আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হারিয়ে গেছে যেনো প্রিয়জনকে লেখা চিঠির সেই যুগ

A National Weekly Newspaper ‘‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে/রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে,/রানার চলেছে রানার!’’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার রানারের দেখা মেলে না প্রযুক্তির এ যুগে। কবি মহাদেব সাহা’র ‘চিঠি দিও’ কবিতার মতো এখন কেউ তার প্রেমিকাকে বলে না ‘‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও/আঙ্গুলের মিহিন সেলাই/ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো/অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি। ’’ runner-asche-হারিয়ে গেছে চিঠি! হারিয়ে গেছে প্রিয়জনকে লেখা কাগজে লেখার সেই যুগ। ডাক বিভাগেরও এখন সেই ব্যস্ততা নেই। সাইকেলের বেল বাজিয়ে ডাক পিয়নের ‘চিঠি এসেছে...চিঠি...’ এমন কথাও আর শোনা যায় না।

এখন আর সেই আগেকার দিনের মতো পিয়নের পানে চেয়ে থাকতে হয় না প্রিয়জনদের। চিঠি শূন্য এখন ডাকঘর। প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় এখন আর চিঠির প্রচলন নেই বললেই চলে। ‘চিঠি লিখলাম ও লিখলাম তোমাকে পরে জবাব দিয়োগো আমাকে। ’ বাংলা সিনেমার এ গানের মতো কোনো প্রেমিকও প্রেমিকার চিঠির অপেক্ষায় থাকে না।

অথচ এক সময় ডাকপিয়নের চিঠিই ছিল যোগাযোগের একমাত্র উপায়। প্রযুক্তির ছোঁয়া আজ শহর ছেড়ে অজপাড়া গাঁয়েও পৌঁছে গেছে। তাই এসএমএস, মেইল আর ফেসবুকে চ্যাটই প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। পরিবারের কেউ দেশের বাইরে কিংবা অন্য কোথাও অবস্থান করলে তার খোঁজ নেওয়া হতো চিঠির মাধ্যমে । তাকে বাড়ির খোঁজ দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল এই চিঠি লিখন পদ্ধতি।

তখন মোবাইলের মতো দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না বলে সবার কাছে জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল চিঠি। তাছাড়া প্রেমিক-প্রেমিকা, ভাই-বোন ও বোনকে-ভাই, মা-ছেলেকে, বাবা-ছেলেকে, ছেলে-বাবা মাকে নিজের অবস্থান জানাতে চিঠি লিখতেন। এখন বিদেশে যোগাযোগ করলে স্কাইপি কিংবা ফেসবুক ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে সরাসরি দেখা হচ্ছে। প্রযুক্তি যোগাযোগ আরও সহজ করলেও চিঠিতে এক ধরনের আবেগ খুঁজে পান অনেকেই। কাগজে লেখা সে চিঠির ভাষা আর কম্পিউটারের কি-বোর্ড কিংবা সেলফোনের কি-প্যাডে লেখার মধ্যে সে আবেগ কাজ করে না।

কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন মনে করেন, প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে। প্রযুক্তির তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু চিঠির রয়েছে স্থায়িত্ব। এখানে আবেগও কাজ করে। ই-মেইলে মানুষের মানবিক জায়গাটা ধরা যায় না।

তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেট প্রয়োজনীয়। এটা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করেছে। ’’ তবে চিঠির আনন্দ কোনভাবেই প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয় বলে এ কথাসাহিত্যিক মনে করেন। ফেনী সদর উপজেলার নতুন রাণীর হাটের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আনিসুর রহমান ভুঁইয়া বলেন, ‘‘পোস্ট অফিসের পিয়ন কতদিন ধরে যে দরজায় এসে কড়া নাড়ে না। বলে না, আপনার একটি চিঠি এসেছে।

’’ কাগজে চিঠি লিখতে বসলে অনেক সুখ-দুঃখের কথা চলে আসে। ই-মেইলে যেন সেই সুখ-দুঃখটা ধরা দেয় না। চিঠিতে প্রিয়জনকে বহুগুণে আকৃষ্ট করতে হাতের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে লেখা থাকত কত না স্মৃতিমাখা বেদনার ছন্দ কথা। ই-মেইলে সে সব ছন্দ কথা ধরা দেয় না। চিঠিতে শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্টিকতাই নয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও চিঠির ভূমিকা ছিল।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবন, প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ সব কিছুতেই যোগাযোগের একমাত্র উপায়ই ছিল চিঠির ব্যবহার। বিভিন্ন দেশের মনীষী ও রাজনীতিবিদদের কাছে লেখা চিঠি দিয়ে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। নানা বৈচিত্রে ছিল চিঠি লেখায়। কিছু প্রচলিত নিয়ম থাকতো চিঠিতে। যেমন চিঠির শুরুতেই থাকতো ‘এলাহী ভরসা’ কিংবা ‘৭৮৬’।

৭৮৬ দিয়ে মুসলমান ‘বিসমিল্লাহির রাহ মানির রাহিম’ বুঝাতো। চিঠি লেখার ভেতরেও কিছু শব্দ থাকতো। গুরুজনদের কাছে চিঠি লেখার সময় ‘শত কোটি সালাম’ লেখাটিও ছিল বেশ জনপ্রিয়। চিঠিতে সম্বোধনের পরে ‘পর সমাচার এই যে’ এই বলেও চিঠি লিখতেন অনেকে। প্রিয়জনের কাছে চিঠি লেখার জন্য থাকতো রং বেরংয়ের প্যাড।

এসব বাহারি প্যাড পাওয়া যেত স্টেশনারি দোকানে। প্রিয়জনকে চিঠি লেখার ভাষাও ছিল অন্যরকম। ভালবাসার মানুষের কাছে চিঠি লিখবার সম্বোধনগুলো ছিল বেশ চমকপ্রদ। ‘প্রিয়তমা’ ‘মনের রানী’ দিয়ে অনেকেই শুরু করতেন চিঠি লেখা। চিঠির শেষে লেখা হতো ‘এবার ৮০’, ‘ইতি তোমারই...’ বাংলাদেশ ডাকবিভাগ থেকে জানাগেছে, বাংলাদেশে রানার বা ডাকপিয়নদের আবির্ভাব ১২০৬ থেকে ১২১০ সালের মধ্যে।

তখন দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক। আরবদের অনুকরণে দিল্লি থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত এক ধরনের ডাক ব্যবস্থা চালু করেন তিনি। রানাররা তখন পরিচিত ছিলেন ধাওয়া হিসেবে। ১২৯৬ সালে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী পথচারী মানুষের সাহায্যে ডাক সার্ভিস চালু করেন। এরপর ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ সালে মোহাম্মদ বিন তুগলকের শাসনামলেও ঘোড়ার সাহায্যে বহনকারী ডাক এবং পায়ে হেঁটে সাধারণ ডাকের ব্যবস্থা ছিল।

মোঘল শাসনের সময় রানারদের নতুন পরিচয় হয় ডাক হরকরা। ডাক প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তরের কর্মী ছিলেন এরা। ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় কলকাতায় জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়। তখন বাংলাদেশের ভেতরে ডাক আনা নেওয়ার জন্য তখন ৪১৭ জন ডাক হরকরা বা রানার ছিলেন। খাম ও ডাকটিকিট বিক্রি বিগত ১০ বছরে ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে।

বর্তমানে ডাক বিভাগের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত বৈদেশিক শাখার পার্সেল প্রেরণ। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় ৫০টি মাঠ পর্যায়ের ডাকঘর চালুর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল ডাক বিভাগ। আর ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই একইসঙ্গে মুজিবনগর সচিবালয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন এবং লন্ডনের হাউজ অব কমন্সে বিশেষ ধরনের আটটি স্ট্যাম্প চালু করা হয়। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তদানীন্তন ইস্টার্ণ সার্কেলের পোস্ট মাস্টার জেনারেল এ এম আহসানউল্লাহকে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে দেশে ডাকঘরের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৪০১টি।

তবে বেশিরভাগ ডাকঘরই চিঠি শূন্য। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.