। আর ওরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই আমি ১১ জুন সন্ধায় ডেনভার থেকে নিউইয়র্কে পেঁৗছার একটি প্লেনের টিকিট কেটে ফেলি। জ্যোতিও অখন নিউইয়র্কেই থাকবে। ওর সার্জারির জন্য আমার এতদূরে আসার খবর শুনে হুমায়ূন খুবই খুশি হয়।

সেকথা হাসপাতাল থেকে ঘরে যেতে যেতে ফোন করে জানায় আমাকে। আমরা সকলে উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করি। ১১ তারিখে রাতে লাগোর্ডিয়া বিমানন্দর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে জ্যোতি, ও সঙ্গে আসা মাজহার, হুমায়ূনের জামাইকার বাসায় নিয়ে আসে। হুমায়ূনকে সে রাতে খুব হাসি খুশি ও চিন্তামুক্ত লাগছিল। আসন্ন সার্জারির জন্য দুশ্চিন্তার কোন চিহ্ন নেই।

পরদিন সকাল ৬টায় সার্জারি। সাড়ে ৫টায় পেঁৗছুতে হবে। হুমায়ূনের ইচ্ছা জ্যোতির সঙ্গে যাবে হাসপাতালে। যথারীতি ভোর সাড়ে ৪টায় জ্যোতি আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে সাড়ে ৫টার আগেই আমরা বেলভিউতে পেঁৗছি। আমাদের গাড়িতে হুমায়ূন, শাওন, জ্যোতি ও আমি।

মাজহারের বন্ধু রুবেলের গাড়িতে রুবেল, মাজহার, ও ফান্সু। সাড়ে ৫টায় সার্জারি বিভাগে এসে কাগজপত্র জমা দেয় হুমায়ূন। ৬টার আগেই আমাদের ওয়েটিং রুমে রেখে হুমায়ূনকে নিয়ে গেল নার্স। বলল অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে আবার দেখা পাব তার। ওয়েটিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করি।

ভোর ৬টার দিকে কয়েকজন রোগীকে স্ট্রেচারে করে নার্স নিয়ে গেল সার্জারিতে আমাদের সামনে দিয়ে। কিন্তু হুমায়ূন কোথায়? একটু পরে দেখি গাউন পরা হুমায়ূন আমাদের সামনে দিয়ে, স্ট্রেচারে করে নয়, পায়ে হেঁটে দিব্যি নার্সের সঙ্গে হাসিমুখে চলে গেল অপারেশন থিয়াটারের দিকে। প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো বড় দীর্ঘ। মনে হয়, অনন্তকাল ধরে চলে। ওয়েটিং রুমে বসে আছি আমরা শাওন, আমি, জ্যোতি, মাজহার, বিশ্বজিৎ, বগুড়ায় হুমায়ূনের স্কুলের সহপাঠী বন্ধু ফানসু আর মাজহারের পুরনো বন্ধু রুবেল।

অপেক্ষা করছে আরও কিছু অপরিচিত মানুষ, আমাদেরই মতো তাদের প্রিয়জনদের জন্য। আমাদের সকলের দৃষ্টি টিভি মনিটরের দিকে। হুমায়ূনের জন্য আমাদের একটা নম্বর দেয়া হয়েছে, আমরা বসে বসে দেখছি মনিটরে কোথায় কী পর্যায়ে আছে সে। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য একটি ভিন্ন রঙ। হুমায়ূনের সার্জারির রঙ আর পাল্টায় না।

সার্জারি চলছে তো চলছেই। সাড়ে ৬ ঘণ্টা পরে দেখা গেল তার সার্জারি শেষ। রিকোভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। অবশেষে রঙ পাল্টালো হুমায়ূনের নম্বরে। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বা করমর্দন করে নিজেদের আনন্দ ও তৃপ্তি প্রকাশ করি।

আমি বিশ্বজিতের কাছে গিয়ে তাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। তার ব্যবস্থাব জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পরে রিকোভারি রুমে জ্ঞান ফিরল হুমায়ূনের। ততক্ষণে হুমায়ূনের সার্জিকেল টিম এসে আমাদের বলে গেল অপারেশন সফল হয়েছে। Local emboli“ationলেগেছে।

লিভার কাটার দরকার হয়নি। কোলনের সার্জারিও ভালোভাবে হয়েছে। সার্জন বললেন, `যতদূর আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার শরীরে এখন আর কোন ক্যান্সার নেই`। যদি কোন টিউমার ইতোমধ্যেই অন্য কোথাও তৈরি হতে শুরু করে থাকে যা এখনো চোখে দেখা যাচ্ছে না, অথবা আবার পরে যদি নতুন করে কোন টিউমার হয়, সেটার কথা অবশ্য বলা যাবে না এই মুহূর্তে। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না যেহেতু স্টেজ ফোরে হুমায়ূনের ক্যান্সারের অবস্থান।

আমরা ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানাই। ডাক্তার মিলার আসেননি ওয়েটিং রুমে অন্য সার্জনদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলে তারা জানান হুমায়ূনের সার্জারিকালে ডাক্তার মিলার সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অপারেশন রুমে। মঙ্গলবার সারাদিন ধরে সার্জারি চলে এই হাসপাতালে। পরবর্তী সার্জারি নিয়ে নিশ্চয় ব্যস্ত আছেন মিলার।

আমরা তখন একে একে গিয়ে রিকোভারি রুমে হুমায়ূনকে দেখে এলাম। যদিও সবার আগেই গেছে শাওন, তবু আমরা যারা তাকে দেখতে যাচ্ছি, সবাইকেই শুধু তার `কুসুম`- এর কথা জিজ্ঞেস করছে হুমায়ূন। কুসুমকে কাছে, চোখের সামনে সবসময়ের জন্য চায় হুমায়ূন। সাত ঘণ্টা একনাগাড়ে ওই রুমটাতে বসে আছি আমরা। কোথাও যাইনি কেউ এক মুহূর্তের জন্যও।

এখন সবারই খিদে লেগেছে। খেতে হবে। হুমায়ূনের কেবল পিপাসা পাচ্ছে তখন। পানি এখন দেয়া যাবে না, মুখে বরফের দু-একটা ছোট টুকরো দেয়া হলো। এ সময় তাকে দেখতে ঘরে ঢুকলেন নিউইয়র্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক সৈয়দ মুহাম্মদ উল্লাহ?।

এলো বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত সেই বাঙালি ছেলে রণি। আমার কানে তখন শুধু ঝংকার তুলছে `ক্যান্সার ফ্রি` শব্দ দুটি। হুমায়ূন ক্যান্সার ফ্রি। আঃ! কী মিষ্টি ওই শব্দ দুটি। ৫ দিন সার্জিকেল বিভাগের ICU তে থাকার পর ১৭ তারিখে রাতে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হলো হুমায়ূনকে।

সাধারণত প্রাইভেট রুমই দেয়া হয় তাকে, কিন্তু সেদিন কোন প্রাইভেট রুম খালি না থাকায় তাকে semi-private রুমে থাকতে হলো। তার মানে আরেকজন রোগী ছিলেন সেই ঘরে। সেদিন সকাল থেকেই হুমায়ূনকে ওঈট থেকে স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে, টের পেয়েছিলাম আমরা। ডাক্তার রিলিজপত্র লিখে দিয়েছেন অতি ভোরেই। কিন্তু ওয়ার্ডে রুম খালি না পাওয়ায় এই অবেলায় মানে রাত্রিতে তাকে নেয়া হলো সেখানে।

১৯ তারিখে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মাজহারের ফোনে, বলল হুমায়ূনকে রিলিজ করে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। সে ঘরে আসার জন্য অস্থির আগ্রহে অপেক্ষ করছে তার হাসপাতালের রুমে। আমরা তখন আমদের বাড়িতে রকল্যান্ড কাউনটিতে, শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি এটা বলেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হই। কিন্তু হাসপাতালে পেঁৗছার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ফান্সু ম-লের গাড়িতে করে হুমায়ূন ও শাওন বাড়ি চলে যায়।

বুঝলাম, হুমায়ূন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছিল না। নিষাদ আর নিনিদকে দেখে না আজ এক সপ্তাহ। ওকে দোষ দিই কী করে? হাসপাতালে তখনো মাজহার ও বিশ্বজিৎ। বিশ্বিজতের বেশ খানিকটা সময় লাগল হুমায়ূনের বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো হাসপাতালের একাধিক ফার্মেসি থেকে তুলতে। অপেক্ষা শেষে ওকে আর মাজহারকে নিয়ে আমরা কুইন্সে যেতে থাকি।

হুমায়ূনের ঘর থেকে আগেই সব জিনিসপত্র বের করে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছিল। এই বাড়িটি যেহেতু দোতলা, হুমায়ূনকে কেউ ঝামেলা বা বিরক্ত করতে পারবে না। কেননা বাইরের ঘরটি নিচতলায়। যারা আসবে সেখানেই বসবে। আমরা নিজেরাও হুমায়ূনের ঘরের বাইরে দূর থেকে তাকে দেখে এলাম একবার।

ঘরের ভেতরে যাইনি। হুমায়ূনের খোঁজ নেই প্রতিদিন। শুনি পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি। সেটা প্রত্যাশিত, ডাক্তারও বলেছিলেন। আর সেতো হবেই! একই সঙ্গে পেটের দুই জায়গায় এত বড় সার্জারি হয়েছে।

২১ তারিখ দুপুরে মাজহার আমাদের রকল্যান্ডের বাড়িতে ফোন করে জানায় হুমায়ূনের কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। পেটে ব্যথাতো আছেই এবং সামান্য জ্বর ৯৯.৭ ডিগ্রি। আমি তাকে বললাম হুমায়ূনের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। আমার সঙ্গে কথা বলার পর ওরা হাসপাতালে ফোন করে। কিন্তু ডাক্তার মিলার ছিলেন না।

তবে তার সহকারীর সঙ্গে কথা হয়। সহকারী সার্জন জ্যোতি পরামর্শ দেন জ্বর ১০১ ডিগ্রি হলে টাইলেনল দিতে। আর ব্যথা খুব বেড়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে। এরপর খুব ভোরে মাজহারের ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। বলল হুমায়ূনের পেটের ব্যথা বেড়ে গেছে, অস্বস্তি হচ্ছে খুব।

। আমরা এই মুহূর্তে সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেও আরও দুটি ঘণ্টা লাগবে পাক্কা এই বাড়ি থেকে রওনা হয়ে হুমায়ূনের বাড়ি যেতে। ফলে আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে ওদের হাসপাতালে চলে যেতে বললাম। মাজহার ইতোমধ্যেই ফান্সুকে ডেকেছে। আমরা নিজেরাও রওনা হই শহরের দিকে।

যেতে যেতেই খবর পেলাম, ফান্সুর গাড়িতে এক ব্লক না যেতেই হুমায়ূনের এত বেশি খারাপ লাগা শুরু হয় যে সে আর বসে থাকতে পারছিল না। ফলে তারা ৯১১ কল করলে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সকে তারা বেলভিউতে নিয়ে যেতে বললেও অ্যাম্বুলেন্স তাদের নিকটবর্তী জামাইকা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে এসেছে। রাস্তায় খবর পে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.