বহু অপকর্ম এবং নিষ্ঠুরতার হোতা চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওসি প্রদীপ দাশকে অবশেষে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একের পর এক রাজপথে আন্দোলনরত নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের উপর বর্বর আচরণ করে দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের নায়ক এই ওসিকে গতকাল বুধবার থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। তাকে নগর গোয়েন্দা পুলিশের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এগার মাস আগে নগরীর পতেঙ্গা থানা থেকে আওয়ামী লীগের এক নেতার হাত ধরে পাঁচলাইশ থানার ওসি হিসেবে বদলি হন প্রদীপ কুমার।
পাঁচলাইশ থানায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া আচরণ শুরু করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
সর্বশেষ রোববার দুপুরে নগরীর বাদুরতলা এলাকায় বোরকা পরা এক বয়োবৃদ্ধাকে রাজপথে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন তিনি। ওইদিন সকালে ওই এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল, বোমাবাজি এবং পুলিশের উপর হামলা করে শিবির কর্মীরা। এ ঘটনার প্রায় দুই ঘণ্টা পর পুরো এলাকা ঘেরাও করে তল্লাশি অভিযান শুরু করে পুলিশ। সেখান থেকে আরমান নামে এক কলেজ ছাত্রকে আটক করে নির্দয় প্রহার করার সময় তার মা জাহানারা বেগম ছুটে আসেন।
তিনি রাস্তায় প্রদীপ দাশের পায়ে পড়ে তার ছেলে বোমাবাজির ঘটনায় জড়িত নয় দাবি করে তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন।
আর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওসি নিজেই পর্দানশীন ওই মহিলাকে কিল ঘুষি মেরে জখম করে। অপমানে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। জাহানারা বেগম জানান, পাশের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় তাদের বাসা। তার কলেজপড়–য়া ছাত্র আরমান টিউশনি শেষে পাসের বাসা থেকে বাসায় ফিরছিল। আর তখনই পুলিশ তাকে ঝাপটে ধরে শিবির কর্মী বলে গ্রেফতার করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানায়, শিবির কর্মীরা তান্ডব চালিয়ে এলাকা ত্যাগ করার দুই ঘণ্টা পর ওই কলেজ ছাত্রকে আটক করে পুলিশ। পরদিন তাকে চালান দেয়া হয়। জানা যায়, এ ঘটনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে টনক নড়ে। জানা যায়, ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়। আর এর অংশ হিসেবে তাকে গতকাল প্রত্যাহার করা হল।
এর আগে কয়েকবার জামায়াত শিবির ধরার নামে বুট জুতা পায়ে মসজিদে ঢুকেও মুসল্লিদের উপর নির্দয়ভাবে হামলা করে প্রদীপ কুমার। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার দিন শিবিরের মিছিল থেকে কর্মীদের ধরে পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে প্রদীপ দাশ। তার নির্মম নির্যাতনে বেশ কয়েকজন যুবক পঙ্গু হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। পবিত্র মসজিদকে জুতা পায়ে মাড়িয়ে অপবিত্র করা এবং রাজনৈতিক কর্মীদের গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করার একাধিক ছবি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
জামায়াত শিবির ধরার নামে আলোচিত ওই ওসি তার থানা এলাকার বাইরেও অনেক বাসাবাড়িতে বেপরোয়া অভিযান পরিচালনা করে।
আওয়ামী লীগের লোকদেরকেও ধরে জামায়াত বলে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে বেশ কয়েক দফা তার বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে। আর এসব অপকর্ম থেকে নিজেকে আড়াল করতে ‘জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ছাড়িয়ে নিতে তদ্বির করে’ বলে একাধিকবার তিনি মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়েছেন।
তার বেপরোয়া আচরণের কারণে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সাথেও মারামারির উপক্রম হয়। নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে ছাত্রশিবির পরিচালিত একটি কোচিং সেন্টারের উদ্যোগে কৃতী ছাত্র-ছাত্রী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ শতাধিক ছাত্রকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে ওই ওসি।
আটককৃতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কর্মী সমর্থক ছাড়াও তাদের দলের নেতাদের কয়েকজন সন্তানও ছিল। তাদের ছাড়িয়ে আনতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা পাঁচলাইশ থানায় গেলে ওই ওসি তাদের সাথেও চরম দুর্ব্যবহার করে। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাজতে ঢুকিয়ে দেয় প্রদীপ কুমার। পরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা থানা ঘেরাও করে ওসিকে নাজেহালও করে। এরপরও তার বেপরোয়া আচরণ থামেনি।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে নগরীর ষোলশহর এলাকা থেকে ৭ জন মাদরাসা ছাত্রকে গ্রেফতার করে তাদেরকে নগরীর ১০ শীর্ষ আলেম হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিত্রিত করে প্রদীপ কুমার। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরীসহ সারাদেশে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ১০ শীর্ষ আলেমকে হত্যার জন্য তালিকা করে পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে মিডিয়ায় প্রচার করেন প্রদীপ কুমার। তবে শেষ পর্যন্ত সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি করিৎকর্মা ওই পুলিশ কর্মকর্তা। মহানগর পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে নগরীর অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সহনশীল আচরণ করে আসছিলেন।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ওসি প্রদীপ। কোথাও কোন ঘটনা ঘটলেই জামায়াত শিবির ধরার নামে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজসহ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে সাধারণ লোকজনদের ধরে এনে হয়রানি করাই ছিল তার কাজ। অভিযোগ রয়েছে সাধারণ লোকদের ধরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়েও দিতেন তিনি। নগর আওয়ামী লীগের আলোচিত বিতর্কিত এক নেতার মদদপুষ্ট হওয়ায় পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও তার বিরুদ্ধে কোন কিছু করার সাহস পেতেন না।
এক বছরের চেয়েও কম সময়ে পাঁচলাইশ থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে নির্দয় এবং নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে দেশ এবং বিদেশে ব্যাপক নিন্দিত হয়েছেন দলবাজ এ পুলিশ কর্মকর্তা।
ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক একটি মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উত্থাপন করেছে। তার আচরণে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের একটি অংশও তাকে সরিয়ে দিতে দেন-দরবার করে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রদীপ দাশ। দৈনিক ইনকিলাবের কাছে তিনি দাবি করেন তিনি কোন অন্যায় করেননি। হঠাৎ করে কেন তাকে বদলি করা হল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে নাকি একের পর এক ঝামেলা হচ্ছে, এ কারণেই বদলি করা হয়েছে।
বদলির ঘটনায় তিনি বিচলিত নন উল্লেখ করে বলেন, আমি এসবকে পাত্তা দিই না। তার বিরুদ্ধে কোন বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে কিনা তাও তিনি জানেন না বলে জানান। ’
গতকাল সকালে প্রদীপ কুমারকে গোয়েন্দা পুলিশে বদলি করার আদেশ জারি করা হয়। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা তার প্রত্যাহারকে স্বাভাবিক বদলি বলে দাবি করছেন। আরও দুই থানার ওসি পদেও রদবদল করা হয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন, অর্থ ও ট্রাফিক) একেএম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়মিত বদলির অংশ হিসেবে তিন থানার ওসি পদে রদবদল ঘটানো হয়েছে। ’ নগরীর চান্দগাঁও থানার ওসি বাবুল চন্দ্র বণিককেও নগর গোয়েন্দা পুলিশে বদলি করা হয়েছে।
পাহাড়তলী থানার ওসি আব্দুর রউফকে চান্দগাঁও থানায় বদলি করা হয়েছে। আর সিএমপিতে নতুন পোস্টিং পাওয়া পরিদর্শক আজিজুর রহমান মিয়াকে পাহাড়তলী থানার ওসি করা হয়েছে। এছাড়া নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক এস এম আতাউর রহমানকে পাঁচলাইশ থানার ওসি পদে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে ডিবিতে বদলি হওয়ার খবরে সেখানে কর্মরত সৎ এবং পেশাদার কর্মকর্তাদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের আশঙ্কা ডিবিতে এসেও প্রদীপ কুমার তার বেপরোয়া আচরণ অব্যাহত রাখতে পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।