মানুষ তার আশার সমান বড়...
সাগর এখনো ঢাকায় আছে। দিন তিনেক থাকবে। তারপর ফিরে যাবে চট্টগ্রামে। ও ঢাকায় এলে গুটিয়ে যায়। বলে, তোর শহরটা একটা মরা শহর।
যখন শহরে প্রবেশ করি তখন মনে হয় একটা কূফা জঞ্জাল শহরে প্রবেশ করলাম। দম বন্ধ হয়ে আসে। থাকিস কি করে এখানে? এক কাজ কর, অতীতে চলে আয়। ওখানে প্রচুর সবুজ বাতাস। তুই শ্বাস নিবি, তুই পথ হারাবি।
স্বপ্নময় দুহাত মাথার উপর দিয়ে রেলিং এ শুয়ে মেঘ দেখে। কিছু বলে না। বলার কিছু নেই।
ছোট ছোট কথার ফাঁকে সাগর হঠাৎ উদাসী হয়ে যায়। রেলিং এ পা ঝুলিয়ে মাথাটা একপাশে হেলে আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে-
--- ছোটবেলার সব কথা তোর মনে পড়ে?
--- উঃ সব না; কিছু কিছু মনে পড়ে।
তোকে মার দেবার ঘটনাগুলো খুব মনে পড়ে। স্বপ্নময় অলস হাসি হাসে।
--- আমার বাবার কথা তোর মনে আছে? কথাগুলো সে মিনমিনিয়ে বলে। খুব কষ্ট করে শুনা লাগে।
--- হঁ্যা, বাজারে তোদের একটা বড় দোকান ছিল।
বাজার উঠলে আমাকে সঙ্গে নিতি। তোর বাবা চার আনা'র লাল গোলগোল কিযেন খাওয়াতো। মিষ্টি-ই ছিল মনে হয়।
--- বেশ এটুকুই?
--- হুম; তবে আরও একটা ঘটনা মনে পড়ে। তোর বাবা একদিন ইয়া বড় ছোরা নিয়ে কাদের যেন মারতে যাচ্ছিল!
--- বাবাটা কিভাবে মারা গেলরে?
--- কি করে বলি? আমিও তো তখন ছোট ছিলাম।
কত বয়স হবে, বড়জোর 5।
--- তিনি বেঁচে থাকলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।
--- তা হয়তো।
--- তা হয়তো কিরে? এত কষ্ট কি করা লাগতো? লেখাপড়াটা করতে পারলাম না। টাকার জন্য ম্যাট্রিক পরীা দিতে পারলাম না দেখে মা'টা গুমড়ে কত কাঁদলো।
আজও আমি বুকের ভেতরের কষ্টটাকে বের করতে পারিনি। মাঝে মাঝে বুকটা খুব ভেঙ্গে যেতে চায়রে...।
স্বপ্নময় মাঝে মাঝে খুব আবেগী হয়ে যায়। যখন কাছাকাছির মানুষজন তাকে হতাশার গল্প শুনায় তখন তার কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে যেতে চায়। তার খুব খুব খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে।
কান্নারা দুচোখের ডগায় সংগ্রম শুরু করে দেয়। ও উঠে বসে। রেলিং এ পা ঝুলিয়ে সাগরের পাশে এসে বসে। কিছুন দুজন নিরব থাকে। সময় কাটে।
রাত গড়ায়। মেঘগুলো চাঁদটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে যায়। এলোমেলো বাতাস চারদিকে।
--- আমার বাবাটা বেঁচে আছেন, কি লাভ হয়েছে? আমার জীবনটা পাল্টে গেছে? তোর মনে আছে, সেসব দিনের কথা...? তিনি সেযে সকালে বের হতেন বাড়ী কবে ফিরবেন তা কেউ বলতে পারতো না। মাঝে মাঝে মাসও কাবার হয়ে যেত; তারপরও তিনি আসতেন না।
একের পর এক জমি বিক্রি করলেন। টাকা উড়ালেন। ভাইয়াটা সারা জীবন কষ্টই করে গেল। পড়ালেখাটা বিসর্জন দিলো। আমার খুব মনে পড়ে সেসব দিনের কথা।
বাবার প্রতি কখনোই কোন টান ছিলনা। তার আদর পাইনি কোনোদিন... অথচ তিনিই নাকি আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
--- হু, মনে পড়ে। তোদের সাথে আমিও কতদিন বসে ছিলাম কাঠের ছোট সাঁকোটাতে।
--- ভাইয়া কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরতো।
আমি আর ছোটো... দুই ভাই/বোন সাঁকোটায় সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বসে থাকতাম। বাবার বাড়ী ফেরার প্রতীায় নয়; ভাইয়া'র আদর পাবার প্রতীায়। কখনো কখনো সে তাড়াতাড়ি আসতো, কখনো কখনো খুব দেরী করে। বিষন্ন মন নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতাম। ঘুমিয়ে যেতাম।
বাড়ী ফিরে ভাইয়া আমাদের ঘুম ভাঙ্গাতেন। দুইজনকে দুপাশে বসিয়ে ভাত মাখিয়ে খাওয়াতেন। সেসব ভেবে আমার কখনো কান্না পায়নারে... স্বপ্নময় আর কথা বলতে পারেনা। প্রাণপন চেষ্টা করে নিজেকে সামলানোর। পারেনা।
অপলক চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে। কষ্টরা টপটপ করে শব্দহীন ঝরে পড়ে। দুয়েক ফোটা। স্বপ্নময় বেশি কাঁদতে পারেনা।
অনেকখন পর সাগর মুখ খুলে--- একটা সমস্যায় আছিরে।
নিজের টেনশনেই বাঁচিনা...।
--- তোর আবার টেনশনও আছে? চোখ চকচক করে স্বপ্নময়ের।
--- তা আর বলছি কি, বাড়ীওয়ালার মেয়েটা আছে না; সে তো গলেই গেল! তিনটা চিঠি দিয়েছে।
--- চিঠি 3 টা সাথে এনেছিস, না?
--- সাগর উপর নিচ মাথা নাড়ায়।
--- স্বভাবটা তোর এখনো গেলনা।
তোর শহুরে বিশ্ব সুন্দরী মেয়েটি ছুটে গেল নাতো?
--- যাকগে, ঐটাকে আলগাতে পারতাম না। তাই ঢিল দিয়েছি।
--- নিজেকে এত ছোট ভাবিস কেন?
--- তবে কি আর ভাববো? ছোটোই তো। এত কষ্ট করছি... তারপর কিছুই করতে পারছি না।
--- পারবি, পারবি।
একটু কষ্ট হবে। একসময় দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
--- সান্তনা দিচ্ছিস?
--- উহু; গাছ হতে বলছি। লতা-গুল্ম'র স্বপ্ন আর দেখিস না।
সাগর চলে যাবে... যাক।
যতদিন সে থাকবে, ততদিন অতীত হামলা করবে। অতীতহীন শহুরে জীবনে হতাশা, ব্যর্থতা আর বিস্বাদ নিয়েও কেমন করে স্বপ্নময়ের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে...! উদভ্রান্তের মত সে টিকে আছে। বেঁচে আছে। নিজের কষ্টগুলো মাঝে মাঝে খুব মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। টিকে থাকতে চায়।
সে আমল দেয়না। মানুষের সুখ দুঃখে'র কেচ্চা-কাহিনী শুনে সে নির্ভার থাকে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার প্রতিটি দিন, একই রঙে...।
--(অমানুষ-3)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।