খুব ছোটবেলায় যখন নানাবাড়ি থাকতাম, নানার গরু-ছাগলের পাশাপাশি মুরগীগুলো ছিল আমার খেলার সাথী। এমন কি আম্মার কাছে পাঠানোর জন্য ছবি তোলার সময় স্টুডিওতে মুরগীও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর আমি কোলে মুরগী নিয়ে ছবি তুলেছিলাম। (ছবিটা অবশ্য আগেও দিয়েছিলাম একটা পোস্টে । )
তাই বলে যে শুধু কোলেই নিয়ে বসে থাকতাম তা নয়। মুরগীগুলোকে খাওয়ানোও ছিল আমার প্রিয় কাজ।
ঢাকায় চলে আসার পর অনেক দিন মিস করেছি মুরগীগুলোকে। বাসায় অবশ্য মুরগী আনা হত খাওয়ার জন্য। আগে আব্বা জ্যান্ত মুরগী নিয়ে আসতেন। পা বাঁধা মুরগীগুলো কক কক করতে থাকত। পরে আব্বা সেগুলোর ব্যবস্থা করতেন।
একবার একটা হাঁস আনা হয়েছিল খাওয়ার জন্য। হাঁসটাকে কেন যেন ঐ দিনই জবাই করা হল না। বাথরুমে গামলায় পানি দেয়া হল। সে চুপ করে সেখানে বসে থাকত। আর মাঝে মাঝে তার বাথরুম পেলে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ঢুকে পড়ত, আর কাজ সম্পাদন করে আবার বাথরুমে ঢুকে বসে থাকত।
ছোট ভাইটা খুব মজা পেয়েছিল জ্যান্ত প্যাক প্যাক পেয়ে। সে ঘোষণা করে দিল এই হাঁসটা যেন জবাই করা না হয়, সে পুষবে। কিন্তু বড়রা বড়ই নিষ্ঠুর। ছোট মানুষটার চোখ লুকিয়ে কাজের ছেলেটা এক সুযোগে হাঁসটা জবাই করে ফেলল পরের দিনই। ছোট ভাইটা দোকানে গিয়েছিল, ফিরেই দেখল কাজের ছেলের হাতে রক্ত।
বুঝতে দেরী হয়নি তার। চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল, আমার হাঁআআআআআআস! কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে।
তার পাখি পুষবার শখ দেখে আব্বা চারটা মুনিয়া পাখি কিনে দিলেন। খয়েরী রঙের শরীর আর কালো মাথার মুনিয়াগুলো কিচির মিচির করত সারাদিন। ওদেরকে ধান খেতে দেয়া হত।
আম্মার একবার শখ হল ওদের ডিম ফুটানোর। একটা ছোট ঝুড়িতে খড়কুটো দিয়ে খাঁচার ভিতর রেখে দিলেন। মুনিয়াগুলো ডিম পাড়েনি, জানি না সবগুলোই মেয়ে কিংবা সবগুলোই ছেলে ছিল কি না। আম্মার সেই খড়কুটো দেয়া ঝুড়িতে পাখির মুখ থেকে পড়ে যাওয়া ধান থেকে ধান গাছ গজাত। একটা সময় পাখিগুলো মরে যেতে থাকল।
পর পর তিন দিনে তিনটা মুনিয়া মারা গেল। শেষটাও শোকে মরে যায় কি না সেই ভেবে আম্মা খাঁচা খুলে পাখিটাকে ছেড়ে দিলেন।
মুনিয়ার ডিম ফুটাতে না পারলেও আমাদের দুই বারান্দায় চড়ুই পাখি নিয়মিত বাসা করত, ডিম ফুটাত। বাচ্চাগুলো সারাদিন কিচির মিচির করত। সেই গল্প আগেই করেছি, এখন আর বললাম না।
একবার ছোট ভাইয়ের জন্মদিনে এক খালাত ভাই একটা বাক্স উপহার নিয়ে এল। বাক্স খুলেই ছোট ভাই আনন্দে নাচতে শুরু করল। বাক্সের ভিতর ছিল একটা ছোট্ট ঝুট শালিকের বাচ্চা, একেবারে সত্যিকারের। পাখিটা এতই ছোট ছিল যে উড়তেও শেখেনি। আর গাছ থেকে পড়ে পায়েও একটু ব্যথা পেয়েছে।
একটু খুঁড়িয়ে হলেও টুক টুক করে হেঁটে বেড়াত সারা ঘর। মাঝে মাঝে আমাদের পায়ের নিচেও চলে আসত। আমরা তখন হাঁটার সময় সাবধানে পা ফেলতাম যাতে পাখির বাচ্চাটার উপর পা দিয়ে না ফেলি। মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যেত না তাকে, পরে দেখা যেত স্টোর রুমের সবচেয়ে দুর্গম চিপা জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসে আছে সে।
ভাইটা ওকে হাতে, কোলে, পিঠে করে ছবিও তুলত।
ওর পাঁচ বছরের জন্মদিনের উপহার ছিল এই ঝুট শালিকের বাচ্চা।
পাখির বাচ্চাটাকে চাল, ভাত, কলা খাইয়ে দেয়া হত। খাওয়া একবার শুরু করলে আর থামতেই চাইত না। আম্মা মানা করতেন এত খাওয়াতে। পাখির বাচ্চা নাকি বুঝতে পারে না তার কতটুকু খাওয়া উচিৎ।
হয়তো সে কারণেই কোন একদিন খুব বেশি কলা খেয়ে ফেলেছিল শালিকের বাচ্চাটা। আর তার পর থেকেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। অবশেষে মরেই গেল।
এরপর অনেক দিন বাসায় কোন পাখি আনা হয়নি। অনেক দিন পর তখন আমরা বড় হয়ে গিয়েছি, একবার আম্মা শখ করে দুইটা লাভ বার্ড কিনে আনলেন, সেই সাথে বিরাট একটা খাঁচাও।
মাটির হাড়ি ফুটো করে দেয়া ছিল ওদের থাকার জন্য। ওখানেই ঘুমাত ওরা। মাঝে মাঝে খচরমচর করতে থাকত আর টুইট টুইট করে ডাকাডাকি করত। বেশ কিছুদিন ছিল পাখিগুলো, পরে আম্মা নিজেই ওদের ছেড়ে দিলেন।
এরপর অনেক দিন খাঁচাটা এমনি পড়ে ছিল।
কে যেন একবার একটা টিয়াপাখি ধরে এনে আম্মাকে দিল। পাখিটা ধরতে গিয়ে আহত হয়ে গিয়েছিল। একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই খাঁচাতে তার স্থান হল। আম্মা টিয়াটার সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুললেন।
একদিন খুব ভোরবেলা, সবাই তখন ঘুমে, আমি পরীক্ষার পড়া পড়ছিলাম। আমার সামনে একটু দূরেই খাঁচাটা রাখা ছিল। আমি ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসে গিয়েছিলাম বলে চশমাটা চোখে দেয়া হয়নি। এজন্য খেয়াল করতে পারিনি যে খাঁচার দরজাটা ভুল করে খোলা রয়ে গিয়েছিল। খেয়াল করলাম যখন, তখন টিয়াটা খোলা দরজা পেয়ে উড়ে বের হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু দরজা-জানালা বন্ধ বলে ঘরের ভিতরই উড়তে থাকল। আমি দৌড়ে গিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করলাম। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। ফ্যানের সাথে বাড়ি খেয়ে টিয়াটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে টিয়াটা দু'হাতে তুলে নিলাম।
তখনও প্রাণ ছিল তার দেহে। মুহূর্তেই মারা গেল আমার হাতের উপরই। আমি কাঁদতে কাঁদতে আম্মাকে ডেকে তুলে দেখালাম। আম্মা কিছুক্ষণ পাখিটা ধরে রইলেন। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে ফেলে দিলেন।
মাঝে মাঝে নিজেকেই দায়ী মনে হয় টিয়াটার মৃত্যুর জন্য। কেন যে চশমা পরে বসিনি সেদিন, কিংবা ফ্যানটা আরও দুই সেকেন্ড আগে বন্ধ করতে পারলেই হত।
নিজেকে ক্ষমা করতে পারা খুব কঠিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।