একসময় দেখলাম, সবই কল্পনা, বাস্তবতায় শূন্য পৃথিবী। আর থাকতে পারছিলেন না রিশাদ। একবার উপরটা গিয়ে দেখে আসতেই হবে। যখন থেকে এই নতুন বাসায় উঠেছেন, তখন থেকেই এই উপরের ফ্ল্যাট থেকে নানা শব্দ আসে। ব্যাপারটা তাকে বড়ই ভাবায়।
রাতের বেলা ঘুমানোর সময় হঠাৎ মানুষের পায়ের আওয়াজে তিনি ধরফর করে উঠে বসেন। পানি খান, অনেকক্ষণ কান পেতে রাখেন আর কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা। ঘুমিয়ে যান নিজের অজান্তেই।
গত মাসের প্রথম সপ্তাহে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছেন রিশাদ হোসেন। মিরপুর এলাকার ছিমছাম ফ্ল্যাট, ৮ তলা ভবন তার পাঁচতলায় তিনি থাকেন ।
রিশাদ কর্মে পেশাজীবী, বৈবাহিকভাবে তালাকপ্রাপ্ত । একাই থাকেন এই ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটি তারই একজন শিক্ষকের। দুই রুমের ফ্ল্যাট। বাড়িওয়ালা থাকেন নিজের কোয়ার্টারে।
তাই বাড়িওয়ালাকে এ ব্যাপারটি সহসাই তিনি জানাতে পারেন না।
তিনি রাত ১১ টার সময় ফ্ল্যাট থেকে বের হলেন। ফ্ল্যাটের মালিক নেই, তবে পুরো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের একজন সেক্রেটারি আছেন। তিনি ৭ তলায় থাকেন। রিশাদ কিছুক্ষণ ভেবে আগে ছয়তলায় যান।
সেখানে বেল বাজাতে থাকেন ঠিক তার ফ্ল্যাটের উপরের ফ্ল্যাটে। কিন্তু কেউ দরজা খুলে না। তিনি দরজায় ধাক্কান। তাও কোন সাড়াশব্দ নেই। এভাবে প্রায় ৫ মিনিট অতিবাহিত হবার পর, তিনি ৭ তলায় সেক্রেটারির বাসায় গেলেন।
সব শুনে সেক্রেটারি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ভাই এটাতো সম্ভবই না। এই ফ্ল্যাটে কেউই থাকে না। বাড়িওয়ালা বিদেশে। গত দুইবছর আগে এক ফ্যামেলি থাকত।
তারা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাবার পর আর কেউ এতে থাকে না।
সেক্রেটারির কথা শুনে রিশাদ দমে গেলেন। তাহলে হয়ত শব্দের উৎস অন্যকোথাও। যেটা সহসাই পাওয়া যাবে না। তিনি একবার ভাবলেন ছাঁদেও তো শব্দ হতে পারে।
তিনি সেক্রটারিকে বললেন, আচ্ছা, ছাঁদে যদি শব্দ হয়?
সেক্রেটারি জামাল আহমেদ, কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ছাঁদ তো তালা দেওয়া। কেউ যায় না। খোলা ছাদ তো, কোন রেলিং নাই। আর ছাঁদে যদি শব্দ হয়ই তাহলে তো আমরাও পেতাম।
এ কথার পর সেক্রেটারি বললেন, চলুন তো একবার নিচে গিয়ে গার্ডদের জিজ্ঞেস করি।
রিশাদ আর জামাল দুইজনে মিলে নিচে নামলেন। দুইজন গার্ড আর কেয়ারটেকারদের একত্র করা হলো। কেয়ারটেকারের নাম সামাদ।
সামাদকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আপনার আগে যারা আপনার ফ্ল্যাটে থাকত, তারাও একই কমপ্লেন করেছে। কিসের শব্দ যে হয় তা কেউই বলতে পারে না।
জামাল সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করে জানতে চাইলেন, কই তুমি তো আমাকে কখনই বলনি, তারা যে কমপ্লেন করত?
সামাদ উত্তর দেয় নম্রভাবে, ব্যাপারটা আসলে আমার কাছে তেমন গুরুতর মনে হয় নাই। তাই বলি নাই। আর ওরা একবার কি দুইবার বলেছিলো। সারাদিন কত কাজের মধ্যে হয়তো ভুলে গেছি।
জামাল বললেন, এ ফ্ল্যাটের চাবি কার কাছে আছে?
-স্যার, চাবি তো বাড়িওয়ালার কাছে বিদেশে।
আরেকটা চাবি আছে সেটা থাকে বাড়িওয়ালার আত্মীয়ের কাছে। তিনি ধানমন্ডি এলাকায় থাকেন।
জামাল রিশাদের দিকে ফিরে বললেন, শুনলেন তো! সম্ভবত আপনি যে শব্দ পাচ্ছেন, তা অন্য কোন ফ্ল্যাট থেকে বা বাইরে থেকে আসছে।
রিশাদ জামাল সাহেবের কথা শুনল, তবে জামাল সাহেব নিজের ব্যাখ্যাতে নিজেই সন্তুষ্ট নন, এটা তিনি ভালই বুঝলেন। রিশাদ বলল, ঠিকাছে তাহলে, দেখি ব্যাপারটার একটা সুরাহা করতে হবে।
রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় শব্দে। কথা শেষ তবে জামাল সাহেবের ভাবনা কাটলো না। তিনি বললেন, চলুন দেখি একবার ফ্ল্যাটটা।
রিশাদ জামাল লিফটে উঠলো। লিফট ৬ তলায় উঠলো।
দরজা খুলল। কি আজব ব্যাপার, একটু আগেই যে ফ্ল্যাটের দরজা খুলছিল না কেউ, সেই ফ্ল্যাটের দরজা এখন হা করে খোলা!
জামাল সাহেব তা দেখে বলল, আমরা ছতলায় না, পাঁচ তলায় চলে এসেছি। এটা আপনার ফ্ল্যাট। কথাটায় মুহুর্তেই ঘোর কাটল রিশাদের। সে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা রেখেই বেড়িয়েছিল।
সে জামালকে বলল, তাহলে আমি ঘরে যাই, উপরে যখন কেউ থাকে না, তাহলে আর উপরে গিয়ে কি হবে?
জামাল বললেন, ঠিকাছে তাহলে। দেখা হবে পরে। আমি তাহলে আসি। আর সমস্যা হলে জানাবেন!
লিফটের দরজা বন্ধ হতেই রিশাদ নিজের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল। তার কেন যেন মনে পড়ছে না সে কি দরজাটা আসলেও খোলা রেখে বেড়িয়েছিল? আর খোলা রেখে বের হলেও পুরোটা তো এটে দিয়ে বের হবার কথা।
এ ভুল তো তার কখনই হয় না। রিশাদ ঘরে ঢুকে তবুও দুইটা ঘর ও রান্নাঘর একবার দেখে নিলেন। আনাচে কানাচে কেউ লুকিয়ে নাই তো!
কেউ ছিল না। থাকার কথাও না। নিজের বিছানার কাছে গিয়ে গা এলিয়ে দিলেন রিশাদ।
চোখ রাখলেন ছাতে। সেখানে সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে স স শব্দে। পরক্ষণেই খেয়াল করলেন, এটা তো তার ফ্যান নয়! তবে ফ্যানটা খুব পরিচিত। এ ফ্যানটা তিনি যেন কোথায় দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন মনে পড়ছে না।
ধীরে ধীরে মনে হলো, এই ফ্যানটা অনেক পুরোনো দিনের ফ্যান। কম্পানির নাম উষা। ভারতীয় কম্পানি। এ ফ্যানগুলো পাকিস্তান আমলে আমদানি হত। এখন আর পাওয়া যায় না।
এই ফ্যানটা সে তার বাবা যখন ফেনীর ডিসি ছিলেন, সে বাবার ঘরে দেখেছিল।
মনে পড়তেই তিনি তরাসে বিছানা থেকে উঠে গেলেন। দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে সিলিং ফ্যানটাকে ভালো করে দেখতে লাগলেন। আশ্চর্য, এটা কেমন করে সম্ভব! তার ঘরে টঙ্গী ন্যাশনালের...
বিছানার দিকে তাকাতেই তিনি আতকে উঠলেন! এ বিছানা তো তার নয়!
এ ঘরও তার নয়। রিশাদ ভয় পেতে শুরু করলেন।
তার ঘরে যা যেখানে আছে, সবই তেমন করে সাজানো, কিন্তু আশ্চর্য, কোন জিনিসই তার নয়। তিনি দৌড়ে পাশের ঘরে গেলেন।
গিয়ে দেখলেন, মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো। তার উপরে একটা টেবিল। খুব সুন্দর করে ঘরের মাঝামাঝি রাখা।
তার ঠিক উপরে একটা টেবিল ল্যাম্প। রিশাদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, এই ঘরে আর কিছুই নেই। পুরো ঘর ফাঁকা। তবে, এ ঘরে আরেকজনের অস্তিত্ব তিনি টের পাচ্ছেন!
মানুষ যখন ভয় পায়, তখন তার পুরো শরীর অবশ হয়ে যায়।
মনে হয়, ঘুরে দাড়াইলেই হয়ত কাউকে দেখা যাবে। বীভৎস কাউকে। রিশাদ ধীরে ধীরে পেছেনে তাকালেন। কেউ নেই। পুরো ঘর ফাঁকা।
এঘরে একটা খাবার টেবিল ছিল। নেই! এ ঘরে একটা সোফাসেট ছিল, নেই! শুধু সেই ছোট টেবিল আর টেবিল ল্যাম্প!
রিশাদ ভয়ে একপ্রকার অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করলেন। তিনি ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে গেলেন। ল্যাম্পটা জ্বলছে। সুন্দর আলো ছড়াচ্ছে।
কিন্তু ল্যাম্পের পাশে একটা ছোট কাগজের টুকরো। তিনি ধীরে ধীরে এ টুকরোটি হাতে নিলেন! কাগজে কিছু লেখা নেই। তবে, এধরণের কাগজে মানুষ কিছু লিখে তবেই এভাবে রাখে।
রিশাদ খেয়াল করল, হঠাৎ এ ঘরে এ ল্যাম্পের আলো ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু ল্যাম্পের আলো ধীরে ধীরে কেন্দ্রিভূত হচ্ছে।
আলো চারিধার দিয়ে কমে যাচ্ছে। রিশাদ এবার খুব সূক্ষ্মভাবে টের পেলেন তার ঠিক পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ফিরবেন? কি ফিরবেন না যখন ভাবছিলেন ঠিক তখনই, পেছন থেকে প্রচন্ড শব্দে কেউ তাকে আঘাত করল। তিনি ল্যাম্পের উপরে ধড়াম করে পড়ে গেলেন। আক্রমণকারী তাকে আঘাত করছে, তিনি টের পাচ্ছে, তবু কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।
ধড়াম ধড়াম শব্দ হচ্ছে। তিনি চীৎকার করতে চাইলেন, পারলেন না, চোখ খুলতে চাইলেন, পারলেন না। আক্রমণকারী এলোপাথাড়ি তাকে আঘাত করে যাচ্ছে। হঠাৎ সব কিছু শান্ত হয়ে গেল। শব্দটাও নেই।
তবে অন্ধকার কাটেনি। ল্যাম্পটা ভেঙ্গে গিয়েছিল।
রিশাদ ধরফর করে উঠলেন। তিনি নিজেকে এবার নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলেন। পুরো বিছানা ঘামে ভিজে গেছে।
উপর তলা থেকে ধড়াম ধড়াম শব্দ আসছে। সে শব্দেই কি এ দুঃস্বপ্ন ভাঙল? ঘরের বাতি জ্বালানো। তার মনে পড়ল, তিনি লিফট থেকে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন, ঘরের বাতি না নিভিয়েই। মনে পড়তেই তিনি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন। অদ্ভূত, এটা সেই উষা ফ্যানটি নয়।
এটা তারই টঙ্গী ন্যাশনাল সবুজ ফ্যান। রিশাদ থর থর করে কাপতে শুরু করলেন। এ ঘরের দরজা দিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকালেন। ও ঘরেও বাতি জ্বালানো!
তিনি সে ঘরে গেলেন। না, সব ঠিক আছে এবার।
তার ডাইনিং টেবিল, তার সোফাসেট! তাহলে তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। এত ভয়াবহ স্বপ্ন হতে পারে! এর আগে এমনটি কখনই হয়নি তার সাথে। পানি খেয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। পাশ ফিরতেই হাতে কি যেন লাগল! একটা কাগজের মত যেন। তিনি উঠে ঘরের বাতি জ্বালাতেই দেখলেন, তার হাতে সেই কাগজটা যেটা তার স্বপ্নে দেখা টেবিল ল্যাম্পের নিচে আটকে ছিল!
(এটা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা গল্প।
গল্পের প্রয়োজনে কিছু কিছু জিনিস পরিবর্তীত করা হয়েছে। ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।