সময়: রাত ২:১৫
বার : মঙ্গলবার
তারিখ: ৭আগস্ট,২০১২ইং
১৮রমাদ্বান,১৪৩৩হিজরি
এখন রাত দুইটা বাজে পনের মিনিট। এমন গভীর রাতে হলের পরিবেশ যতটা নিরব হওয়ার কথা, মোটেই ততটা নয়। রমাদ্বানের রাত্রিগুলিতে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা সেহরীর আগে সাধারনত ঘুমায়না। তারা হল জীবন উপভোগ করার চেষ্টায় মত্ত থাকে। তবে আমার রুমে মাত্র দুজন জেগে আছি।
আমি আর পাশের বেডের সুমন। সে GRE'র শব্দ মুখস্থ করছে। একবার বইয়ের দিকে আরেকবার ল্যাপটপের দিকে, আবার কখনো খাতায় আকিবুকি। দৃশ্যটা খারাপ না।
আমি শুয়েই ছিলাম।
ঘন্টাখানেক আগে প্রিয় সূরা 'আর রহমান' তেলওয়াত করে এসে ভাবলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সেহরী খেতে যাব। শুয়ে শুয়ে কি যেন ভাবছি। হঠাত্ কানে বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি শব্দ এল। চোখ তুলে চাইতেই জানালার স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। শুধু বৃষ্টি হচ্ছে বললে এর সবটুকু মমার্থ বোঝানো যাবেনা।
আকাশ যেন তার শরীরের সমস্ত নির্যাস উজাড় করে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। এমন দৃশ্য জানালা দিয়ে দেখে মন ভরবেনা, তাই ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। পাশের ভবন থেকে টিউব লাইটের আলোয় বৃষ্টির পানি দেখা যাচ্ছে। যে জায়গাটিতে পানি জমেছে তার উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে যেন প্রকৃতির ফোঁয়ারা তৈরী করেছে। শিল্পীর হাতের কি নিপুণ কারুকাজ।
'কত অপরূপ সাজে সাজিয়েছ ধরণী, ওহে করুণাময়'।
ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টির প্রতি অন্যরকম টান। কি এক আকর্ষণের যেন মোহ তৈরী হয়েছে বৃষ্টির প্রতি। আল্লাহর অনন্য নেয়ামতের প্রতি। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ আজও কানে বাজে।
বিমোহিত হই। মনে পড়ে ফার্মগেটে যখন কোচিং করতে আসলাম; বর্ষার দিনে টিনশেডের এক চায়ের দোকানে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শোনার জন্য। দোকানি তখন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- "অমন করতাছেন ক্যান ভাই, কি হইছে?"
আজও বৃষ্টির প্রতি সেই মোহ কাটাতে পারিনি। পারবোই বা কেমন করে? এই বর্ষাতেই তো জড়িয়ে আছে আমার ছেলেবেলার দিনগুলি। এক ডানপিঠে ছেলের সুখময় শৈশব স্মৃতিগুলি।
নানীজান বেঁচে থাকতে ছোট মামাকে দিয়ে ব্যাগ ভরতি আম কাঠাঁল পাঠাতেন। মা নানীজানের ছোট মেয়ে বলে আদরটা একটু বেশিই পেত। আর আমারো খাবারের ভাগীদার ছিলনা বলে পেটপুরে সব গলাধ:করন করতাম একাই। এছাড়া বর্ষার দিনে মায়ের হাতের খিচুড়ীর সেই অপূর্ব স্বাদ আজো জিভে জল এনে দেয়।
গ্রামে চঞ্চল ও ডানপিঠে হিসেবে বেশ সুনাম ছিল।
ছোটদের বিচার কাজগুলি আমিই সারতাম। ওপাড়ার একজন আমাদের পাড়ার ছেলেকে শাসিয়েছে? নে, চল। ওরে সাইজ কইরা আসি। ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন্সিও থাকত আমার কাঁধে।
আর বাদলা দিনে? বৃষ্টি শুরু আর ঘর থেকে দিতাম দৌড়।
দৌড়াতাম আর পিছলে পড়তাম। উঠে আবার দৌড়াতাম। খেলার সাথীদের নিয়ে কাঁদা মাঠে পিছলে পড়ার স্বাদ কতদিন যে পাইনা। ঠান্ডায় যখন শরীরে কম্পন শুরু হত, সবাই মিলে দীঘিতে দিতাম লাফ। আমাদের অভ্যার্থনা জানানোর জন্য যেন দীঘির উঞ্চ পানি অপেক্ষায় থাকত।
এরপর শুরু হত ডুবোডুবির খেলা। কে কতক্ষণ পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে! তাছাড়া বৃষ্টির দিনে বন্ধুদের নিয়ে ফুটবল খেলা আর কদম ফুলের খেলা আজীবন স্মৃতির পাতায় সগৌরবে থাকবে।
এখন বৃষ্টি অনেকখানি কমে গেলেও একেবারে থেমে যায়নি। টিপ টিপ বৃষ্টি বলা যায়। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে যে সেহরীর সময় হয়ে গেছে তা টেরই পাইনি।
বুকের মাঝে যেন সুখের ব্যাথা বেজে উঠছে। মহান আল্লাহ তায়ালা কি সুখময় শৈশবই না আমায় উপহার দিয়েছিলেন। মধুমাখা সোনালী দিনগুলোর কথা মনে হলেই মন বড় ব্যাকুল হয় সেই দিনগুলিতে ফিরে যাবার জন্য। কি সৌভাগ্য আমার! আল্লাহ শহরের ছেলে মেয়েদের মত আমার শৈশবকাল আটসাট খুপড়িতে দেননি। যারা কিনা বলে 'ধান গাছের কাঠ দিয়ে কি খাট তৈরী হয়?'
ছাপোসা মানুষগুলোর ঘরেও আমার ছেলেবেলা দেননি।
যাদের সারাদিন কেটে যায় কাগজ কুড়ানোর সন্ধানে, তাদের বর্ষা উপভোগের সময় কোথায়?
যিনি আমাকে এত সুন্দর সোনালী শৈশব উপহার দিলেন সেই সত্তার নিকট কি একবারও শুকরিয় আদায় করেছি আমি? কি আশ্চার্য! এভাবে তো কখনো ভাবা হয়নি। অথচ কিছুক্ষণ আগেই তেলওয়াত করলাম সূরা আর রহমানের সেই আয়াত-
'অতএব হে জ্বিন ও মানুষ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার আর কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?'
সত্যিই মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। আর এ কারনেই নিজেকে ধর্মপ্রাণ হিসেবে অন্যের কাছে জাহির করতেই আমরা ভালবাসি, ধর্মের কথাগুলো কখনো অনুধাবন করিনা।
বৃষ্টিস্নাত রাত আজ আমাকে আল্লাহর মহিমাকে স্বীকার করার চমত্কার একটি উপায় বাতলে দিল। আলহামদুলিল্লাহ।
। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।