আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ হিটলারকে হত্যাচেষ্টা(২.১)

Youth cannot know how age thinks and feels. But old men are guilty if they forget what it was to be young. ১৯৩৩ সালে, হিটলার নির্বাচনে জয়ী হয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন। এভাবে জার্মানিতে নাৎসি যুগ শুরু হয়। চ্যান্সেলর হওয়ার পর প্রথম কয়েক বছর হিটলারের জনপ্রিয়তা কম ছিল। দেশের অনেক মানুষ একনায়কতন্ত্রের সফলতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। পার্শ্ববর্তী দেশের প্রতি হিটলারের আক্রমণাত্মক মনোভাবও অনেকের পছন্দ হয়নি।

তবে কয়েক বছরের মধ্যে হিটলার জার্মানিকে পুনরায় বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। জার্মান জাতির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনেন। হিটলার তার দেশের মানুষকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি দেশ থেকে বেকারত্ব দূর করবেন। বাস্তবে তিনি তা করে দেখিয়েছিলেন, এই কারণে অসংখ্য মানুষ পরে তার অনুরাগী হয়। হিটলার ভালবেসে তার শাসনামলকে the third reich বলে ডাকতেন।

reich শব্দের অর্থ হল রাজত্ব। the first reich আনুমানিক ১০০০ বছর স্থায়ী ছিল। the second reich স্থায়ী ছিল ৫০ বছর। হিটলার গর্ব করে বলতেন যে তার third reich ১০০০ বছর শাসন করবে। কিন্তু বাস্তবে the third reich শাসন করেছিল ১২ বছর।

চ্যান্সেলর হবার পর, হিটলারকে হত্যাচেষ্টা, আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। শুরুতে জার্মান এলিট পুলিশ the gestapo প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটি করে হত্যার হুমকি পেত( চ্যান্সেলর হবার কয়েক বছর পর এমন ঘটনা কমে যেতে শুরু করে)। কিন্তু অধিকাংশ হুমকিই ছিল ভুয়া। এসব তথাকথিত আনাড়ি আততায়ী gestapo কে ফোনের মাধ্যমে অথবা চিঠি দিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা বলত। অনেকেই আবার অর্থের জন্যে ব্ল্যাকমেইল করত।

বিস্ফোরক fountain pen, বিষাক্ত ফুলের তোড়া, বিষাক্ত স্প্রে, এসবের কথা বলে হুমকি প্রদান করা হত। অধিকাংশই ভুয়া হলেও, কিছু কিছু হুমকির ক্ষেত্রে গেসটাপোকে বিশেষ তদন্ত করতে হত। হত্যাচেষ্টাঃ চ্যান্সেলর হবার পরে ১) ২১শে মার্চ, ১৯৩৩। পটস্‌ডাম শহর, গারনিসন-কির্‌শ্‌(garnisonkirche), জার্মানি। পটস্‌ডাম শহরে প্রতি বছর পটস্‌ডাম দিবস পালন করা হয়।

১৯৩৩ সালে, হিটলার, পটস্‌ডাম দিবসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে, বক্তৃতা দেওয়ার আগের দিন, পুরো এলাকা শেষবারের মত দেখে নেওয়ার সময় সিকিউরিটির লোকজন মাটির নিচে একটি রহস্যজনক সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে। সুরঙ্গটি একেবারে বক্তৃতা দেওয়ার স্থানে গিয়ে শেষ হয়েছে। যারা সুড়ঙ্গটি খুরেছে তাদের গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কয়েকজন সেই সুড়ঙ্গে বোমা পুঁতে রাখার এবং পরের দিন হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে।

২) ১৯৩৩ সাল। ওবার-স্যাল্‌জ-বার্গ(obersalzberg), বার্গহফ এলাকা, বাভারিয়ান আল্পস্‌। হিটলারের অবশরকালীন নিবাস ছিল বাভারিয়ার বার্গহফ এলাকায়। পাহাড়ের চুড়ায় যে বিশাল ম্যানশানে তিনি থাকতেন, তার নাম হল বারচেস-গারডেন। পাহাড়ের চারপাশে বিস্তীর্ণ মনোরম মাঠ ছিল।

হিটলার প্রায়ই মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হাটতেন। তার সঙ্গে সে সময় তার বন্ধুবান্ধবরা থাকত। আর থাকতো দু তিনজন সিকিউরিটির লোক। এরা কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশে দৃষ্টি রাখতেন। মাঠের পাশে রাস্তাটির সমস্যা একটাই, এটি ছিল জনগণের সম্পত্তি।

যে কেউ এতে চলাচল করতে পারত। অনেক সময়, হিটলারের সাথে সাধারণ মানুষের দেখা হয়ে যেত। তারা তখন কুশল বিনিময় করতেন। একবার এক লোক, সিকিউরিটির মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। সিকিউরিটির লোকজন, সেই লোককে কয়েকদিন ধরে, হিটলারের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখে।

এতে তাদের সন্দেহ হয়। তারা লোকটিকে আটক করে এবং তল্লাশির পর তার কাছে একটি ম্যাগাজিন ভর্তি রিভলবার পায়। লোকটিকে পরে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩) ১৯৩৩ শাল। ওবার-স্যাল্‌জ-বার্গ(obersalzberg) আর রসেন-হেইম শহরের মধ্যবর্তী রাস্তায়।

হিটলার রসেন-হেইম নামক এলাকা থেকে গাড়িতে করে তার অবশরকালীন বাড়ি বারচেস-গারডেনে ফিরছিলেন। পথে তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। কেউ হতাহত হয়নি। ৪) ১৯৩৪ সাল। মিউনিখ আর ব্যাড-উইস্‌(bad-wiesee) শহরের মধ্যবর্তী রাস্তা।

১৯৩৪ সালে হিটলার তার বডিগার্ড বাহিনী the S.A(storm abteilung or the storm troopers) ভেঙে দেন। S.A এর নেতা ছিলেন হিটলারের বন্ধু এর্‌ন্‌ষ্ট রম(Ernst rohm)। রম ছিলেন একজন উচ্চ পর্যায়ের নাৎসি। যোগ্যতা বলেই তিনি s.a এর কমান্ডার হতে পেরেছিলেন। ১৯৩৪ সালের দিকে দেখা যায় যে এককালের ছোট সংস্থা S.A আর ছোট নেই।

এর সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী হয়ে গেছে। হিটলারের কাছে গোপন খবর আসতে থাকে যে, রম, তার S.A কে জার্মান আর্মির স্থলাভিষিক্ত করতে চান। এই কারণে মূল জার্মান আর্মি, S.A কে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখত। তারা হিটলারকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু করার জন্যে অনুরোধ করে। হিটলারের কাছে আর্মি এবং অন্যান্য উৎস থেকে এরকম খবর(গুজব?) আসতে থাকে, যে ernst rohm গোপনে গোপনে হিটলারকে হত্যা করে নিজে রাজা হবার পরিকল্পনা করছেন।

এই খবর শুনে হিটলার সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন হন। এই কারণে হিটলার তার শত্রুদের দমন করার জন্যে একটি গোপন নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ অনুযায়ী S.A এর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে Ernst Rohm সহ কয়েক শত সন্দেহভাজন S.A নেতাকে, ৩০শে জুন ১৯৩৪, থেকে ২ জুলাই, ১৯৩৪ এর মধ্যে গ্রেপ্তার করে হত্যা করা হয়। রাতের আঁধারে হত্যাকাণ্ড চালানো হয় বলে এই ঘটনাটিকে বলে The night of the long knives. অবশ্য এটা কোনদিনও জানা যাবে না যে আসলেই বিদ্রোহের গুজবগুলো সত্যি ছিল কিনা। কারণ সন্দেহভাজন সবাইকে মেরে ফেলা হয়।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এরপরে S.A ভেঙে দেওয়া হয় এবং আরেক বডিগার্ড শাখা, The S.S, হিটলারের বডিগার্ড আর্মি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এখন মুল কাহিনী হচ্ছে Ernst Rohm কে গ্রেপ্তার করার সময় হিটলার স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। সকল বন্দীদের স্তাদেলহেইম(Stadelheim) নামক একটি বড় কারাগারে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে হত্যা করার জন্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সকল কাজ সম্পন্ন হলে হিটলার সন্তুষ্টচিত্তে এক গ্রুপ S.S বডিগার্ড নিয়ে মিউনিখে নিজের অস্থায়ী বাসভবনে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হন।

কিন্তু যাওয়ার শুরুতেই ঝামেলা বাঁধে। নিজের গাড়িতে উঠার সময় একটি ট্রাক ভর্তি S.A সৈন্যদল, হিটলারের দলের পথরোধ করে দাড়ায়। S.A সৈন্যগুলো ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। S.A এর কয়েক শত নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর এই খবর শুনেই তারা ছুটে আসে। তাদের আক্রমণাত্মক মানসিকতা প্রকৃত অর্থেই হিটলারের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল।

কিন্তু চালাক হিটলার এবারো তার বাগ্মিতার কারণে বেঁচে যান। তিনি S.A সৈন্যদের বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনিই জার্মানির অবিসংবাদিত নেতা। এবং তার কথাই আইন। দেশের উন্নতির জন্যে অবশ্যই বিশ্বাসঘাতকদের শায়েস্তা করতে হবে। তিনি এভাবে S.A সৈনিকদের, মিউনিখে, তাদের সেনা ছাউনিতে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন।

এরপর তিনি নিজে গাড়িতে করে মিউনিখের পথ ধরেন। কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ নয়। যে ট্রাক ভর্তি S.A সৈনিকেরা হিটলারের কথা শুনে মিউনিখে ফিরে যাচ্ছিল, মাঝপথে এসে তারা তাদের মত পাল্টালো। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে তারা হিটলারকে হত্যা করবে। এই কারণে তারা মিউনিখগামী মহাসড়কের পাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ওঁত পেতে বসে থাকে হিটলারের গাড়িকে অ্যাম্বুশ করার জন্যে।

তারা তাদের ট্রাকটিকে কোনক্রমে লুকিয়ে রাখে। তাদের কাছে ভারী মেশিনগান ছিল। হিটলারকে হত্যা করার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে তারা লুকিয়ে বসে থাকে। কিন্তু হিটলার ছিলেন তাদের চেয়ে ১০০ গুন বেশী চালাক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই সৈনিকেরা খুবই কট্টরপন্থী।

এরা মত পালটিয়ে পুনরায় তাদের বিপদে ফেলতে পারে। এই কারণে তিনি তার ড্রাইভারকে আদেশ দেন মহাসড়ক দিয়ে না গিয়ে বিকল্প গ্রাম্য পথে মিউনিখ যেতে। এভাবে হিটলার নিজ বুদ্ধিবলে বিকল্প পথ ধরার কারণে, এই যাত্রাতেও বেঁচে যান। পরবর্তীতে S.A এর এই কট্টরপন্থী দলকে খুজে বের করা হয় এবং হত্যা করা হয়। সেদিন যদি হিটলার মহাসড়ক দিয়ে যেতেন তবে তিনি নির্ঘাত মারা পড়তেন।

the night of the long knives হত্যাকাণ্ড, একদিকে যেমন জার্মানির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে হিটলারের অবস্থান পাকাপোক্ত করে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এর ফলে এমন মানুষের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় যারা তার মৃত্যু কামনা করত। ৫) ১৯৩৫ সাল। বারচেস-গার্ডেন(হিটলারের অবসরকালীন নিবাস), বের্গহফ, বাভারিয়া। একজন প্রাক্তন S.A কর্মকর্তা হিটলারকে হত্যা করার সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলেন। একবার তিনি হিটলারের সাথে সাক্ষাতের জন্যে তার অবসরকালীন বাড়ি বারচেস-গারডেন এ যান।

হিটলার বাড়ির বারান্দায় অবস্থান করছিলেন। তখন তিনি দূর থেকে তার পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তিনি মাত্র একটি গুলিই করতে পেরেছিলেন। কারন এরপরেই অস্ত্রধারী গার্ড এসে পরপর ৫টি গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।

এই হত্যা চেষ্টার পিছনে কারন হিসেবে অনেকেই the night of the long knives কেই দায়ী করে থাকেন। ৬) ১৯৩৫ সাল। বারচেস-গার্ডেন(হিটলারের অবসরকালীন নিবাস), বের্গহফ, বাভারিয়া। এবারের ঘটনা আরেকজন S.A কর্মকর্তাকে নিয়ে। উনার নাম Heinrich Grunow. অনেক প্রাক্তন S.A এর মত তিনিও S.A নেতাদের হত্যার ঘটনা হজম করতে পারেননি।

এই কারণে তিনি হিটলারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। হিটলার তখন অবসর যাপনের জন্যে বারচেস-গারডেনে অবস্থান করছিলেন। তিনি খেয়াল করে দেখেন যে, হিটলার যখন কোন জায়গা সফর থেকে বারচেস-গারডেনে ফেরত যান, তখন তার গাড়িকে একটি রাস্তার মোড়ে এসে বাঁক নিতে হয়। তিনি হিসেব করে দেখেন যে, বাঁক নেওয়ার সময় প্রতিবার গাড়ির গতি ১৫kmph এর নিচে নামিয়ে আনতে হয়। এই গতিতে থাকাকালে, কাছ থেকে দাড়িয়ে, গাড়ির ভিতরে হিটলারকে গুলি করা একেবারে দুধভাত।

পরিকল্পনামাফিক grunow নির্ধারিত দিনে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। যথাসময়ে তিনি দূর থেকে হিটলারের গাড়িকে আসতে দেখেন। যখনই গাড়ি মোড় ঘুরতে শুরু করে, তখনই তিনি ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটিকে(সাধারনত ওখানে হিটলার বসেন) উদ্দেশ্য করে গুলি করে বসেন। কিন্তু অকল্পনীয় ব্যাপার হচ্ছে, হিটলার সেদিন নিজে ড্রাইভ করছিলেন। তার ড্রাইভার তার পাশে বসা ছিল।

Grunow সেটা জানতেন না। আর দূর থেকে তিনি বুঝতেও পারেননি যে পাশে বসা লোকটি হিটলার নন। গুলি করার পর, Grunow, হিটলারকে হত্যা করেছেন ভেবে উল্লাসে লাফ দিয়ে উঠেন। এবং পরমুহূর্তেই আত্মহত্যা করেন। এটি অবশ্য তার পূর্ব পরিকল্পনারই অংশ ছিল।

অলৌকিকভাবে এবারো হিটলার বেঁচে যান। এই ঘটনায় তার ড্রাইভার মৃত্যুবরণ করেন। (চলবে) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখাগুলোর লিঙ্কস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.