এই পোষ্ট টি আমি ওয়াচে থাকা কালিন দিয়েসিলাম । ঈদের ছুটি তে অনেকে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তাই আবার দিলাম । আশা করি ভ্রমন পিয়াসু দের উপকার এ লাগবে ।
‘‘সাগর কন্যার কপালের টিপ সৈকত কুয়াকাটা, এতো বড় বেলাভূমি দুনিয়ায়ও নাই কোথা, হাঙ্গর জলে নৌকা চলে, এ জেলেদের জীবন- এইসব দেখতে কুয়াকাটায় ভিরলো পর্যটক। উঠতে সুরুজ, ডুবতে সুরুজ দেখবি আয় তরা চলি সাগর কন্যা কুয়াকাটা বাড়ি’’ দেশ-বিদেশী পর্যটক, প্রকৃতি প্রেমীদের প্রতি এই শ্বাশত আহবান- কুয়াকাটার এক প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক মোঃ আলমগীর মাস্টারের।
তার এই স্বরচিত গানের কলির মধ্যদিয়ে ফুটে উঠেছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার অপরূপ রূপ সৌন্দর্য।
সৃষ্টিকর্তার নিপুর হাতে প্রকৃতিকে কিভাবে বৈচিত্রময়, দৃষ্টিনন্দন ভাবে সাজানো হয়েছে, যা নিজ চোখে না দেখলে আক্ষরিক ভাষায় কারো পক্ষে বোঝানো সম্ভব নয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাত অনুমান ১২টার দিকে ধানসিঁড়ি পরিবহনের বাসে চড়ে কুয়াকাটায় পৌছাই। কোন হোটেলে ছিট নেই। খাবার হোটেলে খেতে খেতে সেই আলমগীর মাস্টারের সাথে পরিচয়।
অগত্যা তার বাড়ীর অতিথি। ভোর রাতে ডেকে দিলে সোজা সমুদ্র সৈকত। সুর্যোদয় দেখার পর সকাল সোয়া ৯টায় মটর সাইকেল আরোহী গাইড আনোয়ার হোসেনের সাথে পরিচয়। ৬০০ টাকার ভাড়ার চুক্তিতে কুয়কাটার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য চেপে বসি তার মটর সাইকেলে। বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুদ্ধবাজ অশ্বারোহী যোদ্ধার ন্যায় বালু চরে মটর সাইকেল চালানোতে পারদর্শী।
২৫/৩০ জনের পেশাদার মটরসাইকেল আরোহীদের একজন আনোয়ার আমাদের প্রথম নিয়ে গেল-ঝাউবনে। পটুয়াখালী বন বিভাগ এখানে ৬০ হেক্টর জমিতে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ঝাউগাছ লাগিয়ে সৈকতের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঝাউবনের উত্তরপার্শ্বেই লাগা ইকোপার্ক। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া এই পার্কটি ২০০৭ সালের সিডর আর ২০০৯ সালের ভয়াবহ আইলার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সাজানো বাগান আর বিভিন্ন বিনোদনের স্থাপন আজো সেই ধবংসযজ্ঞের স্মৃতি বহন করছে।
সমুদ্র সৈকতের পূর্বদিকের গঙ্গামতির চর ধরে ছুটে চলতে দেখি একঝাক সি-ঈগল। মটরসাইকেলের শব্দে একটু উড়াল দিয়ে আবার চরের উপর পানিতে কোলাহল করতে দেখলাম তাদের। ক্যামেরা বন্দী করি পাখিরদল। এখানে বিস্তীর্ণ চর জুড়ে জন্মেছে সুন্দরবনের গেওয়া নারিকেল বিথী ডোওয়া বন দেখতে দেখতে আগুনমুখা নদীর মোহনায় ডিঙ্গি নৌকায় করে পার হয়ে আমরা যাই কাউয়ার চরে। ডোওয়াবন ঘেষে জেলেদের কয়েকটি অস্থায়ী ছোনের ঘর ছাড়া কোন বসতি নেই।
২ কিলোমিটার পর শুধু ধুধু বালুচর। নীরব জনমানব শূন্য এই চরে রয়েছে। লাল কাকড়ার বসবাস। সূর্যের তাপ বৃদ্ধির পর্যায়ক্রমে লাখ লাখ কাকড়া গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে এক পর্যায়ে চরটি যেন লাল ফুলের কার্পেটে পরিণত হয়ে উঠে। স্থানীয়ভাবে কাউয়ার চরের কাকড়ার আবাস ভূমিকে লাল কাকড়ার দ্বীপ ও বলা হয়ে থাকে।
কাকড়ার দ্বীপ থেকে আমরা সোজা চলে আমি কুয়াকাটার রাখানই পল্লীর মিস্ত্রীপাড়ায়। ১৭৮৪ সালে রাখাইনরা তৎকালীন বার্মার আরাকান হতে পালিয়ে এসে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ৭নং লতা চাপালি ইউনিয়নে বসতি স্থাপন। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইনদের রয়েছে। নিজস্ব বৈচিত্রপূর্ণ সামাজিক জীবন ও ভাষা। রাখাইন মহিলাদের ব্যতিক্রমধর্মী পরিধেয় বস্ত্র ও পর্যকদের জন্য আর এক আকর্ষণ।
মিস্ত্রিপাড়ায় কথা হয় রাখাইনদের এক পরিবার প্রধান রাখেন এর সাথে। তিনি জানান, এখানে মাত্র ১৮টি পরিবার অবশিষ্ট রয়েছে। কালের বিবর্তণে রাখাইনদের সংখ্যা ক্রমে লুপ্ত হবার আশংকা রয়েছে। এই এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো অর্ধশত পরিবার রাখাইনদের ঘরে ঘরে রয়েছে তাঁতশিল্প। চরকিতে সুতা কেটে পরিবারের সবাই মিলে তৈরি করছে পরিধেয় বস্ত্র।
শীত মৌসুমে উলের সুতোয় তারা গায়ের রং-বেরঙের বাহারি চাঁদর, উলের জামার কাপড়, মাফলার ইত্যাদি তৈরি করতে দেখলাম। একটি জামার ২ গজের কাপড়ের মূল্য ৪০০ টাকায় বিক্রি করে চাঁদর ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। বাঁশের আসবাবও তৈরি করে রাখাইনরা। এখানের বৌদ্ধ মন্দিরের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ৩৬ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন সিমেন্টের তৈরি গৌতম বৌদ্ধের মুর্ত্তি। পুরানো এই বৌদ্ধমন্দির কুয়াকাটার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
মিস্ত্রীপাড়া থেকে ৭ কিলোমিটার কুয়াকাটার সদরে রয়েছে আরেকটি বৌদ্ধমন্দির। দৃষ্টিনন্দন মন্দিরের মধ্যে রয়েছে ৭ ফুট উঁচু আরেকটি সোনালী রঙের ধাতব বৌদ্ধ মুর্তি। মন্দিরের কাছেই রয়েছে প্রায় ২০০ বছরের পুরানো ২টি কুয়া। রাখাইনরা খাবার পানির চাহিদা মেটাতে এই কুয়া দু’টি খনন করে। জনশ্র“তি আছে এই কুয়া হতেই কুয়াকাটা নামের সৃষ্টি।
রাখাইন মহিলা সমিতির পরিচালনায় এখানে একটি মার্কেট চালু রয়েছে। পর্যটকরা এখান থেকে কুটিরশিল্প, তাঁত শিল্পের তৈরী নানান সামগ্রী ক্রয় করে থাকেন। এছাড়া এখানে রয়েছে রাখাইন সংস্কৃতিক কেন্দ্র যা গত ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন। পর্যটন কর্পোরেশনের হলিডে ইউথ হোমস ও নির্মাণ সম্পন্ন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধোধনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। কুয়াকাটার চৌরাস্তার থেকে সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে আরো কয়েকটি দর্শনীয় স্থান বা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে।
এর মধ্যে রয়েছে জেলেদের সুটকি পল্লী, লেবুর চর, সুন্দরবনের পূর্বাংশ ৩ নদীর মোহনা। দুপুর ১২ টার দিকে আবার যাত্রা শুরু হলো। লেবুর চরের সামনে সাগর মোহনায় মিলিত হয়েছে ৩টি নদী। সেখানে দাঁড়িয়ে মোহনার পশ্চিমপাড়ে রয়েছে ফাতরার চর। বাংলাদেশের আরেক অহংকার প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চার্য নির্বাচনে ফাইনাল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সুন্দরবনের শেষাংশ এই ফাতরার চরের বনভূমি।
লেবুর চর থেকে ফেরার পথে জেলেদের সুটকি পল্লীতে গেলাম। বোট ভাড়া করে ৫ কিলোমিটার পূর্বে গঙ্গামতির চর, ফাতবার চর, রূপার চর, সোনার চরাঞ্চল সুন্দরবনের কটকা ঘুরে দেখা যায়। আড়ৎ থেকে লটকি সুটকি ১৭০ টাকা, ইলিস ১৫০ টাকা কেজি দরে কিছু মাছ আমরা ক্রয় করলাম। দেড়টার দিকে কুয়াকাটার সমগ্র ১৮ কিলোমিটার সৈকত ভ্রমণ শেষে গাইড আনোয়ার হোসেনকে ছেড়ে দিলাম। তারপর বার্মিজ মার্কেট থেকে কিছু উপহার সামগ্রী কেনাকাটা করে আবার খুলনায় ফেরার প্রস্তুতি নিলাম।
আলমগীর মাস্টারের বাড়ি বিদায় নিতে গেলে আমাদের জন্য নিকট আত্মীয়ের মত পিঠা দিয়ে আপ্যায়িত করেন, যা মনে রাখারা মত। দক্ষিণ বাংলার সমুদ্র কন্যা কুয়াকাটা প্রকৃতির সাথে সমুদ্র কন্যা কুয়াকাটা প্রকৃতির সাথে একদিনের স্মৃতি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বল্প খরচে যে কেউ যেতে পারেন, শেরে বাংলার ধান-নদী-খাল-বরিশালের সমুদ্র কন্যা কুয়াকাটা আর প্রকৃতির কবি জীবনান্দ দাসের ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে। কুয়াকাটার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে পরিকল্পিতভাবে পর্যাটন নগরী গড়ে তোলা হলে এটিই হতে পারে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যাটন কেন্দ্র।
কোথায় থাকবেনঃ পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী কুয়াকাটার গড়ে উঠেছে সরকারী, বেসরকারী হোটেল-মোটেল।
স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের নিজ বাড়িতে ও পর্যটকদের রেখে বাড়তি আয় করে থাকেন।
অসংখ্য মানসম্মত খাবার হোটেলও আছে। এখানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন রয়েছে হলিডে হোমস, ইউথ হোমস , জেলা পরিষদ ডাকবাংলা, এলজিইডি’র সাইক্লোন সেন্টার কাম গেস্ট হাউজ, বায়োগ্যাস রেস্ট হাউজ ইত্যাদি। এছাড়া বেসরকারী উদ্যোগে স্কাইপ্যালেস, বনানী, কুয়াকাটা ইন, মোহনা, সি-ভিউ হোটেল, গোল্ডেন প্যালেস, সৈকত হোটেল, আখি হোটেল, সি-কুইন, ঘেরের বাড়ী হোটেল সান-রাইজ, কুয়াকাটা গেষ্টহাউজ, হোটেল সাগর ইত্যাদি। ১০০ টাকা থেকে ১২০০/- টাকা পর্যন্ত রুমের ভাড়া।
কিভাবে যাবেনঃ খুলনা থেকে সকাল ও সন্ধ্যা দু’টি বিআরটিসি’র বাস ছাড়ে কেডিএ নিউ মার্কেট থেকে। এছাড়া পশ্চিম রূপসা ফেরীঘাট থেকে ধানসিড়ি পরিবহনসহ একাধিক বাস ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশ্যে। বরিশাল থেকে সরাসরি কুয়াকাটার বাস সার্ভিস রয়েছে। ঢাকা থেকে সড়ক ও নদীপথে পটুয়াখালী যাওয়া যায় স্বল্প খরচে। তারপর কুয়াকাটা যাওয়ার নানাবিধ ব্যবস্থা।
খুলনা থেকে পিরোজপুর হয়ে কুয়াকাটার দুরত্ব ২২৮ কিলোমিটার আর ঢাকা হতে দৌলতদিয়া হয়ে দুরত্ব ২৮০ কিলোমিটার।
ঢাকার সায়দাবাদ ও গাবতলী থেকে বাস আর সদরঘাট থেকে লঞ্চ পাওয়া যাবে। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য যে কোন অবসরে কুয়াকাটায় বেড়িয়ে আসলে কক্সবাজার ভ্রমণের চেয়ে খারাপ লাগবে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।