There will never be no love at all.
আধ্যাত্মিক তাপস হযরত শাহজালাল (র: )-এর মাজারকে ঘিরে চলছে জমজমাট ব্যবসা। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে শাহজালালের দরগাহ কেন্দ্রিক একটি পক্ষের কাছে এ মাজার এখন ব্যবসাস্থল।
মাজার দর্শন ও জিয়ারতের বিভিন্ন পর্যায়ে দর্শণার্থীদেরকে আর্থিক বাধ্যতামূলক শোষণের শিকার হতে হচ্ছে ওই চক্রের কাছে।
স্থাণীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় সকল ধর্মের মানুষের কাছেই “দরগাহ্ এ হযরত শাহজালাল (র.)” পবিত্র ও শ্রদ্ধাষ্পদ স্থান। এখানে আগত দেশ-বিদেশের পর্যটকদের নানান মানত পূরণের আশায় বা বা স্রেফ শ্রদ্ধা জানাতে মাজার জিয়ারত করেন।
পারস্য-মধ্যপ্রাচ্য থেকে উপমহাদেশে আগত পীর-আউলিয়াদের মধ্যে ৩৬০ সঙ্গীসহ সিলেট তধা তৎকালীন শ্রীহট্টে এসে আস্তানা গাড়া ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল ধর্ম-বর্ণ নির্ভিশেষে মানুষের কাছে অসীম শ্রদ্ধার আসনে আসীন। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বুরহান উদ্দিনের ওপর রাজা গৌর গোবিন্দের অত্যাচারের সূত্রে শাহজালাল (র.) ও তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে গৌর গোবিন্দ বাহিনীর লড়াই এবং এতে শাহজালালের বিজয় এক ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পরবতীর্তে হজরত শাহজালাল (র.), তার ভগ্নিপুত্র শাহ পরান (র.) এর জনকল্যানকর বিভিন্ন কাজ ও কিছু অলৌকিক ঘটনার সূত্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র তাদের গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ওঠে।
সেই সূত্রে হজরত শাহজালালের তিরোধানের পর তার মাজারকে কেন্দ্র করে ভক্তকূলের আনাগোনা দিন দিন বাড়তেই থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যান্য আলোচিত মাজারের মতই শাহজালালের মাজার এলাকায়ও গড়ে ওঠে মাজারকেন্দ্রিক নজর-নেওয়াজ আর দান-খয়রাত ব্যবস্থাপনার একটি পক্ষ, গড়েস ওঠে মোতাওয়াল্লি কমিটি, মসজিদ-মাজার রক্ষণাবেক্ষণে ও জনকল্যাণের নিমিত্তে নানান কমিটি।
বর্তোনে শাহজালাল দরগাহ দেখাশোনার দ্বায়িত্ব একজন সরেকওম মোতাওয়াল্লীর। বর্তমানে মোতাওয়াল্লী হিসেবে রয়েছেন ইউসূফ আমান উল্লাহ।
দরগাহ সেক্রেটারি জহির উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, দরগাহ খাদেম রয়েছেন ২৬০/২৭০ জন এর মতো। এদের নামের তালিকা রয়েছে সরকারের কাছে।
রোস্টার অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে খাদেমরা মাজারে আসেন।
মেয়র কামরানও একজন খাদেম
তিনি জানান, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র কামরানও দরগাহের একজন খাদেম। জন্মসূত্রে মেয়র কামরানের বাড়ি টাঙ্গাইলে। উনার নানীর বাড়ি সিলেটে। সে দিক থেকে অথ্যা নানাবাড়ির সূত্রে উনি এ মাজারের খাদেম।
এ পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বার মাজারে খাদেম হিসেবে কামরানকে আসতে দেখেছেন জহির উদ্দিন।
শাহজালাল (র.) এর মাজার চত্বরের উত্তরদিকে রয়েছে একটি পুকুর। এই পুকুরে আছে অসংখ্য গজার মাছ। এ নিয়ে কিংবদন্তী প্রচলিত যে দুষ্ট জ্বীনদের শাহজালাল (র.) তার অলৌকিক ক্ষমতার জোরে গজার মাছ বানিয়ে দেন। সে সে সূত্রে মাছগুলো ভক্তদের চোখে মর্যাদার পাত্র।
তারা এসব মাছগুলোকে আধার হিসেবে ছোট ছোট মাছ (খেতে) দেন। আগে মাছগুলোকে আধার (খাবার) হিসেবে রুটি বা মুড়ি দেওয়া হতো। এর ফলে পুকুরের পানি নোংরা হয় বলে কয়েক বছর আগে রুটি ছিড়ে দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মাজার জেয়ারত করতে আসা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল খালেক বিশ্বাস করেন, গজার মাছকে খাওয়ালে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি হয় এবং ভাল নিয়ত করলে তা পূরণ হয়। পুকুরের গজার মাছগুলোকে ২ প্লেট পুঁটি মাছ খাওয়ান তিনি।
৮টি পুঁটি মাছ ৪০ টাকা
পুকুরের পাশেই বিক্রি হচ্ছে পুঁটি মাছ। ১ প্লেট পুঁটি মাছ দর্শনার্থীদের কিনতে হয় ৪০ টাকায়। ৮ থেকে ১০টি পুঁটি মাছেই হয় ১ প্লেট। অনেক ভক্ত অবশ্য বিক্রেতাকে হাজার টাকা পর্যন্ত দেন মাছের দাম।
মাজারে যারা মাছ বিক্রি করেন, তারা কেউই মাজারের কর্মচারী নন।
মাজারের বাইরের একজন দোকানদার বাংলানিউজকে জানান, যাদের প্রভাব বেশি তারাই এখানে মাজারের বিভিন্ন কাজ পান। যেমন, মাছ বিক্রি, কবুতরের খাবার বিক্রি ইত্যাদি।
পুকুরের পাড়ে মাছ বিক্রি করছিলেন ফরিদপুরের মোবারক মিয়া। তিনি জানান, মাছ বিক্রির এ কাজটির ঠিকা আরেকজনের। তারা কয়েকজন মালিকের পক্ষে বিভিন্ন শিফটে মাছ বিক্রি করেন।
তার মালিকের অনেক প্রভাব রয়েছে, গর্ব করে বলেন মোবারক।
প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মাছ বিক্রি হয় বলে জানান মাজারের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ও বাইরের ব্যবসায়ীরা। ওরসের সময় শুধু ছোট মাছ বিক্রির পরিমাণই লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এছাড়াও ছুটি ও ধর্মীয় দিনগুলোতে মাছ বিক্রির পরিমাণ থাকে অনেক বেশি।
কূপের পানিও বিক্রি হয়
শাহজালালের মাজারের পাশেই রয়েছে একটি কূপ।
এ কূপ নিয়ে কিংবদন্তী আছে।
এ কূপে সোনা ও রূপার (হলুদ ও সাদা) রঙের মাছের অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায়। চারপাশ পাকা এই কূপে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয় পাশের প্রাকৃতিক ঝড়না থেকে। মাজারের পশ্চিম দিকে রয়েছে ঝরনাটি। ঝরনার পানি বোতল ভর্তি করে বিক্রি করা হয়।
বোতল ভর্তি পানির কোনো নির্দিষ্ট দাম নেই। কিন্তু সচরাচর কাউকেই ১০০ টাকার নিচে দিতে দেখা যায় না।
ডেকচির টাকা
মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। জানা যায়, এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছিলেন। এগুলোতে দানের টাকা ফেলে কল্যাণ প্রত্যাশা করেন পূণ্যার্থীরা।
টাকার অংকে মানত করেন দর্শনার্থীরা। ঘরের মধ্যে একজন লোক রয়েছেন টাকার হিসেব ও বড় ধরনের টাকার অংক গ্রহণের জন্যে।
তবে এই টাকায় জনকল্যাণমূলক কাজ হওয়ার কথা থাকলেও তার কোনো ফিরিস্তি পাওয়া যায়নি।
৫০০ টাকা ভাড়ার বেড ৫ হাজার টাকায়
প্রতিবছর ঈদুল আযহার পূর্বে ১৯ ও ২০ জিলক্বদ হযরত শাহজালাল (র.) মাজারে অনুষ্ঠিত হয় দু’দিনব্যাপী ওরস। এসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভক্ত আশেকানদের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে দরগাহ প্রাঙ্গণ।
এসময় নগরীর কোনো আবাসিক হোটেলে রুম খালি পাওয়া যায়না। ওরসের সময় অনেক দর্শনার্থী দ্বিগুন ভাড়া পরিশোধ করেও দরগা মাজার এলাকায় রুম পায় না ।
মাজার গেটের ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, “ওরসের আগে না আসলে বুঝতে পারবেন না। ৫০০ টাকার বেড ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখে হোটেলগুলো। অথচ এদের উচিৎ বাইরে থেকে আসা অতিথিদের যেন অসুবিধা না হয়, সেভাবে রাখা।
”
নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ব্যবসা
পঞ্চাশোর্ধ রুহুল আমিন আতর ও টুপি বিক্রি করেন। বলেন, “এখানে মাজারকে কেন্দ্র করে অনেকেই নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ব্যবসা করছেন। মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা করছে। ধর্মীয় পূণ্যস্থান বলে মানুষ টাকা দিতেও দ্বিধা করেন না। আর লন্ডনী টাকা আছে অনেক।
লন্ডনীদের কাছে যা দাম চায় তাই দেয়। ”
রুহুল আমিন বলেন, “খোদার কাছে ধনী-গরীব সবাই এক। এই যে, কদমা, হালুয়া বিক্রি করা হয়, গরিবরাতো এগুলান কিনতে পারে না। আবার দেখেন এই লাইলন সুতা, মোমবাতি, আগর বাতি সবকিছুরই দাম ইচ্ছেমতো রাখে। ”
পদে পদে চাই টাকা
ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পূণ্যার্থী আবু জাফর।
তিনি বলেন, “মাজারে নেশায় আসক্ত অনেক লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। এরা মাজারকে অপবিত্র করছে। ”
মাজারের পবিত্রতা রক্ষায় মূল প্রাঙ্গণে উঠার আগে জুতা খুলে যেতে হয়। হারানোর ভয় থাকায় জুতা জমা রাখতে হয়। এখানেও দিতে হয় টাকা।
এ টাকার অংকও ১০ থেকে হাজার পর্যন্ত উঠে। ছুটির দিন ও ধর্মীয় দিনগুলোতে শুধু জুতা সংরক্ষণ করেই দিনে ৫০ হাজার টাকার মতো আয় হয় বলে জানান স্থানীয়রা।
মাজারের কর্মচারী ও অর্থের ব্যাপারে সেক্রেটারি জহির উদ্দিন বলেন, এখানে ৬ জন সিকিউরিটি গার্ড রয়েছেন। এছাড়াও মোতাওয়াল্লী রয়েছেন। সেক্রেটারি পদকে ‘কেরানী’ উল্লেখ করে বলেন, আরো একজন আছে কেরানি।
তবে মাছ বিক্রেতা, ডেগের টাকা সংগ্রহকারী, জুতার টাকা সংগ্রহকারীরা কেউই মাজারের কর্মচারী নন বলে জানান তিনি।
মাজারকে নিজ নিয়মেই চলতে দিতে হবে
তিনি জানান, এখানকার ডেগ ও মাজারে দেয়া অর্থ পান খাদেমরা। গেটের পাশের দানবাক্সের অর্থ ব্যয় হয় মাজারের কাজে। এছাড়াও নিয়ত করে অনেকে মাজারে অর্থ দান করেন।
মাছ বিক্রি, জুতা সংরক্ষণের অর্থ ব্যবসায়ীরাই নেন।
নিজ থেকেই তিনি জানান, এ মাজারকে নিজ নিয়মেই চলতে দিতে হবে। এর আগে ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬৮ সালে ও এরশাদের সময় মাজরকে সরকারের তত্বাবধানে নেয়া হয়। কিন্তু চালানো সম্ভব হয়নি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।