গনজাগরনের মাধ্যেমে পরিবর্তন সম্ভব....মানুষের চিন্তার পরিবর্তন করাটা জরুরি ....বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরজাগরনে বিশ্বাসী সিলেট শহরে দেশ বিদেশ থেকে যত লোক বেড়াতে আসেন তার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক আসেন হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার জিয়ারত করতে। দরবেশ হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রঃ) সূদুর ইয়েমেন থেকে সিলেটে আসেন ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে। সারা দেশ সহ পৃথিবী জুড়ে রয়েছে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অসংখ্য ভক্ত। তাদের পদভারে সবসময় মুখরিত থাকে শাহজাললের দেশ সিলেট।
জন্ম ও বংশ পরিচয় ও শৈশবঃ ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে ইয়েমেনের তৎকালীন রাজধানী তাইজ এ হযরত শাহজালাল (রঃ) জন্ম গ্রহন করেন।
শাহজালালের পুরো নাম শেখ উল মাশায়েখ মখদুম বিন মুহম্মদ। বত্রিশ বছর বয়সে তিনি সিলেটে আসেন এবং সুদীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর যাবত বাংলা এবং আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়ে পচাত্তর বছর বয়সে ১৩৪৬ খৃষ্টান্দে ইন্তেকাল করেন। তিনি চিরকুমার হিসেবেই তার সারাটা জীবন কাটিয়ে দেন। তাঁর পিতা ছিলেন মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কোরেশী এবং মাতা হাসিনা ফাতিমা বিনতে জালালুদ্দিন সুরুখ বোখারী, তারা উভয়ই ছিলেন কুরাইশ বংশীয়। তাঁর পিতা ছিলেন তাইজের নিকটবর্তী আজান দূর্গের আমীর এবং ইয়েমেনের সুলতানের শিক্ষক।
হযরত শাহজালাল (রঃ)এর জন্মের আগেই এক যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন। শাহজালাল যখন তিন বছরের শিশু তখন তাঁর জননী ইন্তেকাল করেন। এতিম শিশু শাহজালালের লালন পালনের দায়িত্ব নেন তার মামা সৈয়দ আহম্মদ কবীর সৌরওয়ার্দী (রঃ) যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম এবং ইসলামী চিন্তাবিদ। মাত্র সাত বছর বয়সে হযরত শাহজালাল সমগ্র কোরআন শরীফ পাঠ শেষ করে মূখস্থ করেন। তিনি মামার কাছেই দ্বীনি তালিম হাসিল করেন এবং ইলমে মারেফতের ছবক নেন।
তারপর অল্পকালের মধ্যেই কামেলে ওলী হয়ে ওঠেন।
সিলেট আগমনের ইতিহাসঃ যখন তার বয়স ত্রিশ তখন হযরত একদিন রাতে স্বপ্ন দেখেন তিনি হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের জন্য আদিষ্ট হয়েছেন। স্বপ্নের বিষয় মামাকে জানালে মামা তাকে স্বপ্ন অনুযায়ী কাজ করতে বলেন এবং একমুঠো মাটি দিয়ে স্বাদে, বর্ণে ও গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করার নির্দেশ দেন। তারপর হযরত শাহজালাল (রঃ) জন্মভূমি ত্যাগ করে হিন্দুস্থানের পথে রওয়ানা হন। শুরুতে তার সাথে ছিলেন বারজন সঙ্গী ।
বহুপথ এবং দেশ পাড়ি দিয়ে যখন তিনি দিল্লী পৌঁছেন তখন তার সহযাত্রীর সংখ্যা অনেকগুন বেড়ে যায়। হযরত শাহজালাল (রঃ) দিল্লী পৌঁছার সংবাদ পেয়ে হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তার সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে আসেন হযরত শাহজালাল (রঃ) আস্তানায় এবং তাকে এক জোড়া কবুতর উপহার দেন। পরবর্তীতে এই কবুতর গুলো বংশ বৃদ্ধি করে সারা সিলেট অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে এবং যা জালালী কবুতর নামে আমাদের নিকট ব্যাপক পরিচিত। দিল্লী থেকে বিদায় নিয়ে হযরত শাহজালাল (রঃ) বিহার গমন করেন। সেখানেও কয়েকজন তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার অনুগামী হন।
তারপর তিনি বাংলাদেশের সপ্তগ্রামে পৌঁছেন। মুসলমান বাদশাহ তাকে সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার অনুরোধ করলে মাটির মিল না হওয়ায় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে সম্মত হননি। সেই সময় গৌড়ের তথা সিলেট অঞ্চলের রাজার ছিলেন গৌড় গোবিন্দ। অত্যাচারী হিসেবে খ্যাত রাজা গৌড় গোবিন্দের অত্যাচারে প্রজারা ছিলো অতিষ্ট। একবার বোরহান উদ্দিন নামে মুসলমান এক প্রজা তার ছেলের আকিকায় গরু জবাই করেন।
গরু জবাই করার অপরাধে গৌড় গোবিন্দ তার শিশু সন্তানকে হত্যা করে এবং বুরহান উদ্দিনের হাত কেটে নেয়। তারপর রাগে দুঃখে বুরহান উদ্দিন দিল্লীতে গিয়ে সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকে গৌড় গোবিন্দের অত্যাচারের কথা জানিয়ে বিচার প্রার্থনা করেন। সম্রাট তার ভাগিনা সিকান্দর গাজীকে অত্যাচারী রাজা গৌড় গবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযানের আদেশ দেন। সিকান্দর গাজীকে গৌড় রাজ্যের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসেন বোরহান উদ্দিন। কিন্তু সম্রাটের বাহিনী বাংলার বর্ষা আবহাওয়ায় যুদ্ধে ভাল করতে পারলেন না।
তারপর সিকান্দর গাজী ব্রক্ষপুত্রের তীরে তাঁবু ফেলে আবার ফিরোজ শাহকে নতুন সৈন্যদল পাঠানোর অনুরোধ জানালেন। সম্রাট সৈয়দ নাসিরউদ্দিকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে আরেক দল সৈন্য প্রেরণ করেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) ৩১১ জন শিষ্য নিয়ে সেই সময় মাত্র ভারতের এলাহাবাদ পৌঁছেছেন। তার আধ্যাত্নিক শক্তির কথা তখন সর্বত্র প্রচারিত। সিপাহসালার নাসিরউদ্দিন হযরতের সাথে সাক্ষাৎ করে সাহায্য কামনা করলে তিনি তার সাথে যেতে রাজী হন।
তখন সবার মনোবল কয়েকগুন বেড়ে যায় এবং সকলে মিলে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) এবং নাসিরুদ্দিন বাহিনী গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমানার ডেওকিতে এসে পৌঁছান। রাজা গৌর গোবিন্দের সৈন্যরা অনেক গুপ্ত আক্রমন করে এ বাহিনীকে আটকাতে পারে নি। তারপর তারা গৌর রাজ্যের পৌছার জন্য বাহাদুরের নিকট বারাক নদীর তীরে পৌছান। রাজার নির্দেশে আগে থেকেই নৌকা চলাচল বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো যেন কেউ নদী পার হয়ে রাজ্যে প্রবেশ করতে না পারে।
শোনা যায় হজরত শাহজালাল (রঃ) নিজের বব্যহৃত জায়নামাজ পানির উপর বিছিয়ে দিয়ে অনুচর, সৈন্যদলসহ আধ্যাত্বিক ভাবে নদী পার হয়ে যান। বিভিন্ন বাধা দিয়েও শাহজালালের বাহিনীকে রুখতে না পেরে হতাশ রাজা গৌর-গোবিন্দ এক প্রকার চালাকির আশ্রয় নেয়। সে ঘোষনা করে যে, তার লৌহ নির্মিত ধনুক আছে, হযরতের বাহিনীর কেউ যদি এ ধনুকের মাথা দুটি যুক্ত করতে পারে তবে সে বিনা যুদ্ধে এ অঞ্চলের শাসনভার ছেড়ে দিবে। হযরত শাহজালাল (রঃ) সিপাহসালার নাসিরুদ্দিনকে নির্দেশ দিলে তিনি সহজেই ধনুকের মাথা দুটি যুক্ত করলে গোবিন্দ প্রাণ ভয়ে দূর্গে আশ্রয় নেয়। তারপর রাজা গৌবিন্দ ধরা পরে।
ক্ষমা প্রার্থনায় হযরত তাকে ক্ষমা করে মুক্তি দেন। তারপর তিনি সাথে আনা মাটির সাথে এখানকার মাটির কোন মিল আছে কিনা পরিক্ষা করে সিলেটের মাটির তার সাথে আনা মাটির মিল খুজে পান। তিনি তার কাঙ্খিত স্থানে এসে পৌঁছেছেন ভেবে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের এবং ইসলাম প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। রাজা গৌর গোবিন্দের পতনের পর হযরত শাহজালাল (রঃ) কে সিলেটের শাসন ভার নিতে আহ্বান জানানো হয়েছিল কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর তারই ইচ্ছানুসারে শাহ সিকান্দার গাজীকে সিলেটের প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
মাজারঃ ইসলাম ধর্ম প্রচারক এবং দরবেশ হযরত শাহজালাল (রঃ) যে স্থানে নিয়মিত এবাদত বন্দেগি এবং বসবাস করতেন তার ইন্তেকালের পর সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করে তার মাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাজারটি দরগাহ-এ হযরত শাহহজালাল নামে দেশে বিদেশে অধিক পরিচিত। সিলেট নগরীর চৌহাট্রা ও আম্বরখানা পয়েন্টের মধ্যবর্তী দরগা মহল্লা নমক স্থানে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার শরীফ অবস্থিত। জাতিধর্ম নির্বিশেষে অগণিত ভক্ত সারা বছর এখানে জিয়ারত করতে আসেন। প্রতি বছর উনিশ জ্বিলকদ তারিখে হযরত শাহজালাল (রঃ)- এর ইন্তেকাল উপলক্ষ্যে ওরশ অনুষ্ঠিত হয় মহাসমারোহে।
হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মুরিদের সংখ্যা যে কত ছিল তা জানা না গেলেও তার প্রধান সহচর ও খলিফার সংখ্যা ছিলো ৩৬০ জন। সহচর ও খলিফাদেরকে ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন তিনি। বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব সহচর ও খলিফার মাজার বিদ্যমান। মাজরের গুম্বুজ এবং অট্রালিকাটি দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে সিলেটের ফৌজিদার ফরহাদ খান ১৬৭০ খৃষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। জাতিধর্ম নির্বিশেষে অগণিত মানুষের ভীড় সারা বছরই এই মাজারে লেগে থাকে।
এখানে মাহিলাদের ইবাদতের জন্য একটি আলাদা কক্ষ রয়েছে। হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে বড় গম্বুজবিশিষ্ট হলঘরের ভিতর দিয়ে মাজারে প্রবেশ করতে হয়। হলঘরের ঠিক পশ্চিমে একটি ভবন রয়েছে। এটি ঘড়িঘর নামে পরিচিত। ঘড়িঘরের আঙ্গিনার পূর্বদিকে চারটি মাজার রয়েছে।
এর মধ্যে তিনটি মজার হচ্ছে হযরহ শাহজালালের (রঃ) ঘনিষ্ঠ সাথীদের। তাদের মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রীলঘেরা ছোট্র তারকাচিত্র যে ঘরটি রয়েছে তাতে হযরত শাহজালাল (রঃ) জীবনের দীর্ঘ তেইশ বছর আরাধনায় কাটিয়েছেন। হযরত শাহজালালর (রঃ)’র মাজার থেকে নেমে পশ্চিম দিকে গিয়ে একটি ঝর্না পাওয়া যায়। ঝর্ণার উপরে লোহার গ্রীল দেয়া রয়েছে। এই ঝর্না থেকে অনবরত পানি বের হচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে হযরত শাহজালাল (রঃ) সিলেটে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রাক্কালে ব্যবহারযোগ্য পানি অভাব ছিল বিধায় তিনি ওজু ও গোসল করার জন্য এই কুপ খনন করান। এছাড়াও মাজারে মহিলাদের ইবাদত খানা সহ ওজু ও গোসলের পর্যাপ্ত স্থান রয়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।