বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ১৩৩০ খ্রিস্টাব্দ; আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি এক নম্র ভোর। হজরত শাহজালাল তাঁর খানকার পুকুর ঘাটে বসে আছেন। ঘাটটি বেশ প্রশস্ত এবং সফেদ মর্মর পাথরে নির্মিত।
প্রতিদিনই ফজরের নামাজ আদায় করে সুবে সাদিকের সময় পুকুরের ঘাটে এসে বসেন দরবেশ। দরবেশের হাতে তসবি, ভালো করে আলো ফোটা অবধি আল্লাহর পবিত্র নাম স্মরণ করেন। তখন সুরমা নদীর দিক থেকে ফুরফুরে হাওয়া এসে দরবেশকে জড়িয়ে ধরে । দরবেশের মুরীদ তিনশো ষাটজন । তাদেরই কয়েকজন দরবেশের সঙ্গে ঘাটের ওপর বসে থাকেন ।
তারাও নদীর দিক থেকে ছুটে আসা ভেজা বাতাসের শীতল স্পর্শ স্পষ্ট টের পান। পুকুরের পাড় ঘেঁষে বাহারি ফুলের একটি মনোরম উদ্যান। নদীর ভিজে হাওয়ারা ফুলের সৌরভ মেখে সুগন্ধী আর চঞ্চল হয়ে ওঠে। আর তাতে ধ্যানস্থ দরবেশের লম্বা ধবধবে দাড়ি আন্দোলিত হয়। দরবেশের পরনে আতরমাখা কালো আলখাল্লা, মাথায় সবুজ পাগড়ি, আয়ত চোখে দুটিতে সুরমা ...
আজ এত ভোবে ক্লান্ত বিষন্ন ভঙ্গিতে একজন মাঝবয়েসি লোককে পুকুর ঘাটের দিকে আসতে দেখা গেল।
লোকটিকে দেখে অতিশয় দুঃস্থই মনে হয়। ধুলামাখা পায়ে ছেঁড়া চটি, পরনে ময়লা লুঙ্গি, ছেঁড়া ফতুয়া। এক মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। কালো শরীরটি শীর্ণ। দুচোখে অনিদ্রার স্পষ্ট চিহ্ন।
দরবেশ চোখ বুজে ছিলেন। অচেনা পদশব্দে এখন দরবেশ চোখ খুলে মুখ তুলে তাকালেন। এবং পরিপূর্ণভাবে সজাগ হয়ে উঠলেন। আল্লাহর পবিত্র নাম জপতে জপতে এক তুরীয় মানসিক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলেন দরবেশ।
লোকটা দরবেশকে সালাম দিল।
দরবেশ মধুর হেসে সালামের উত্তর দিলেন। বস। মধুর স্বরে বললেন।
একজন মুরীদ সরে বসে। লোকটা সেখানে বসে।
আতরের গন্ধ পায় লোকটা। তার অস্বস্তি হয়।
লোকটা অত্যন্ত কুন্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, হজুর, আমার নাম সাইফুল ইসলাম । আপনার খানকার পিছনের গ্রামে আমার বাড়ি। আমি ... আমি বড় বিপদের পড়েছি হজুর।
আমায় সাহায্য করুন।
দরবেশ মৃদু হাসলেন। তারপর আকাশের দিকে আঙুল তুলে অত্যন্ত মৃদু স্বরে বললেন, বিপদ আল্লাই দেন, তারপর তিনিই আবার বিপদমুক্তির পথ দেখিয়ে দেন।
সাইফুল ইসলাম চুপ করে থাকে । সম্ভবত ভাবছিল, দরবেশের কথা যদি সত্য হত!
বল, শুনি, তুমি কি এমন বিপদে পড়েছ? দরবেশ জিজ্ঞেস করলেন।
সাইফুল ইসলাম এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হুজুর। আমি একজন গরীর কাঠুরিয়া। কাঠ কেটে, সে কাঠ বিক্রি করে কোনওমতে আমার সংসার চলে। আমার তিন মেয়ে। ওদের বিয়ের বয়সও হয়েছে।
কিন্তু, আমি গরীব মানুষ-ওদের বিবাহ দিতে পারছি না। আপনি যদি দয়া করে আমার মেয়েদের বিবাহের ব্যবস্থা ...
সাইফুল ইসলামের কথা শেষ হল না। দরবেশ বললেন, তুমি কাঠুরিয়া। না?
জ্বী। হুজুর।
তা, কোথায় কাঠ কাটতে যাও তুমি ?
লাক্কাতুরা জঙ্গলে হুজুর।
হুমম। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন হজরত শাহজালাল। যেন স্থানকালপাত্র বিস্মৃত হয়েছেন তিনি । তারপর হঠাৎই সচেতন হয়ে উঠলেন।
ঘাটে উপবিস্ট মুরীদদের কী সব নির্দেশ দিলেন দরবেশ। মুরীদগণ দ্রুত উঠে দাঁড়াল। তারপর খানকা শরীফে যেন সাজ সাজ রব পড়ে গেল। দেখতে দেখতে খানকার প্রাঙ্গনে স্তূপকৃত হয়ে উঠল কাঠুরিয়ার পোশাক, কুঠার এবং থলে ।
সাইফুল ইসলাম সবিস্ময়ে চেয়ে দেখল ...হজরত শাজালাল এবং তাঁর তিনশো ষাট জন মুরীদ পোশাক পরিবর্তন করে কাঠুরিয়ার পোশাক পরে নিলেন।
হাতে তুলে নিলেন কুঠার। কাঁধে থলে। থলেতে খাবার।
কী ব্যাপার? সাইফুল ইসলাম বিস্মিত।
হযরত শাজালাল তাকে একটি কুঠার এবং একটি থলে দিয়ে বললেন, এবার আমাদের সঙ্গে চল।
কোথায় হুজুর? সাইফুল ইসলাম চোখ দুটি প্রচন্ড কৌতূহলে বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
দরবেশ মৃদু হেসে বললেন, তুমি রোজ যে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাও সেখানে। স্তম্ভিত সাইফুল ইসলাম আর কি বলবে। দরবেশ যখন বললেন - সে লাক্কাতুরার উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকে। সুফিদের দল আল্লাহর নাম জিকির করতে করতে তাকে অনুসরন করতে থাকে ।
অল্প সময়ের মধ্যেই দলটি লাক্কাতুরার গহীন অরণ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। ততক্ষণে আশ্বিন সকালের মিঠে রোদ ছড়িয়ে পড়েছিল । তবে দিনের বেলাতেও লাক্কাতুরার অরণ্য কেমন অন্ধকার অন্ধকার হয়ে থাকে। প্রবল স্বরে ঝিঁঝিরা ডাকছিল। সেই সঙ্গে ডাকছিল অনেক পাখি ।
সুফিদের পদশব্দে একটি মায়া হরিণ যেন চকিতে সরে গেল একটি দীর্ঘকায় দেবদারু গাছের ওপাশে। গতকাল রাতে এদিকটায় এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। এখন বুনোঘাস এবং বুনো লতার ভেজা গন্ধ ভেজা হাওয়ায় ভাসছিল।
লাক্কাতুরা অরণ্যে সুফিরা সারাদিন কাঠ কাটলেন। তাদের সঙ্গে সাইফুল ইসলামও কাট কাটল।
দুপুরের দিকে সুফিরা ঝর্নার পানিতে অজু করে জোহরের নামাজ আদায় করলেন। তারপর গাছের ছায়ায় বসে সবাই একত্রে খেতে বসলেন। সামান্য মধু, শুকনো রুটি ও পানি। গরীব কাঠরিয়া, অর্থাৎ সাইফুল ইসলামরা প্রতিদিন যা খায় তাই।
খাওয়ার পর আবার কাঠ কাটা শুরু হল।
আসরের ওয়াক্তের আগেই সুফিরা কাঠ কাঁধে নিয়ে খানকায় ফিরে এলেন। তখনও আশ্বিন বেলার রোদ উজ্জ্বল হয়ে ছিল। দেখতে দেখতে পুকুরের পাড়ে কাঠের স্তূপ জমে উঠল। সাইফুল ইসলাম তখনও কিছু বুঝতে পারছিল না। সে যে অন্ধকারে ছিল, সে অন্ধকারেই রয়ে গেল ।
কেনই-বা আজ শাহজালাল দরবেশ মুরীদদের নিয়ে কাঠ কাটতে গেলেন, তার আগে কাঠুরিয়ার পোশাক পরলেন, এবং কাঠুরিয়াদের খাবার খেলেন? এসব প্রশ্ন হজরত শাহজালাল কে জিগ্যেস করার সাহস পেল না সে। হজরত শাহজালাল এতদ্বঞ্চলের জাদরেল পীর। তাঁর ভয়ে অরণ্যের বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খায়!
হজরত শাহজালাল একটি উচুঁ জায়গায় দাঁড়ালেন। তারপর সাইফুল ইসলামকে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতে বললেন। সাইফুল ইসলাম ভয়ে ভয়ে পীরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
আতরের ঘন গন্ধ টের পেল সে।
হজরত শাহজালাল এবার একে একে মুরীদদের ক্লান্ত ঘর্মাক্ত তামাটের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আজ সারাদিন আমরা কি করলাম?
কাঠ কাঠলাম মুর্শিদ! মুরীদরা সমস্বরে বললেন।
হজরত শাহজালাল এবার সাইফুল ইসলাম কে দেখিয়ে বললেন, এই যে একে দেখছ, এর নাম সাইফুল ইসলাম। এ একজন গরীব কাঠুরিয়া; এর তিনটি মেয়ে আছে।
গরীব বলেই সাইফুল ইসলাম তার মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছে না।
মুরীদদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল।
হজরত শাহজালাল বললেন, আজ যেহেতু আমরা কাঠ কাঠলাম, তাহলে অন্তত একদিনের জন্য হলেও আমরা কাঠুরিয়া?
হ্যাঁ, মুর্শিদ।
তাহলে এবার বল তোমাদের মধ্যে কোন্ তিনজন এই গরীব কাঠুরিয়ার তিন মেয়ে কে বিবাহ করতে চাও?
হাত অনেকেই তুলেছিলেন।
দরবেশ তিনজনকে বেছে নিয়েছিলেন।
... হজরত শাহজালাল-এর দরগার পাশের একটি মার্কেটের একজন সেলসম্যানের কাছে আমি এ কাহিনীটি শুনেছিলাম ১৯৯২ সালে সিলেট ভ্রমনের সময়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।