আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বচ্ছ অন্ধকার

আমার মন খারাপের পরেও, আমি আছিরে তোর পাশে... অপ্সরীদের সাথে আমার বেশ সখ্যতা আছে। যদিও আমি ওদের মত কোন এক নির্দিষ্ট গলি-ঘুপচি ঘেরা পাড়ায় বাস করিনা। ওদের মত পরী সেজে গাছের অন্ধকারে আলো হয়ে দাঁড়াইনা। তারপরেও ওদের সাথে বন্ধুতা গড়ে তুলেছি আমি। আমার ইচ্ছেতেই।

শুধুমাত্র আমার তখাকথিত সভ্য সুশীল জীবনের রং পাল্টে দেবো বলে। আরেকটি উদ্দেশ্য আমার আছে এই রংধনু মেঘের ভেলার যাত্রী হবার পেছনে। তা হোল আমার জীবনটাকে সুশীল করে তুলবার নাম করে নরক বানিয়ে ফেলেছে যে মানুষটি…নীলা নামের ঐ পঞ্চান্ন বছরের মহিলা; যার জঠর থেকে জন্ম হয়েছিলো আমার…তাকে একটি কঠিন শাস্তি দেবার পণ করেছিলাম আমি আমার সেই পাঁচ বছর বয়সে। সেই বয়সটিতে যতটুকু সান্নিধ্য আমি তার পেয়েছি তার পুরোটাই কেটেছে বর্নমালা চেনা, শব্দ গঠন আর বাক্য তৈরীতে। আমি যেদিন পরিপূর্ন একটি বাক্য লিখে তাকে দেখালাম, সে মুগ্ধ হয়ে আমাকে একটি সবুজ মলাটের ডায়েরী কিনে দিলো।

সবুজ আমার চিরকালের অপছন্দের রং সেই থেকে। তবু সেই ডায়েরীটাই আমার বন্ধু হয়ে উঠলো। এমনি বন্ধু, যার বুকে আমার কোন সুখের স্নৃতি নেই। তার বুকে আমার লেখা প্রথম বাক্যটি ছিলো “নীলা একজন অস্পরীর নাম”। আমি তখন ১২ বছরের বালিকা।

আমি তখন জানি “অপ্সরী” কাকে বলা হয়। আমি তখন “নীলা” নামের মানুষটি থেকে বিচ্ছিন্ন। “নাবিহা, তোমার রিপোর্ট কার্ডে গার্ডিয়ানের সিগনেচার নেই কেন?” প্রত্যেক ক্লাসে প্রত্যেক টিচারের এই প্রশ্নের উত্তরে আমি নীরব থেকেছি। প্রত্যেকেই কয়েকবার জিজ্ঞেস করে বিরক্ত হয়ে রিপোর্ট কার্ড আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। হঠাৎ যে ব্যতিক্রম হয়নি তা নয়।

দু’একজন টিচার একবার জিজ্ঞেস করে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছেন যেন আমার ভেতরটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তারা। ‘মা’ বুঝি এমন হয়! এই বোধ আমার কন্ঠ রোধ করে দেবার আগেই আমি কঠিনভাবে উত্তর দেই “ন্যান চোখে দেখতে পায়না”। টিচার আর কিছু না বলে রিপোর্ট কার্ড ফেরত দেন। ‘মা’ কেমন হয় ভাবতে গেলে প্রথমে আমি শুন্যতা ছাড়া কিছু দেখতে পাইনা। তারপর যে মুখটি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাতে আমার সমস্ত পৃথিবীকে লন্ডভন্ড করে দিতে ইচ্ছে করে।

ছয় বছর বয়সের এক পহেলা বৈশাখের সকালে ন্যানের সাথে কোচিং-এ যাবার সময় লিফট থেকে নামতেই নাহার আন্টির সাথে দেখা। গোধূলি রং শাড়িতে আন্টিকে যে কি অপরুপ লাগছে। মায়ের জন্য স্তব্ধ হাহাকারে আমার পর্যুদস্ত শিশুমন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন হারালো। ছুটে গিয়ে আন্টিকে জড়িয়ে ধরলাম। মেঘের আর্দ্রতায় ছলছলে চোখ মেলে আন্টিকে বললাম “তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমাকে নাওনা তোমার সাথে।

“ আন্টির হোস্টেলে প্রায়ই আমাকে রেখে আন্টির বান্ধবী ‘নীলা’ অভিসারে বের হয়ে যেত। আর তাই হয়তো আন্টির প্রতি এক অলিখিত অধিকার দাবী করে বসেছিলো আমার শিশুমন। সেই বৈশাখের কিছুদিন আগে ফেব্রুয়ারীর ১৪ তারিখে আন্টির হোস্টেলে ‘নীলা’ হাত ভরে মেহেদী পড়ে, পুতুল পুতুল সেজে আমাকে রেখে বের হয়ে গেল, সেদিনই কেবলমাত্র আমি আন্টিকে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। সেদিন মেহেদী পরাতে পরাতে আন্টি নীলা-কে জিজ্ঞেস করেছিলো “নাবিহার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নিয়েছিসতো?”। ওই বাক্যটা এমনভাবেই আমার ছোট্র মস্তিস্কে ঘুরছিলো যে নীলা-র কোন কথা আর ঢোকেনি ভেতরে।

নির্বাক শুধু তাকিয়ে ছিলাম কোন এক অপূর্ন প্রাপ্তির আনন্দে জলজল করা তার চোখদুটির দিকে। সেদিন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলেও নীলা আমাকে নিতে আসেনি। অনেক্ষন পর ন্যানের সাথে আমি ফিরে আসি নীলার ভাই-এর বাসায়; যে বাসায় নীলা বর্তমান থাকার পরেও চড়, ধাক্কা, চুলে টান…এসব অবারিত ছিলো। আর আজ থেকে নীলা নেই। আশি বছরের এক নারী আব্রুহীন এক বালিকার বেড়ে ওঠাকে কতটা আগলে রাখতে পারবে সেই ভাবনা নীলা করেছিলো কিনা তা নিয়ে আমার এতটুকু সন্দেহ নেই; কখনো হয়নি।

……….. কলিংবেল বাজতেই ভেজা শরীরেই গাউন পড়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসি আমি। আজ এই ভরসন্ধ্যায় আমার খটখটে মরুভূমিতে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কলের পানির সাথে তার মিশ্রনের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতেই দরজার দিকে আগাই। জানি ওপাশে নীলা। দেখা করতে চেয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া থেকে ১৫ বছর পর ফিরে এসে।

আমি ইচ্ছে করেই আজকের তারিখটা বেছে নিয়েছি তার আসার জন্য। আজই আমার প্রথম এ্যাপয়েন্টমেন্ট…..প্রথম ক্লায়েন্টের সাথে। যার আসার সময়টাও এখন!  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।