আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেনেশুনে বিষ করেছি পান

বসে আছি পথ চেয়ে.... ভেজাল অনেক পুরনো ইস্যু। যুগ যুগ ধরে তা চলছে। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে এ প্রসঙ্গে পরশুরাম লিখেছিলেন, নন্দ গোয়ালা দুধে খুব জল দিচ্ছে। আপত্তি জানালে আকাশ থেকে পড়ে উত্তর দিলে, বলেন কি বাবু, আপনি পুরনো খদ্দের, আপনাকে কি ঠকাতে পারি? পাপ হবে যে। বললাম, দেখ নন্দ, দুধে অল্প-স্বল্প জল থাকলে আমি কিছুই বলি না, কিন্তু এখন বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

তোমার সঙ্গে আমার বহুকালের সম্পর্ক। সত্যি কথা বলে ফেল। নন্দ লোকটি সজ্জন। মাথা চুলকে বললে, আজ্ঞে সেরপিছু মোটে আধ পো জল দিই, পরিষ্কার কলের জল। আমার কাছে তঞ্চকতা পাবেন না।

-নন্দ আর একটু সত্যি করে বল। -আজ্ঞে এক পোর বেশি জল কোন দিন দিই না, আমার এই গলার কণ্ঠের দিব্যি। এবারে বোধ হল নন্দ সত্য কথা বলেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, একেবারে খাঁটি দুধ কি দরে দিতে পার? -আজ্ঞে টাকায় তিন পো দিতে পারি। -বরাবর খাঁটি দেবে তো? হাত সুড়সুড় করবে না? -তা কি বলা যায় হুজুর? মাঝে মাঝে একটু জল না দিলে চলবে কেন, গরিব লোক।

-আচ্ছা, সরকার যদি আইন করে দেয় যে দুধের দাম যত খুশি বাড়াতে পার কিন্তু জল একদম দিতে পাবে না, দিলে মোটা জরিমানা বা জেল হবে, তাহলে কি করবে? -তাহলে তো ভালই হবে বাবু। টাকায় আধসের বেচব, আমাদের লাভ বাড়বে। -কিন্তু নামজাদা ডেয়ারির খাঁটি দুধ তো টাকায় এক সের পাওয়া যায়। অবজ্ঞার হাসি হেসে নন্দ বললে, খাঁটি কোথায়, মোষের দুধে জল মিশিয়ে দেয়। -আচ্ছা, টাকায় আধসের হলে তুমি আর জল মেশাবে না তো? নন্দ ঘাড় নীচু করে হাসতে লাগল।

-মনের কথা বলে ফেল নন্দ। তবে বলি শুনুন বাবু। সুবিধে মতন জল দিতেই হবে; এ হল ব্যবসার দস্তুর। আবার ইনস্পেকটারকে খাওয়াতে হবে। মাঝে মাঝে জরিমানাও দিতে হবে।

ছা-পোষা গরিব মানুষ, এসব খরচ যোগাতে হবে তো! এইবারে ব্যাপারটি বোধগম্য হল। ব্যবসার দস্তুর অনুসারে গোয়ালা সনাতন প্রথায় যথাসম্ভব জল দেবেই। যতই ইনস্পেকটার থাকুক, শহরের সমস্ত দুধ পরীক্ষা করা অসাধ্য। অবশ্য মাঝে মাঝে ভেজাল ধরা পড়বে, তখন ইনস্পেকটারকে খুশি করতে হবে। অতএব এসব সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণের জন্য আরও জল দিতে হবে।

দাম বাড়ালে বা আইন করলে বা অনেক ইনস্পেকটার রাখলেও সর্বদা নির্জল দুধ মিলবে না। কয়েকজন ভাগ্যবান যারা নিজের চোখের সামনে দুইয়ে নিতে পারেন তাঁদের কথা আলাদা। প্রায় সত্তর বছর আগে সুলেখক পরশুরাম উল্লিখিত মন্তব্য করেছিলেন। গত সত্তর বছরে আমাদের সমাজ অনেক এগিয়েছে। ভেজালের পরিমাপ ও মাত্রাও বর্তমানে অনেক বেড়েছে।

পরশুরামের সময় দুধে পানি, আটায় ভুষি, ঘিতে তেল জাতীয় জিনিস মেশানো হতো, তাও সামান্য। কিন্তু এখন পণ্য-নির্বিশেষে ভেজাল দেওয়া হয়। ভেজাল-শিল্পে এতটাই উন্নতি হয়েছে, এখন আর ঘিয়ে তেল মেশানো হয় না। এখন পশুর চর্বির সঙ্গে এসেন্স ও রং দিয়ে রীতিমতো ঘি প্রস্তুত করা হয়। এ ঘি রং এবং গন্ধে আসল ঘির চেয়েও খাঁটি! কেবল স্বাদ এবং গুণাগুণ ভিন্ন- এই যা।

গুণে আর কি আসে যায় বলুন? মাছ জল খাবে, পুলিশ ঘুষ খাবে, মন্ত্রী-আমলারা দুর্নীতি করবে, উৎপাদক ও বিক্রেতারা বিভিন্ন জিনিসে ভেজাল দেবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এ নিয়ে হৈচৈ করার কোনো মানে নেই। আমাদের সমাজে ভেজাল যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। ভেজালের বিষয়টি সচেতন ব্যক্তিরা জানলেও এ নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামাতেন না। খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথও এ ধরনের ভেজালের শিকার হয়েছিলেন।

বিষাক্ত খাদ্য ও পানীয় পানে তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এই অনিবার্যতা স্বীকার করে নিয়ে তিনি গানও বেঁধেছিলেন- ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান। ’ আসলে বিষাক্ত ভেজাল খাদ্য ও পানীয়ের হাত থেকে আমাদের রেহাই নেই। আমাদের জেনেশুনেই বিষপান এবং আহার করতে হবে। বিষপান করে যেতে হবে।

এর কোন বিকল্প নেই। এর হাত থেকে পরিত্রাণের কোন পথও নেই। আর যা অনিবার্য তা মেনে নেয়াই ভাল। তাতে শান্তি-স্বস্তি দুই-ই বাড়বে। * * * * * আমাদের দেশে ভেজাল বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এখানে খাদ্যে ভেজাল, পানিতে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, শাক-সবজিতে ভেজাল, ফলমূলে ভেজাল, মদে ভেজাল, সম্পর্কে ভেজাল, দাম্পত্যে ভেজাল, বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল, আইনে ভেজাল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ভেজাল, সংবিধানে ভেজাল, সংবিধানের ব্যাখ্যায় ভেজাল, ধর্মে ভেজাল, প্রতিশ্রুতিতে ভেজাল, কথায় ভেজাল, দলে ভেজাল, জোটে ভেজাল, ভোটে ভেজাল, গণতন্ত্রে ভেজাল- সবখানে ভেজালের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। ভেজালের সর্বগ্রাসী বিস্তারে মানুষগুলোও ভেজাল মানুষে পরিণত হয়েছে কি না এ বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তবে অন্যসব ভেজালকে ছাপিয়ে বর্তমানে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ও খাদ্যে ভেজালের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে ধারাবাহিক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কোন সামগ্রীতে কি ভেজাল দেয়া হচ্ছে, কি পরিমাণে এবং কীভাবে এ ভেজাল দেয়া হচ্ছে এ ভেজালের প্রভাব কীÑ এসবের বিশদ বিবরণ থাকছে উল্লি¬খিত প্রতিবেদনে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এসব প্রতিবেদনের তথ্য যদি ঠিক হয়, তাহলে বাঙালির হজমশক্তি ও পেটের প্রশংসাই করতে হবে। কারণ আমরা প্রতিদিন যেসব জিনিস খাচ্ছি তার কোনো কিছুই খাঁটি নয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এসব পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল হিসেবে যা মেশানো হচ্ছে তা বিষেরই নামান্তর। মাছে বিষ, ডালে বিষ, চালে বিষ, তেলে বিষ, ঘিতে বিষ, মসলায় বিষ, শাক-সবজি-ফলমূলে বিষ, মাংসে বিষ, ডিমে বিষ, জেলি-সস-জুসে বিষ, পাউরুটি, বিস্কিট, দই-মিষ্টিতে বিষ, ফাস্টফুডে বিষ, চাইনিজে বিষÑ সব কিছুতেই বিষ। বিষাক্ত সব উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে।

বিষাক্ত রং মাখিয়ে বিভিন্ন পণ্যকে আকর্ষণীয় ও পচনের হাত থেকে রক্ষা করা হচ্ছে। বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে ফলফলারি পাকানো হচ্ছে। শাক-সবজি উৎপাদনেও ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক। পচন থেকে রক্ষা এবং রং আকর্ষণীয় করতেও ফল-এবং সবজিতে বিষাক্ত সব উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের খাদ্যে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতেও বিষ (আর্সেনিক)।

তারপরও কিন্তু আমরা দিব্যি বেঁচে আছি। আমাদের দেশের জনসংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। তবে কি বিষেও ভেজাল ঢুকেছে? এত এত ফরমালিন-কার্বাইড, নাম না জানা আরও কত রাসায়নিক-কীটনাশক, সব কিছু হজম করে আমরা দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, পরনিন্দা-পরচর্চা চালিয়ে যাচ্ছি, আয়ুও বাড়ছে, তা কীভাবে সম্ভব? নাক-মুখ দিয়ে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণের পরও আমরা কীভাবে বেঁচে আছি, টিকে আছি? বর্তমানে সব কিছুতে যেভাবে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে বিষেও ভেজাল ঢুকে পড়াটা বিচিত্র নয়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের পেটের অপরিসীম সহ্যশক্তিকে খাটো করে দেখা যাবে না।

একটু একটু করে বিষ খেতে খেতে আমরা বিষও হজম করে ফেলছি। বিষ এখন আমাদের শরীরে পুষ্টি যোগাচ্ছে। তা না হলে প্রতিদিন প্রত্যেক পরিবারে অন্তত একটি করে শবযাত্রার আয়োজন থাকত। তা যেহেতু হচ্ছে না, কাজেই ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যদ্রব্যে বিষ নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। আমরা নিশ্চিন্ত মনে মনের আনন্দে সব কিছু খেতে পারি আর হেরে গলা ছেড়ে দিয়ে সমস্বরে রবি ঠাকুরের গান গাইতে পারি-আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান...।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.