I never knew how to worship until I knew how to love. শাহজালালের সিলেট আগমনঃ
হযরত শাহজালাল(রঃ) আরবের ইয়েমেনের অধিবাসি ছিলেন। তাঁর পিতা মাহমুদ বিন মোহাম্মদ ছিলেন কোরায়শ বংশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাকে পীরদের পীর হিসাবে অভিহিত করা হতো। তিনি বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁর মা ছিলেন সৈয়দ বংশের এক মহীয়সী নারী।
শাহজালালের বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে লালন পালন করেন। তিনি ভাগ্নেকে এমন ভাবে বড় করতে চাইলেন যাতে তিনি পান্ডিত্য ও বৈদগ্ধের স্তরে গিয়ে পৌছে যেতে পারেন। ধীরে ধীরে তার অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকল।
কথিত রয়েছে-একদিন সৈয়দ আহমদ কবির তার নিজ গৃহের ভেতর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে এসে হযরত শাহজালালের হাতে দিয়ে বললেন, ভারত বর্ষের দিকে বেরিয়ে পড়ো এবং যে মাটির সাথে এ মাটির রুপ-রস-ঘ্রাণের সাদৃশ্য খুঁজে পাবে সেখানে এই মাটি ছড়িয়ে দিয়ে আস্তানা গাড়বে।
শাহজালাল তাঁর পীরের কথা অনুযায়ী হাজী ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কিছু শিষ্য নিয়ে ভারতবর্ষের দিকে রওয়ানা হলেন। প্রথমে তিনি নিজ বাসভুমি ইয়ামনে এসে পৌঁছেন। এসময় ইয়ামনে এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি বিষপানে শাহজালালকে বধ করার চেষ্টা চালালেন। কিন্তু শাহজালালের কৌশলের কাছে রাজার দুরভিসন্ধি পরাজিত হল।
রাজার মৃত্যুর পর তার পুত্র শেখ আলি ক্ষমতায় অভিষিক্ত হন। শেখ আলি শাহজালালের গুন ও কোমলমতির পরিচয় পেয়ে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সফরসঙ্গী হলেন শাহজালালের। শাহজালাল তার পীরের দেওয়া মাটি শেখ আলির হাতে দিয়ে বললেন, আমরা যখন যেখানে গিয়ে পৌঁছাব,সেখানকার মাটির সঙ্গে এ মাটির রুপ-রস-গন্ধ তোমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে-এটাই হল তোমার কাজ। শেখ আলিকে জিহবা দিয়ে চুষে মাটি নিরীক্ষণ করতে হতো।
সে কারণে আজো তাকে চাষণির পীর হিসাবে অভিহিত করা হয়।
শাহজালাল যখন দিল্লীতে পৌঁছান, তখন সেখানকার বিখ্যাত পির ছিলেন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। তিনি প্রকৃত অর্থেই অনুধাবন করতে পারলেন শাহজালাল একজন দরবেশ। তিনি ছাই রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার হিসাবে পাঠিয়ে তাঁকে তার দরবারে নিমন্ত্রণ জানালেন। শাহজালালের মাজারে এখন যে কবুতর উড়তে দেখা যায়- তা ওই কবুতরেরই বংশধর-যা জালালি কবুতর নামে পরিচিত।
শাহজালাল যখন সিলেটে আসেন-তখন এখানে গোবিন্দ নামক এক রাজার রাজত্ব ছিল। এ রাজ্য জড়িবটি ও জাদুটোনার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাজা গোবিন্দের জন্মস্থান গৌড়ে থাকায় তাকে গৌড় গোবিন্দ নামে ডাকা হতো। শাহজালাল ও তার সঙ্গীরা যখন গৌড় রাজ্য অধিকার করেন-তখন রাজা গৌড় ছেড়ে সিলেটে আশ্রয় নেন এবং নিজেকে রাজা বলে দাবি করতে থাকেন। ওই সময় সিলেট শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত টুলটিকর নামক স্থানে শেখ বুরহান উদ্দিন নামক একজন মুসলমান থাকতেন।
বুরহান উদ্দিন ছিলেন নি:সন্তান। আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থনার পর তিনি একটি পুত্র সন্তান লাভ করলেন। তার সন্তানের আকিকা উপলক্ষে তিনি একটি গাভী কুরবানি দেন। এসময় একটি কাক অথবা একটি চিল এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে গৌড় গোবিন্দের ঘরে ফেলে দিল। তখন হিন্দুরা গাভীর রক্তকে ব্রাহ্মণের রক্তের সদৃশ মনে করত।
এতে রাজা ভীষণ রাগান্বিত হলেন। তিনি বুরহান উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে তার হাতের কব্জি কেটে দিলেন এবং তার নিষ্পাপ শিশুকে জবাই করে হত্যা করলেন। এতে বুরহান উদ্দিন নিরুপায় হয়ে পড়লেন। তার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে। একদিন বুরহান উদ্দিন গোপনে শহর ছেড়ে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন ইবনে মুহম্মদ শাহের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন।
তিনি সুলতানের কাছে তার ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করলেন। সুলতান এ মর্ম পীড়াদায়ক কাহিনী শুনে ভীষণ আঘাত পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুরহান উদ্দিনের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার ভাতিজা সিকন্দর শাহকে সসৈন্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সিকন্দর গাজি যখন ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে সোনারগাঁয়ে আস্তানা গাঁড়লেন। খবর পেয়ে গৌর গোবিন্দ তার জাদুকরদের ভৌতিক শক্তির সাহায্যে সিকন্দর গাজির সৈন্যদের ওপর জাদুমিশ্রিত অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করতে থাকল।
এতে সিকন্দর গাজির সৈন্যরা পরাস্ত হল। এরপর ঘটনাক্রমে শাহজালালের সাথে দেখা হয় সিকন্দর গাজির। তখন তাদের সৈন্য সংখ্যা তিন শত ষাট-এ গিয়ে দাঁড়াল। সিকন্দর গাজি তার সকল কথা শাহজালালকে সবিস্তারে জানালেন। তিনি তার কথা শুনে বললেন, ‘আমিও এসেছি সকল বাতিল শক্তি ধ্বংস করে ইসলামকে প্রতিষ্টা করার জন্যে, তাই তুমি যদি সিলেট-বিজয় করতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পারো।
’
হযরত শাহজালাল যোদ্ধাগণকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ব্রহ্মপুত্রের তীরে পৌঁছে দেখলেন এখানে কোন নৌকা নেই। তিনি তার মুসাল্লা(জায়নামাজ) বিছিয়ে দিলেন এবং সকলকে নিয়ে পার হলেন। তারা যখন সিলেটের চৌকি পরগনায় পৌঁছলেন-তখন গৌর গোবিন্দের সৈন্যরা তার প্রতি অগ্নিবাণ ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু শাহজালাল তার অলৌকিক ক্ষমতায় তা প্রতিহত করলেন, যা ফিরে গিয়ে গৌর গোবিন্দের আস্তানায় অন্ধকার জালের সৃষ্টি করল।
এ দৃশ্য দেখে সৈন্যরা ঘাবড়ে গেল। এ খবর শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন গৌড় গোবিন্দ নিজেও। এ অবস্থায় শাহজালাল বরাক নদীর তীরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু এখানেও পারাপারের কোন ব্যবস্থা নেই। আবারও তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে নদী পার হয়ে সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে জালালপুর পরগণায় এসে পৌঁছলেন।
এসময় গৌড় গোবিন্দ একটি বিশাল লোহার কামান হাতির ওপর সওয়ার করে শাহজালালের কাছে পাঠালেন। রাজার দূতরা জানাল, তিনি যদি ধনুতে শরযোজনা করতে পারেন, তাহলে তিনি তার জাদুটোনা থেকে বিরত থাকবেন এবং বিনা যুদ্ধে রাজ্যভার ছেড়ে দেবেন। শাহজালাল তার শর্ত মেনে নিলেন। এরপর শাহজালাল তার সফরসঙ্গী নাসির উদ্দিনকে ধনুতে শরযোজনা করতে বললেন। কিন্তু তা এতই কষ্টকর ছিল যে, শক্তি প্রয়োগ করতে করতে তার শরীরের রোমকূপ থেকে রক্ত বের হওয়ার উপক্রম হলো।
নাসির উদ্দিনের এ অবস্থা দেখে শাহজালাল তার অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা তাকে সহযোগিতা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে নাসির উদ্দিন বিসমিল্লাহ বলে ধনুতে শরযোজনা করতে সক্ষম হলেন। এই অসাধ্য সাধন করা দেখে চারদিক থেকে হর্ষ ধ্বনি উঠল এবং আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল। এরপর কামানটি যখন গৌর গোবিন্দের দিকে এগিয়ে আসছিল, তখন গৌড় গোবিন্দের চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত। রাজা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলতে লাগলেন,‘আমার রাজ্য চলে গেল।
’ রাজা পলায়নের উদ্দেশ্যে কাছাড়ের পথ ধরলেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি।
তিনি এখানে রাজ্য জয় করে দেখেন তাঁর পির সৈয়দ আহমদ কবিরের দেওয়া এক মুঠো মাটির সাথে এখানকার মাটির অদ্ভূত মিল রয়েছে। তিনি সিলেট শহরের দরগা মহল্লায় একটি ছোট্ট টিলায় তাঁর আস্তানা গাড়লেন। এখানে বসেই এবাদত বন্দেগি করতে থাকেন।
তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে,পরগণায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেন। শুধু ইয়ামনের রাজপুত্র, হাজি ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কয়েকজন খাদেমকে তার কাছাকাছি রাখলেন। এখান থেকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং নিজের আস্তানাকে ধ্যান ও সাধনার এক অনুপম লীলাক্ষেত্রে পরিণত করলেন। হযরত শাহজালাল ছিলেন কিংবদন্তি তুল্য। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের আধ্যাত্নিক শক্তি যোগাচ্ছেন এই সাধক পুরুষ।
বাংলা ভাষায় লেখা সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’-এ বলা হয়েছে-হযরত শাহজালাল যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তার কবরের চারপাশে ছোট্ট দেওয়াল তোলা হয়। পাশেই বানানো হয় একটি মসজিদ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্নিক পুরুষ হযরত শাহজালাল ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে আগমন করেন। তিনি ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
তিনি ছিলেন চির কুমার। (শেষ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।