আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিমু এবং স্যারের শেষ ইচ্ছে

জীবিত মানুষ হতে চাই। হিমুর মন খারাপ। সে তার স্রষ্টার ইচ্ছানুযায়ী মহাপুরুষ হতে পারেনি। চেষ্টার কোথাও কমতি হয় নি। জগতের সকল প্রকার কর্মকাণ্ডে নির্লিপ্ত থেকেছে এতদিন।

ভালোবাসা,মায়া কিংবা মন খারাপ করা সহ জাগতিক সকল অনুভূতির উর্ধ্বে ছিল। হেঁয়ালি ছাড়া কারো সাথে কথা বলত না অথচ বিচিত্র পদ্ধতিতে সবার সবরকম সমস্যা সমাধান করে দিত। সেদিনকার হিমু আর নেই এখন। ভোর হতে চলল। জানালার দিকে তাকিয়ে মেসের বিছানায় বসে আছে সে মন খারাপ করে।

একটু আগে তার হলুদ পাঞ্জাবিটা পুড়িয়ে দিয়েছে। দুটো দিন নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ শেষে সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়ন করেছে। পাশের রুমের মনোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সাদা শার্ট আর একজোড়া জুতা চেয়ে এনেছে। বিছানা থেকে নামল সে। শার্টটা গায়ে দিল।

জুতাজোড়া পড়ে ঘর থেকে বের হল। দরজা খোলা থাকুক। না,ফিরে এসে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিল সে। পুরনো অভ্যাস সব বদলে দিতে হবে। বাইরে এসে বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো।

বাসে মানুষের ভীড়ে বমি আসলেও আজ সে বাসে করেই মাজেদা খালার বাসায় যাবে। বাদলের সাথে দেখা করতে হবে। বাদলদের প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হিমু। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে যেন এ বাড়ি প্রাণহীন। আসলে শুধু এই বাড়ি নয়,ঢাকা শহরের এমনকি পুরো বাংলাদেশেরই প্রাণ শুষে নিয়েছে একটা খবর।

কলিংবেজ বাজিয়ে মিনিটখানেক অপেক্ষা করল। খালু সাহেব এসে দরজা খুলে দিলেন। হিমুর দিকে এক পলক তাকিয়ে থাকলেন। তার দৃষ্টিতে বিষণ্নতা। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাইছিলেন।

কিন্তু থেমে গেলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু বললেন-এসো। হিমু ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। খালু সাহেব ততক্ষণে তার ঘরে চলে গেছেন। হিমুও পিছু পিছু ঢুকল তার ঘরে।

খালু সাহেব একটা বই নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার কাছ থেকে জানা গেল মাজেদা খালার শরীর খারাপ। গত দুইদিন ধরে কিছু খান নি। গতকাল ডাক্তার এসে স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। হিমুর উপরে যেতে ইচ্ছে করল না।

তাকে দেখলেই খালা কান্নাকাটি শুরু করে দেবেন। এখন উপরে যাওয়া চলবে না। সে বাদলের রুমে আসল। বাদল তার কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সে হিমুর দিকে না তাকিয়েই বলল-হিমুদা বস।

কি করছিস। বিছানার এক কোণে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল হিমু। স্যারের কিছু বই আমার কাছে নেই। সেগুলো ডাউনলোড করে রেখে দিচ্ছি। ও।

বলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল হিমু। আজ সবখানেই কথার শুণ্যতা বিরাজ করছে। যেন এমনটাই নিয়ম আজকে। এক সময় বাদলের কাজ শেষ হল। চেয়ার ঘুরিয়ে হিমুর মুখোমুখি হল।

তোমার এই অবস্থা কেন হিমুদা। হলুদ পাঞ্জাবি কোথায়? পুড়িয়ে দিয়েছি। হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে এখন আর কি হবে! বাদলও হিমুর কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। সে হিমুর সব কর্মকাণ্ডেই সায় দেয়। এখন কি করবে কিছু ঠিক করেছ হিমুদা? হ্যাঁ,ঠিক করেছি।

হিমু তার প্ল্যান বর্ণনা করল। সব শুনে বাদলের চোখ আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। এক্সিলেন্ট আইডিয়া। বলে নিজের হাতেই ঘুসি মারল সে। কিন্তু আমরা কি পারব হিমুদা? পারব না কেন?অবশ্যই পারব।

মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই। আর স্যারের শেষ ইচ্ছেটা পূরণের জন্য যদি জীবনও দিয়ে দিতে হয় তাও দিব। দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল হিমু। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। দশ মিনিট ধরে হিমু দাঁড়িয়ে আছে রূপাদের বাড়ির সামনে।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এই সময়ে রূপা ছাদে এসে দাঁড়ায়। হিমু তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। সে ভাবছে রূপা আজ কোন রংয়ের জামা পড়ে ছাদে আসবে?যদি আসমানী রংয়ের শাড়ি পড়ে আসত তাহলে খুব ভালো হতো। ভাবতে ভাবতেই রূপা ছাদে এসে রেলিংয়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। তার পরনে শুভ্র সাদা শাড়ি।

চুলগুলো খোলা। সকালবেলার মৃদু হাওয়ায় সেগুলো উড়ছে। রাস্তার অন্যপাশে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সে। এটা কে?হিমু না?হিমুই তো!ওর এই অবস্থা কেন?আশ্চর্য! -এই হিমু,বলে চিৎকার করে ডাক দিল। হিমু এদিকেই চেয়ে ছিল।

রূপার ডাক শুনে একটু হাসল সে। রাস্তা পার হয়ে রূপাদের বাড়ির দেয়ালের পাশে দাঁড়ালো। রূপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-কেমন আছ? রূপা উত্তর দিল না। দাড়োয়ানকে ডেকে গেট খুলে দিতে বলল। তারপর হিমুকে বলল ছাদে চলে আসতে।

হিমু বিনা বাক্য ব্যায়ে ছাদে উঠে এলো। রূপাদের ছাদটা অনেক সুন্দর। চারপাশের রেলিংয়ের পাশেই সারি সারি ফুলগাছ টবে লাগানো। এক কোণায় একটা চিলেকোঠা ঘর। রূপার পাঠঘর।

ছাদের মাঝখানে ছোট্ট একটা টেবিল। চারটি চেয়ার পাতা। এর দুটিতে মুখোমুখি বসে আছে হিমু আর রূপা। রূপার বিস্ময়ের ভাব কাটেনি এখনো। বিস্মিত কণ্ঠেই সে জিজ্ঞেস করল-পায়ে জুতো এবং গায়ে পাঞ্জাবীর বদলে শার্ট পড়া হিমু,ব্যাপারটা আমি ঠিক হজম করতে পারছি না।

তুমি কি আমাকে বুঝিয়ে বলবে?অবশ্য যদি বলতে ইচ্ছে করে। আমার যদি বলতে ইচ্ছে না করে তাহলে তুমি কি জোর করবে না? তোমাকে আমি চিনি। তোমাকে কোন বিষয়ে জোর করা অর্থহীন। আমি আর আগের হিমু নই রূপা। শুধু বাইরে না,ভেতরে ভেতরেও আমি অনেক বদলে গেছি।

বিষণ্ণ গলায় জবাব দিল হিমু। রূপা একদৃষ্টে হিমুর দিকে চেয়ে রইল। হিমুর এই চরিত্রের সাথে তার পরিচয় ছিল না আগে। হিমুর নিজেরও কি ছিল? একটা কথা বলতে এসেছি তোমাকে। হিমুর কথায় সংবিত ফিরে পেল রূপা।

-কি কথা? স্যারের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে হবে। স্যার বেঁচে থাকতে বলে গিয়েছিলেন উনি স্বশরীরে কাজটা উদ্বোধন করতে চান শাহ পরীর দ্বীপ থেকে। সেটা করার আগেই স্যার চলে গেলেন আচমকা। কিন্তু তাই বলে উদ্যোগটা থেমে গেলে চলবে না। আমরা তার সৃষ্টি করা চরিত্ররা সেই কাজ শুরু করব।

সমুদ্রে পা ধুয়ে হাঁটা শুরু করব। সারা বাংলাদেশ থেকে টাকা তোলা হবে। আর যারা কিছুটা ক্ষমতাবান তারা সবাই কিছু না কিছু দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয় সম্মিলিতভাবে আমরা অবশ্যই পুরো কাজটা শেষ করে ফেলতে পারব। দশে মিলে কাজ করব এবং অবশ্যই আমরা জিতে আসব।

-বলতে গিয়ে গলাটা ভারী হয়ে উঠল তার। আমি তোমার সাথে আছি। আমাকে সঙ্গে রাখবে না হিমু?-রূপার চোখে মিনতি। হ্যাঁ। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেই আমি এসেছি।

কিন্তু তোমাকে আগের রূপে ফিরে আসতে হবে। তা না হলে কেউ তোমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারবে না। সেই হলুদ পাঞ্জাবি,খালি পায়ের হিমুকেই সবাই মান্য করবে। তোমার এই স্বাভাবিক রূপটা আরো বেশি অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করছে। প্লিজ,তুমি আগের অবস্থায় ফিরে আসো!-হাত জোড় করার ভঙ্গি করল রূপা।

এক সময় কিন্তু তুমিই আমাকে স্বাভাবিক হতে অনুরোধ জানাতে। আজ তুমিই অন্য সুরে কথা বলছ? আমি ভুল ছিলাম। আমায় ক্ষমা করো। এখান থেকে মেসে ফিরেই শার্টটা খুলে হলুদ পাঞ্জাবিটা পড়ে নিও। আর জুতাজোড়া ফেলে দিও।

পাঞ্জাবি তো পুড়িয়ে দিয়েছি? আসলেই? হ্যাঁ। আচ্ছা তাহলে আজ আমার সাথে চলো। আমি তোমাকে হলুদ পাঞ্জাবি কিনে দিব। তোমাকে পাঞ্জাবি কিনে দেবার অধিকার তো আমার আছে। কি আছে না?বলতে বলতে হিমুর হাতে একটা হাত রাখল রূপা।

হিমু হাতটা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করল না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।