কুখ্যাত রাজাকার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা । একাত্তরে এরা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক।
রোববার সেই কাহিনী তুলে ধরলেন খন্দকার আবুল আহসান। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান (৫৫) গতকাল রোববার জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে কাদের মোল্লা ও তাঁর সহযোগীদের উপস্থিতিতে মিরপুরে জল্লাদখানায় তাঁর বাবা বুদ্ধিজীবী খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা করা হয়।
সরকারি কর্মকর্তা আবুল আহসান শহীদ বুদ্ধিজীবী তালেবের ছোট ছেলে। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তিনি জবানবন্দি দেন।
আসামির কাঠগড়ায় কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে আবুল আহসান জবানবন্দিতে বলেন, একাত্তরে তিনি মিরপুরের শাহ আলী একাডেমি উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে পড়তেন। তাঁদের পরিবার তখন মিরপুরে থাকত। তাঁর বাবা ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও আইনজীবী।
তিনি (তালেব) আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, মর্নিং নিউজ, পয়গাম, ইত্তেহাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি একাত্তরে পয়গাম পত্রিকার খণ্ডকালীন ফিচার সম্পাদক ছিলেন এবং এবং বিএনআর নামের একটি ল ফার্মে কাজ করতেন।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, সত্তরের নির্বাচনে মিরপুরে জামায়াতের প্রার্থী গোলাম আযমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন কাদের মোল্লা। নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একাত্তরের ২৫ মার্চের পর নানা ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস, কিন্তু বাঙালিরা সেদিন বাংলাদেশ দিবস পালন করে।
দেশের অন্যান্য স্থানের মতো তাঁরাও (সাক্ষী) সেদিন মিরপুরের বাংলা স্কুলে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে একটি কালো পতাকা ও একটি বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। ওই দিন রাতে বাংলা স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সৈয়দ কাইয়ূম তাঁদের (সাক্ষী) বাড়ি থেকে নিজ বাসায় যাওয়ার পর রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে তিন-চারজন দরজা ভেঙে তাঁর বাসায় ঢোকে। ‘স্বাধীন বাংলার পতাকা কেন উড়াইছিস’—এ কথা বলে তারা ওই শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। একপর্যায়ে তাঁকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। তিনি প্রাণ বাঁচাতে ওই অবস্থায় দৌড় দিয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং একজন বাঙালি তাঁকে রক্ষা করে তাঁদের (সাক্ষী) বাড়িতে নিয়ে যান।
আবুল আহসান বলেন, মিরপুর রাড্ডা বর্ণেন হাসপাতাল (তৎকালীন সরকারি আউটডোর ক্লিনিক) থেকে একজন চিকিৎসক এনে কাইয়ূমের প্রাথমিক চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁর বাবা পরদিন সকালে কাইয়ূমকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ভর্তি করান। পরে তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ঘটনাটি তাঁকে জানান। ২৪ মার্চ তাঁদের পরিবারের সবাই শান্তিনগরে ফুফুর বাড়িতে চলে যান এবং তাঁর বাবা সাত-আটজনকে নিয়ে মিরপুরের বাড়িতে থাকেন। ২৭ মার্চ তাঁর বাবা দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর শুনে সাবেক সহকর্মীদের দেখতে সেখানে গিয়ে কয়েকটি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
২৯ মার্চ শান্তিনগরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেন, গাড়ি ও টাকা আনতে মিরপুরের বাড়িতে যাবেন। এরপর ল ফার্মের দিকে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ইত্তেফাক-এর তৎকালীন প্রধান হিসাবরক্ষক অবাঙালি আবদুল হালিমের দেখা হয়। হালিম তাঁর বাবাকে মিরপুরে নিয়ে কাদের মোল্লার কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর কাদের মোল্লা ও তাঁর কয়েকজন সহযোগীর উপস্থিতিতে তাঁর বাবাকে মিরপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায় নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।
আবুল আহসান বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ ছিল না।
আমি চকবাজার থেকে চা পাতা কিনে ফেরি করতাম। ওই সময় চকবাজারে আমাদের অবাঙালি গাড়িচালক নিজামের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর কাছে জানতে পারি, মিরপুরে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। গাবতলী, টেকনিক্যাল থেকে বাঙালিদের ধরে এনে শিয়ালবাড়ি, মুসলিমবাজার বধ্যভূমি ও জল্লাদখানায় এনে বাঙালিদের হত্যা করা হয়। ’
প্রায় দেড় ঘণ্টার জবানবন্দির শেষ দিকে সাক্ষী বলেন, ‘মা এ হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি।
আমি শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। ’ পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী একরামুল হক তাঁকে জেরা শুরু করেন।
আবু তালেব সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও আইনজীবী ছিলেন—এর সপক্ষে কোনো নথি আছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে আবুল আহসান বলেন, তাঁর বাবা যে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, তার স্মারক হিসেবে মিরপুরে শহীদ আবু তালেব উচ্চবিদ্যালয় হয়েছে, জাতীয় প্রেসক্লাবে শহীদদের নামফলক ও ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে শহীদদের নামফলকে তাঁর নাম এবং জাতীয় জাদুঘরে তাঁর নামে একটি গ্যালারি আছে। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর কাজ করার কোনো নথি আছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একাত্তরে তাঁদের মিরপুরের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই কোনো কিছু উদ্ধার করা যায়নি।
সৈয়দ কাইয়ূম কি জীবিত আছেন—আইনজীবীর এ প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, তিনি (কাইয়ূম) জীবিত আছেন।
মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে কথাও হয়। সর্বশেষ এক বছর আগে দেখা হয়েছে। একাত্তরে সাক্ষী যখন চা পাতা বিক্রি করতেন তখন তিনি কোথায় থাকতেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের চামেলীবাগের বাসায় ছিলেন। নিজাম কত দিন তাঁদের গাড়ি চালিয়েছেন এবং এখন কোথায় আছেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিজাম দুই বছর তাঁদের গাড়িচালক ছিলেন। তিনি এখন পাকিস্তানে আছেন।
‘আপনার বাবা আবদুল হালিমের সঙ্গে গেছেন, এটা কার কাছে শুনলেন’—এ প্রশ্নের জবাবে আবুল আহসান বলেন, তিনি বাবার খোঁজে ২৯ মার্চ ল ফার্মে গেলে আইনজীবী খলিল বলেন, তাঁর বাবাকে অবাঙালি আবদুল হালিম সঙ্গে নিয়ে গেছেন। বাবার মৃত্যুর খবর কার কাছে শুনেছেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাড়িচালক নিজামের মুখে।
আবুল আহসানকে আজ সোমবার আবার জেরা করবে আসামিপক্ষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।